ফুলেল শ্রদ্ধায় মিয়াভাইকে শেষবিদায়
আট বছরের ছেলে, এক বছরের মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে চিত্রনায়ক ফারুককে শ্রদ্ধা জানাতে শহীদ মিনারে এসেছেন ডেমরার তরুণ মোহাম্মদ সোহেল, তিনি নিউমার্কেটের এক দোকানে কাজ করেন। সোহেল প্রথম আলোকে বললেন, ‘জীবদ্দশায় তাঁকে দেখার খুব ইচ্ছা ছিল পারিনি, আজকে পরিবারের সবাইকে নিয়ে তাঁকে দেখতে এসেছি।’
ফারুককে প্রথম ও শেষবারের মতো দেখতে ছোট ভাই সোহেলকে সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন ডাব বিক্রেতা সোলায়মান। ফারুককে শহীদ মিনারে নেওয়া হবে শুনে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসেছেন তাঁরা। সোলায়মান জানালেন, ‘নয়নমনি’ থেকে ‘সুজন সখী’—ফারুকের বহু সিনেমা দেখেছেন তিনি। মিয়া ভাইকে হারানোর বেদনা তাড়িত করেছে তাঁকে।
সোহেল ও সোলায়মানের মতো অনেকে মিয়া ভাইয়ের প্রতি ভালোবাসার টানে ছুটে এসেছেন, যাঁরা নায়ক ফারুকের অনুরাগী। রাজনৈতিক কিংবা সাংস্কৃতিক সংগঠন ছাপিয়ে কোনো শিল্পীকে শ্রদ্ধা জানাতে সাধারণ মানুষের এ উপস্থিতির ঘটনা নজিরবিহীন।
একের পর এক গ্রামীণ পটভূমির সিনেমায় অভিনয় করে সাধারণ দর্শকের ‘মিয়া ভাই’ হয়ে উঠেছিলেন ফারুক। প্রায় পাঁচ দশকের ক্যারিয়ারে গ্রামীণ পটভূমিতে নির্মিত ‘নয়নমনি’, ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’, ‘সারেং বৌ’ ও ‘সুজন সখী’ চলচ্চিত্রে গ্রামের যুবক নয়ন, মিলন, কদম সারেং, সুজনের মতো আলোচিত চরিত্রে প্রাণ দিয়ে গতকাল সোমবার না ফেরার দেশে পাড়ি দিয়েছেন ফারুক।
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের আয়োজনে আজ মঙ্গলবার ফারুককে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, স্পিকারের প্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতা, বিভিন্ন সংগঠনের কর্মীসহ নানা পেশার মানুষ ফুলেল শ্রদ্ধা জানান। বীর মুক্তিযোদ্ধা, সংসদ সদস্য ও চিত্রনায়ক ফারুকের মরদেহ আজ বেলা ১১টা ৫০ মিনিটে শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে নেওয়া হয়। শুরুতে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের পক্ষে লে. কর্নেল সৈয়দ মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। এরপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে শ্রদ্ধা জানাতে আসেন তাঁর সামরিক সচিব মেজর জেনারেল কবীর আহাম্মদ। স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর পক্ষে শ্রদ্ধা জানান সংসদ সচিবালয়ের সার্জেন্ট অ্যাট আর্মস এম এম নাঈম রহমান।
আওয়ামী লীগের পক্ষে দলটির সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বে দলের নেতারা শ্রদ্ধা জানান। শ্রদ্ধাজ্ঞাপন শেষে ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেন, ‘চিত্রনায়ক ফারুক ছিলেন বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি অবিচল ও অনড় পাথরের মতো। তিনি তাঁর আদর্শ থেকে কখনো একচুলও ছাড় দেননি। ফারুকের বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্র আমার কাছে ভালো লেগেছে। তাঁর লাইফটা ছিল কালারফুল। একদিকে ভালো নায়ক, অন্যদিকে রাজনীতিবিদ।’
ফারুককে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন শেষে সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ বলেন, ‘মানবিক গুণাবলির সব গুণই তাঁর ছিল। তাঁর সঙ্গে আমাদের পরিবারের একটি বন্ধন ছিল। জাতীয় সংসদে আমরা পাশাপাশি আসনে বসতাম। দুই বছর ধরে আসনটি শূন্য। দুই বছর ধরে তিনি চিকিৎসাধীন ছিলেন। আমরা ভেবেছিলাম, তিনি সুস্থ হয়ে ফিরে আসবেন। দুর্ভাগ্য আমাদের, তাঁকে হারিয়ে শূন্যতা তৈরি হয়েছে।’
ফারুকের ছেলে রওশন হোসেন পাঠান বলেন, ‘আমি সবাইকে বলতে চাই, আপনারা উনার প্রতি কোনো দুঃখ রাখবেন না। উনি যদি কোনো কষ্ট দিয়ে থাকেন, উনাকে মাফ করে দেবেন। আপনারা কোনো দাবি রাখবেন না। আপনারা উনার জন্য দোয়া করবেন।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামান, মহানগর আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট, গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনসহ নানা রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনের তরফ থেকে ফারুককে শ্রদ্ধা জানানো হয়। ফারুককে শ্রদ্ধা জানাতে ইলিয়াস কাঞ্চন, ফেরদৌস, মিশা সওদাগর, নিপুণ, জায়েদ খানসহ আরও অনেকে এসেছিলেন শহীদ মিনারে। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে ফারুককে শ্রদ্ধা জানাতে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। এরপর শহীদ মিনার থেকে ফারুককে বহনকারী কফিন তাঁর দীর্ঘদিনের কর্মস্থল এফডিসিতে নেওয়া হয়। এফডিসিতে ফারুককে শেষবারের মতো বিদায় জানান সহকর্মী শিল্পী, নির্মাতা, প্রযোজক ও কলাকুশলীরা।
শহীদ মিনার ও এফডিসিতে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন শেষে ফারুককে চ্যানেল আই প্রাঙ্গণে নেওয়া হয়, সেখানে তাঁর জানাজা হয়। এর পর গুলশানে আজাদ মসজিদে তাঁর আরেকবার জানাজা হওয়ার কথা রয়েছে। সন্ধ্যায় তাঁর গ্রামের বাড়ি গাজীপুরের কালীগঞ্জের পারিবারিক কবরস্থানে তাঁকে সমাহিত করা হবে।
দুই বছরের বেশি সময় ধরে সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন ফারুক। গতকাল সকালে তাঁর মৃত্যু হয়। আজ সকালে তাঁর মরদেহ ঢাকায় পৌঁছে।