২০ বছর পর হাউসফুল
১৯৭৪ সালে শাবানা-ওয়াসিম অভিনীত ও ইবনে মিজান পরিচালিত ‘ডাকু মনসুর’ সিনেমা দিয়ে যাত্রা শুরু করে মধুবন। তখন হলটির ধারণক্ষমতা ছিল এক হাজার। যাত্রা শুরুর প্রথম দুই সপ্তাহ মধুবন ছিল ‘হাউসফুল’। এরপর মধুবনের পর্দায় ব্যবসাসফল ছবির তালিকা বেশ দীর্ঘ। নব্বই দশকের পর দর্শকখরায় মন্দা শুরু হয় সিনেমা হলের প্রদর্শন ব্যবসা। গত দুই দশকে মধুবন হাউসফুল ব্যবসা করেনি কোনো সিনেমায়। তবে দুই দশকের রেকর্ড ভেঙে দর্শকের ‘ঢল’ নেমেছে মধুবন সিনেপ্লেক্সে, হয়েছে হাউসফুল।
শুক্রবার মধুবন সিনেপ্লেক্সে মুক্তি পেয়েছে রায়হান রাফি পরিচালিত ত্রিভুজ প্রেমের গল্প ঘিরে নির্মিত ‘পরাণ’ সিনেমাটি। প্রথম দিন থেকেই দর্শকের আগ্রহ দেখা যায় এ ছবির প্রতি। শুক্রবার বৈকালিক ও সান্ধ্য শো ছিল হাউসফুল। ৩৪৫ আসনের সিনেপ্লেক্সে সব টিকিট বিক্রি হয়ে যায়। এই দুই শোতেই টিকিট না পেয়ে অনেক দর্শককে ফিরে যেতে দেখা গেছে। শনিবার দুপুরের শোতে মোট আসনের ৭০ শতাংশ টিকিট বিক্রি হয়েছে। দ্বিতীয় দিনের মতো বৈকালিক শো ছিল হাউসফুল।
মধুবন সিনেপ্লেক্সের মালিক আর এম ইউনুস রুবেল প্রথম আলোকে বলেন, ২০০০ সালের পর মধুবন হাউসফুল হয়নি। মাঝখানে সিনেপ্লেক্সে রূপান্তরের সংস্কারকাজের জন্য ২০১৭ সাল থেকে টানা সাড়ে তিন বছর বন্ধ ছিল মধুবন। গত বছরের অক্টোবরে যৌথ প্রযোজনার ছবি ‘বাজি’ দিয়ে নতুন আঙ্গিকে উত্তরবঙ্গের প্রথম অত্যাধুনিক সিনেমা হল মধুবন সিনেপ্লেক্সের যাত্রা শুরু হয়। কিন্তু এ পর্যন্ত কোনো ছবিতেই হাউসফুল দর্শক হয়নি।
ঈদুল আজহার দিন থেকে অনন্ত-বর্ষা জুটির ‘দিন: দ্য ডে’ ছবি চলেছে। দর্শকের বেশ আগ্রহ থাকলেও এ ছবির কোনো শোতেই হাউসফুল হয়নি।
মধুবন সিনেপ্লেক্সের মালিক আর এম ইউনুস রুবেল আরও বলেন, দীর্ঘদিন পর দর্শকেরা সপরিবার সিনেমা হলে ছবি দেখতে আসছেন। কিছুদিন আগেও সিনেমা হলে আসতেন শুধু শ্রমজীবী শ্রেণির দর্শক। ‘পরাণ’ দেখতে সপরিবার আসছেন মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত শ্রেণির দর্শক। আসছেন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী ও চাকরিজীবীরাও। দর্শকেরা ছবি শেষে শতভাগ বিনোদনের তৃপ্তি নিয়ে হল থেকে বের হয়ে আসছেন। বলছেন, এ ধরনের ছবি নির্মাণ করা হলে সিনেমা হলের পরিবেশ এমন ভালো হলে, তাঁরা নিয়মিত আসবেন।
মধুবনের এই উদ্যোক্তা বলেন, ভালো গল্পের কারণেই সিনেমাটি নিয়ে দর্শকদের এমন আগ্রহ। তিনি বলেন, দর্শকের কাছে গল্প ভালো লাগলে, সেই সিনেমা লুফে নেন। মানুষ সাধারণ গল্পের সিনেমা দেখতে চায়। ‘পরাণ’-এর গল্প ও নির্মাণ ভালো। তাই দর্শক বেশি পছন্দ করেছেন।
শনিবার বৈকালিক শোতে ছবি দেখতে এসেছিলেন ব্যবসায়ী ফজলে রাব্বি। বলেন, সিনেমা হলে বসে সর্বশেষ সিনেমা দেখেছিলেন চিত্রনায়ক সালমান শাহ অভিনীত ‘সত্যের মৃত্যু নেই’। তা-ও ২৬ বছর আগে ১৯৯৬ সালে। এরপর সিনেমা হলের ভালো পরিবেশ না থাকায় এবং সেই ধরনের ছবি নির্মাণ না হওয়ায় আর কখনো সিনেমা হলে পা মাড়াননি। ২৬ বছর পর ‘পরাণ’ দেখতে এসে প্রাণ জুড়িয়ে গেছে তাঁর। বলেন, ছবির গল্প ও নির্মাণশৈলী এবং মধুবনের পরিবেশ—সব মিলিয়ে টিকিটের ৩০০ টাকা উশুল হয়েছে।
বগুড়া শহরের সরকারি আজিজুল হক কলেজের ছাত্রী আরেফিন যূথী বলেন, ‘হলে বসে সিনেমা কখনো দেখা হয়নি। বরগুনার কলেজছাত্রী মিন্নি হত্যাকাণ্ড নিয়ে “পরাণ” ছবি নির্মিত হয়েছে জেনে বান্ধবীর সঙ্গে হলে এসেছি। সিনেমার গল্প ও নির্মাণশৈলীতে মুগ্ধ হয়েছি। হলের পরিবেশও খুব ভালো। এখন থেকে নিয়মিত হলে এসে ছবি দেখব।’
বগুড়ার মালতিনগর এলাকার গৃহিণী সানজিদা ইসলাম বলেন, ‘সাদা-কালো যুগে সপরিবার সিনেমা হলে আসার ঐতিহ্য ছিল। অশ্লীল সিনেমা নির্মাণ এবং সিনেমা হল আধুনিকায়নের অভাবে সেই ঐতিহ্য হারাতে বসেছিল। এখন ভালো ছবি নির্মাণ হওয়ায় সুদিন ফিরছে। “পরাণ”-এ মুগ্ধ। আগামী সপ্তাহে “হাওয়া” দেখব।’
এ সময় সিনেমা হলের কাউন্টারের সামনে টিকিট নিয়ে উচ্ছ্বসিত দর্শকদের মধ্যে হুড়োহুড়ির চিত্র দেখা গেল। স্ত্রী মৌটুসীকে নিয়ে ৩০০ টাকার দুটি গোল্ড টিকিট কাটতে কাউন্টারে এসেছিলেন সাজ্জাদ জহির। কাউন্টার থেকে জানানো হয়, টিকিট শেষ, পরের শোতে আসতে হবে। মৌটুসী-সাজ্জাদ দম্পতি ৬০০ টাকায় আগাম টিকিট কেটে হলের বিশ্রামাগারে বসে থাকেন।
হলের টিকিট বিক্রেতা অজিত কুমার বলেন, দীর্ঘদিন পর হলে এমন হাউসফুল দর্শক। উচ্ছ্বাস নিয়ে দর্শকেরা দল বেঁধে হলে আসছেন। পরিপূর্ণ বিনোদনের তৃপ্তি নিয়ে হল থেকে বের হয়ে যাচ্ছেন।
মধুবন সিনেপ্লেক্সের পরিচালক রোহান ইউনুস বলেন, ‘আগামী সপ্তাহে “হাওয়া”তেও হাউসফুল হবে বলে আশা করছি। এভাবে দর্শক হলে ফিরলে খুব শিগগির আমরা সিনেপ্লেক্সে স্ক্রিনের সংখ্যা বাড়াতে পারব।’
‘পরাণ’ ছবিতে প্রধান তিন চরিত্রে অভিনয় করেছেন শরিফুল রাজ, বিদ্যা সিনহা মিম ও ইয়াশ রোহান। এ ছাড়া অভিনয় করেছেন শহীদুজ্জামান সেলিম, রোজী সিদ্দিকী, লুৎফর রহমান জর্জ, রাশেদ মামুন অপু, মিলি বাশারসহ অনেকে।