জীবনের শেষ ৪০ মিনিট, কী হয়েছিল আহমেদ রুবেলের

নিজে গাড়ি চালিয়ে বেলা সোয়া ৫টায় বসুন্ধরা সিটিতে পৌঁছান আহমেদ রুবেল। বেজমেন্টে গাড়ি রেখে হাঁটতে গিয়ে হুট করে পড়ে যান। হাসপাতালে নেওয়ার পর বেলা ৫টা ৫৮ মিনিটে তাঁকে মৃত ঘোষণা করা হয়। রুবেলের জীবনের শেষ ৪০ মিনিটে কী ঘটেছিল?

আহমেদ রুবেলখালেদ সরকার

গাজীপুরের ছায়াবীথির বাড়ি থেকে হাতে সময় নিয়েই বের হয়েছিলেন আহমেদ রুবেল। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় ঢাকার বসুন্ধরা সিটির স্টার সিনেপ্লেক্সে তাঁর ‘পেয়ারার সুবাস’ সিনেমার প্রিমিয়ার শো ছিল।

আহমেদ রুবেলই গাড়ি চালাচ্ছিলেন। পথে উত্তরা থেকে ‘পেয়ারার সুবাস’–এর নির্মাতা নূরুল আলম আতিককে গাড়িতে তুলে নেন; সঙ্গে একজন সহকারী পরিচালকও ছিলেন। যাত্রাপথে অনেকটা খোশমেজাজেই ছিলেন রুবেল।

রাস্তায় তেমন জ্যাম ছিল না; নির্ধারিত সময়ের প্রায় ঘণ্টাখানেক আগে সোয়া ৫টার দিকে বসুন্ধরা সিটিতে পৌঁছান তিনি। গাড়ি থেকে নেমে সহকারী পরিচালক স্টার সিনেপ্লেক্সে চলে যান।

আহমেদ রুবেল
খালেদ সরকার

গাড়ি নিয়ে সোজা বসুন্ধরা সিটির বেজমেন্টে ঢুকলেন রুবেল। গাড়ি পার্ক করে বেজমেন্টের রাস্তা ধরে হাঁটছিলেন। বেজমেন্ট থেকে লিফটে চেপে স্টার সিনেপ্লেক্সে যেতে চেয়েছিলেন। হাঁটতে হাঁটতে লিফট থেকে খানিকটা দূরে হুট করে পড়ে যান রুবেল। পাশের দেয়ালে ধাক্কা লেগে মাথায় আঘাত পান।

পাশে থাকা নির্মাতা আতিক, বেজমেন্টে দায়িত্বরত নিরাপত্তারক্ষী মাসাদুল হকসহ আরও কয়েকজন এগিয়ে আসেন।

আরও পড়ুন

আহমেদ রুবেল দেয়ালের পাশে যে জায়গায় পড়ে গিয়েছিলেন সেই জায়গাটি দেখাচ্ছিলেন মাসাদুল হক। মাসাদুল হক প্রথম আলোকে জানালেন, দেয়ালে লেগে তাঁর কপাল ফুলে যায়। ধরাধরি করে পাশেই একটি চেয়ারে বসান। মাথায় পানি দেন।

‘আমরা ভেবেছিলাম, উনি মাথা ঘুরে পড়ে গেছেন। তাই মাথায় পানি দিচ্ছিলাম। তখন তাঁর জ্ঞান ছিল। বারবার ঢেকুর তুলছিলেন,’ বললেন মাসাদুল।

বসুন্ধরা সিটির প্রথম তলায় জরুরি প্রাথমিক চিকিৎসাকেন্দ্র রয়েছে। ওপর তলা থেকে হুইলচেয়ার আনতে বিলম্ব হচ্ছিল বলে আতিক, মাসাদুলরা পাঁজাকোলা করে রুবেলকে চিকিৎসাকেন্দ্রে নেন।

মাসাদুলের ভাষ্যে, তখনো রুবেলের জ্ঞান ছিল। তবে কথাবার্তা বলছিলেন না। প্রাথমিক চিকিৎসাকেন্দ্রে দায়িত্বরত চিকিৎসক তাঁকে জরুরি ভিত্তিতে হাসপাতালে নেওয়ার পরামর্শ দেন। বেজমেন্ট থেকে গাড়ি বের করতে সময় নষ্ট হবে। গাড়ির অপেক্ষায় না থেকে হুইলচেয়ারে বসিয়ে প্রথম তলা থেকে বসুন্ধরা সিটির নিচে নামানো হয় তাঁকে।

তাঁকে ধরাধরি করে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় তোলা হয়। সিএনজিতে পরিচালক আতিকও ছিলেন। পাশের স্কয়ার হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নেওয়া হয় তাঁকে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে জরুরি বিভাগের এক চিকিৎসক জানান, আহমেদ রুবেলকে বিকেল ৫টা ৫০ মিনিটে হাসপাতালে নেওয়া হয়।

আহমেদ রুবেল
সংগৃহীত
আরও পড়ুন

‘তাঁর পালস ছিল না। ডেড অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়েছিল,’ বলেন সেই চিকিৎসক।

বেলা ৫টা ৫৮ মিনিটে আহমেদ রুবেলকে মৃত বলে ঘোষণা করেন চিকিৎসকেরা। বসুন্ধরা সিটির প্রাথমিক চিকিৎসা কেন্দ্রে রুবেলের জ্ঞান ছিল। বসুন্ধরা সিটি থেকে হাসপাতালে নেওয়ার পথেই মারা গেছেন তিন।

চিকিৎসেকেরা এখনো তাঁর মৃত্যুর কারণ নিশ্চিত হতে পারেননি। তবে ধারণা করছেন, হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়ে রুবেলের মৃত্যু হয়েছে।

আহমেদ রুবেলের মরদেহ তখনো হাসপাতালের জরুরি বিভাগে রাখা ছিল। বোন, ভগ্নিপতিসহ পরিবারের সদস্যদের আহাজারিতে ভারী হয়ে ওঠে পরিবেশ। আহমেদ রুবেলের বাবা আয়েশ উদ্দীনকে এখনো খবরটা জানানো হয়নি।

৮১ বছর বয়সী বাবা কীভাবে সন্তানের শোক সামলাবেন? গাজীপুরের ছায়াবীথির বাড়িতেই রয়েছেন আয়েশ উদ্দীন। বাবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বের হয়েছিলেন রুবেল। সেই বিদায় যে চিরবিদায় হবে, তা কে জানত।

আরও পড়ুন

দুই ভাই ও চার বোনের মধ্যে এক ভাই হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। চার বোনের মধ্যে দুই বোন ঢাকায় থাকেন, দুই বোন থাকেন যুক্তরাষ্ট্রে। আহমেদ রুবেলের স্ত্রীর নাম মনোয়ারা বেগম। রুবেল–মনোয়ারা দম্পতির কোনো সন্তান নেই।

পরিচালক আতিক বলেন, ‘তিনি (রুবেল) এভাবে চলে যাবেন, ভাবতেও পারিনি।’ কথা বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন এই পরিচালক।

আহমেদ রুবেলের এমন আকস্মিক মৃত্যুতে শোকস্তব্ধ হয়ে পড়েছেন তাঁর দীর্ঘদিনের সহকর্মীরা। তাঁকে শেষবারের মতো দেখতে নির্মাতা প্রসূন রহমান, মাতিয়া বানু শুকু, অভিনেত্রী জাকিয়া বারী মমসহ অনেকে হাসপাতালে ভিড় করেন।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নাসির উদ্দিন ইউসুফ, শিমুল ইউসুফ, চঞ্চল চৌধুরী, নির্মাতা রেদওয়ান রনি, প্রযোজক শাহরিয়ার শাকিল, অভিনয়শিল্পী মেহজাবীন চৌধুরী, শাহেদ আলী, ভাবনা, সোহেল মন্ডল, নাজিফা তুষিসহ আরও অনেকে শোক জানিয়েছেন।

আহমেদ রুবেলের মরদেহ কাল বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ১০টা থেকে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত শিল্পকলা একাডেমি প্রাঙ্গণে রাখা হবে। আসরের পর গাজীপুর কবরস্থানে সমাহিত করা হবে তাঁকে।

‘পেয়ারার সুবাস’ সিনেমার পোস্টার। ছবি : ফেসবুক থেকে

আহমেদ রাজিব রুবেল ওরফে আহমেদ রুবেল ১৯৬৮ সালের ৩ মে চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের রাজারামপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। স্ত্রীসহ পরিবারের সঙ্গে ঢাকার গাজীপুরে স্থায়ীভাবে বসবাস করছিলেন।

সেলিম আল দীনের ‘ঢাকা থিয়েটার’ থেকে আহমেদ রুবেলের অভিনয়ে হাতেখড়ি। আহমেদ রুবেল অভিনীত প্রথম নাটক গিয়াসউদ্দিন সেলিমের ‘স্বপ্নযাত্রা’। এ ছাড়া ‘বনপাংশুল’, ‘যৈবতী কন্যার মন’, ‘হাতহদাই’, ‘মার্চেন্ট অব ভেনিস’ নাটকে বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেন তিনি।

এরপর তিনি হুমায়ূন আহমেদের ঈদনাটক ‘পোকা’য় অভিনয় করেন। যেখানে তাঁর অভিনীত ‘ঘোড়া মজিদ’ চরিত্রটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। ২০০৫ সাল থেকে টেলিভিশন নাটকে নিয়মিত অভিনয় করতেন। তাঁর অভিনীত উল্লেখযোগ্য নাটকগুলো—‘অতিথি’, ‘নীল তোয়ালে’, ‘বিশেষ ঘোষণা’, ‘প্রতিদান’, ‘নবাব গুন্ডা’, ‘এফএনএফ’।

আহমেদ রুবেল ১৯৯৩ সালে ‘আখেরী হামলা’ সিনেমার মধ্য দিয়ে রুপালি পর্দায় (চলচ্চিত্রে) পা রাখেন। পরে তিনি অভিনয় করেছেন ‘চন্দ্রকথা’, ‘ব্যাচেলর’, ‘শ্যামল ছায়া’, ‘গেরিলা’ ইত্যাদি সিনেমায়।

২০১৪ সালে ভারতের নির্মাতা সঞ্জয় নাগ পরিচালিত সিনেমা ‘পারাপার’–এর প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন তিনি।