এ বছর দেশের প্রেক্ষাগৃহে মোট ৪১টি ছবি মুক্তি পেয়েছে। বছরের মাঝামাঝি কয়েক মাস রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে সিনেমা মুক্তি বন্ধ ছিল, শেষ কয়েক মাসে এসে আবার প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেয়েছে বেশ কয়েকটি সিনেমা। দেখে নেওয়া যাক প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পাওয়া সিনেমা দিয়ে আলোচনায় ছিলেন কোন ৮ পরিচালক (সিনেমা মুক্তির সময় অনুয়ায়ী)
গিয়াস উদ্দিন সেলিম, ‘কাজলরেখা’
চঞ্চল চৌধুরী ও ফারহানা মিলিকে জুটি করে ‘মনপুরা’ বানিয়ে হইচই ফেলে দিয়েছিলেন গিয়াস উদ্দিন সেলিম। এরপরই ‘কাজলরেখা’ ছবিটি নির্মাণের উদ্যোগের কথা জানিয়েছিলেন এই পরিচালক। শেষমেশ দর্শকের কাছে এ বছরে পৌঁছে গেছে ছবিটি। দর্শকমহলে সাড়াও পড়েছে বেশ। পরিচালক সেলিমের মতে, দর্শক উপভোগ করছেন সিনেমাটি। এটাই তাঁর বড় প্রাপ্তি। ছবিটি যখন প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শিত হচ্ছিল, তখনই খবর আসে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে মাস্টার্সের কোর্স হিসেবে ‘কাজলরেখা’ সিনেমাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বছরের শেষ দিকে এসে জানা যায়, নেদারল্যান্ডসের রটারডেম চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হবে ‘কাজলরেখা’। বিশ্বের অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ এই উৎসবের লাইমলাইট বিভাগে এটি নির্বাচিত হয়েছে। ৪০০ বছর আগের বাংলার রূপকথা ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’র ‘কাজলরেখা’ অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে নিরীক্ষাধর্মী এ চলচ্চিত্র। দেশে এটি মুক্তি পায় গত ১১ এপ্রিল। চলচ্চিত্রটি নিয়ে কারও মত ছিল এ রকম, আমাদের দেশে লোককথাভিত্তিক চলচ্চিত্র একসময় জনপ্রিয় ছিল। ‘রূপবান’, ‘সাত ভাই চম্পা’ বা ‘বেদের মেয়ে জোস্না’র অকল্পনীয় সাফল্য তা-ই বলে। কিন্তু সিনেমা ইদানীং শুধুই শহুরে মধ্যবিত্তের। গিয়াস উদ্দিন সেলিম পরিচালিত ‘কাজলরেখা’ বহুদিন পর মাটির গন্ধে ভরা গল্পের স্মৃতি ফিরিয়ে আনল। ছবিটি নির্মাণ–মুনশিয়ানার কারণে বছরজুড়ে আলোচনায় ছিলেন গিয়াস উদ্দিন সেলিম।
হিমেল আশরাফ, ‘রাজকুমার’
আগের বছরের সবচেয়ে আলোচিত ও ইন্ডাষ্ট্রি হিট ‘প্রিয়তমা’ পরিচালক এ বছরেও এসেছিলেন তাঁর নতুন সিনেমা নিয়ে। ‘রাজকুমার’ ছবিটি বছরের শুরুতে পবিত্র ঈদুল ফিতরে মুক্তি পায়। শৈশবে হারিয়ে ফেলা মাকে খুঁজতে পাবনার এক যুবকের যুক্তরাষ্ট্রযাত্রা ও করুণ পরিণতির গল্পে নির্মিত হয় ‘রাজকুমার’। এ ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেন শাকিব খান। আরও ছিলেন মার্কিন অভিনেত্রী কোর্টনি কফি, মাহিয়া মাহি, আরশ খান, তারিক আনাম খান প্রমুখ। মুক্তির পর ‘রাজকুমার’ দেশ-বিদেশে প্রশংসিত হয়, একই সঙ্গে শাকিবের অভিনয়ে মুগ্ধ হন দর্শকেরা। পরিচালক হিমেল আশরাফ আগে শাকিব খানকে নিয়ে একই প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের ব্যানারে বানিয়েছিলেন ‘প্রিয়তমা’। দুটি গান, মেকআপ আর কাস্টিংয়ের বদৌলতে সে ছবি বাণিজ্যিকভাবে সফল হয়েছে দেশে-বিদেশে। তবে পূর্ণাঙ্গ ছবি হিসেবে ‘প্রিয়তমা’র গাঁথুনির দুর্বলতার কথা বলেছিলেন কেউ কেউ। তখন কেউ কেউ এ–ও বলেছিলেন, শক্তিশালী টিম নিয়ে কোচ গেছেন ভিন্ন পরিবেশে, অপ্রচলিত মাঠে খেলতে। ‘রাজকুমার’-এর ক্ষেত্রে বিষয়টা অন্য রকম, সেই তাঁদেরই বক্তব্য এবার ছিল এ রকম, মাঠে সেরা দলটাকে নিয়ে নেমেছেন কোচ। যার ফলে সফলও হয়েছেন। মূলধারার বাণিজ্যিক ছবি বললেই যেসব ছবি ফুটে ওঠে, ২ ঘণ্টা ২৫ মিনিটের ‘রাজকুমার’ও আদতে তার সঙ্গে মিলে যায়।
মোস্তফা কামাল রাজ, ‘ওমর’
নাটক নির্মাতা মুহাম্মদ মোস্তফা কামাল রাজ ২০১১ সাল থেকে চলচ্চিত্র বানাচ্ছেন। ‘প্রজাপতি’ ছিল তাঁর পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্র। এরপর তিনি ‘ছায়া–ছবি’, ‘তারকাঁটা’, ‘সম্রাট’, ‘যদি একদিন’ বানান। যদিও ‘ছায়া-ছবি’ মুক্তি পায়নি। ২০১৮ সালে ‘যদি একদিন’ বানোর পর ৫ বছরের বিরতি ছিল। এ বছরে তাঁর বানানো ‘ওমর’ প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায়। রাজের বানানো এ ছবি নিয়ে ছিল প্রশংসা। নির্মাণের প্রশংসার পাশাপাশি অভিনয়শিল্পী বাছাইয়েও সুবিচার করেছেন রাজ—এমনটাই মত দিয়েছেন চলচ্চিত্র–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। কারও মতে, রাজ তাঁর আগের বানানো সব ছবিকে ছাপিয়ে গেছেন ‘ওমর’ দিয়ে। একটি খুন ও প্রতিশোধের গল্পে বাংলাদেশেও যে টান টান উত্তেজনার গল্পনির্ভর থ্রিলার সিনেমা বানানো যায়, তারই প্রমাণ দিয়েছে ‘ওমর’। সিনেমাটি যাঁরা দেখেছেন, একবাক্যে বলেছেন, বাংলাদেশের গল্পে নতুন স্বাদের থ্রিলার গল্প উপভোগ করেছেন। এ কারণে মোস্তফা কামাল রাজের ‘ওমর’ ছিল আলোচনায়।
মিশুক মনি, ‘দেয়ালের দেশ’
পবিত্র ঈদুল ফিতরের আরেক সিনেমা ‘দেয়ালের দেশ’। নবীন নির্মাতা মিশুক মনির পরিচালিত সরকারি অনুদানে নির্মিত এ সিনেমায় অভিনয় করেছেন শরীফুল রাজ ও বুবলী। মুক্তির আগে সিনেমাটির টিজার প্রকাশের পর ব্যাপক আলোচনা তৈরি করে। মর্গের ডোম ও প্রেমিকার লাশের অন্য রকম প্রেমকাহিনি দর্শকদের আলাদা ধরনের ভালো লাগা উপহার দেয়। এ কারণে ‘দেয়ালের দেশ’ মুক্তির পর আলোচনা তৈরি করে। এ ছাড়া এ ছবির গানও ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়।
রায়হান রাফী, ‘তুফান’
মূলধারার বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রে এ বছরে পরিচালক রায়হান রাফী তাঁর অবস্থান আরও শক্ত করেছেন। ‘তুফান’ পরিচালনা করে দেশ–বিদেশে হইচই ফেলে দেন। তাঁর পরিচালিত ছবিটির ব্যবসায়িক সাফল্যও ছিল অন্যদের তুলনায় ঈর্ষণীয়। পবিত্র ঈদুল আজহা উপলক্ষে এ বছরের ১৭ জুন মুক্তি পায় ‘তুফান’, যা বছরের সবচেয়ে আলোচিত ও ইন্ডাস্ট্রি হিট সিনেমার তকমা পায়। ছবিটির নাম ভূমিকায় ছিলেন ঢাকাই ছবির শীর্ষ নায়ক শাকিব খান। ছবিতে শাকিব খানকে একেবারে নতুন রূপে উপস্থাপন করেন পরিচালক রাফী। শাকিবের দ্বৈত চরিত্র দর্শককে প্রেক্ষাগৃহে ভিন্ন রকম স্বাদ দিয়েছে। ছবিটির ফার্স্ট লুক পোস্টার প্রকাশের পর থেকে শুরু করে মুক্তি এবং বছর শেষ পর্যন্ত কোনো না কোনোভাবে ছিল আলোচনায়। সিঙ্গেল স্ক্রিনে টানা দুই মাস সিনেমাটি হাউসফুল গেছে। সিনেপ্লেক্সে প্রদর্শনীর বিচারে ‘তুফান’কে হলিউড-বলিউডের সিনেমার রেকর্ড ব্রেক করে ‘নাম্বার ওয়ান’ তকমা দিয়েছে। শাকিব খান ছাড়া ‘তুফান’ ছবিতে অভিনয় করেছেন চঞ্চল চৌধুরী, নাবিলা ইসলাম, মিমি চক্রবর্তী। ছবিটি প্রযোজনায় ছিল আলফা আই ও এসভিএফ এন্টারটেইনমেন্ট লিমিটেড। ‘তুফান’-এর ব্যবসায়িক সাফল্যে প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান মুক্তির পরই জানিয়েছে যে তারা আরও বড় পরিসরে ‘তুফান ২’ নির্মাণ করবে। ছবিটি রায়হান রাফিকে আলোচনায় রেখেছে।
অনন্য মামুন, ‘দরদ’
বছরের শুরুতে মুক্তির কথা ছিল অনন্য মামুনের ‘দরদ’। ছবিটি শুটিংয়ের শুরুর সময় থেকে আলোচনায় ছিল। কারণ, এ ছবিতে শাকিব খানের বিপরীতে অভিনয় করেছিলেন বলিউডের সোনাল চৌহান। শুটিং ও শুটিং–পরবর্তী সময়ে পরিচালকের অতিকথনেও ছবিটি বছরজুড়ে আলোচনায় ছিল। ভার্চ্যুয়াল মিডিয়ায় ছবিটি ও পরিচালক চর্চার বিষয় ছিল। বছরের শেষ দিকে নভেম্বরে এসে মুক্তি পায় ছবিটি। ‘দরদ’ নিয়ে আলোচনা অনেক বেশি হলেও মুক্তির পর ছবিটি সেভাবে সাড়া জাগাতে পারেনি; যদিও মুক্তির প্রথম দুই দিন ব্যবসায়িকভাবে ভালোই সফলতা দেখিয়েছে। ছবিটি নিয়ে পরিচালক অনন্য মামুনের অতিকথন দর্শকদের মধ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, ‘৮৪০’
চলতি মাসে প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পাওয়া ফারুকীর আরেকটি সিনেমা ‘৮৪০’ নিয়েও কথা হয়েছে। রাজনৈতিক স্যাটায়ার নিয়ে নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর ফেরা; চলচ্চিত্রটি প্রযোজনা করছেন নুসরাত ইমরোজ তিশা; ‘মেয়র ডাবলু’ চরিত্রে নাসির উদ্দিন খানের অভিনয়—সব মিলিয়ে দর্শকের সামনে এসেছে ‘৮৪০’ ওরফে ‘ডেমোক্রেসি প্রাইভেট লিমিটেড’। এটি নানা কারণে আলোচনায়। ২০০৭ সালে মোস্তফা সরয়ার ফারুকী নির্মিত নাটক ছিল ‘৪২০’। সে সময় দর্শকদের মধ্যে এটি ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল। এবার এল ‘৪২০’-এর ডাবলআপ ‘৮৪০’ সিনেমা। রাজনৈতিক বিদ্রূপাত্মক এ সিনেমায় বাস্তব সময়ে প্রতিফলন থাকায় পছন্দ করেছেন দর্শকেরা।
শঙ্খ দাশগুপ্ত: ‘প্রিয় মালতী’
বছরের শেষে ডিসেম্বর মাসে প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেয়েছে ‘প্রিয় মালতী’ সিনেমাটি। প্রথম সিনেমা দিয়েছেই প্রশংসা কুড়িয়েছেন ‘বলী’, ‘গুটি’ নির্মাতা শঙ্খ। গুরুত্বপূর্ণ একটি গল্পকে দারুণভাবে পর্দায় হাজির করেছেন তিনি। পর্দায় মেহজাবীনের অসাধারণ অভিনয় আর শঙ্খর নির্মাণগুণে ‘প্রিয় মালতী’ হয়ে উঠেছে বছরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সিনেমা। এ সিনেমার সিনেমাটোগ্রাফি, আবহসংগীতও প্রশংসিত হযেছে। প্রেক্ষাগৃহে মুক্তির আগে বিদেশের উৎসবে প্রদর্শিত হয়েছে সিনেমাটি।