বাংলাদেশের কোনো সিনেমা দেখতে কলকাতার দর্শকেরা হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন—এমন দৃশ্যের গত কয়েক দশকেও দেখা মেলেনি। আশি–নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশি সিনেমার বেশ কদর ছিল কলকাতায়। পরের কয়েক দশকে ঢাকাই সিনেমার সঙ্গে কলকাতার দর্শকদের সম্পর্কে খানিকটা ছেদ পড়ে। মেজবাউর রহমান সুমনের হাওয়া যেন পুরোনো সেই স্মৃতি উসকে দিল। কলকাতায় চলছে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উৎসব। নন্দনে সিনেমাটি দেখতে দূরদূরান্ত থেকে ছুটে এসেছেন দর্শকেরা।
নন্দন ঘুরে দেখা গেছে, হলের দ্বার খোলার আগেই সকাল থেকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকেছেন দর্শকেরা। রোদ মাথায় নিয়ে, ভিড় ঠেলে অনেকে ঢুকলেও সিট পাননি, মেঝেতে বসেই সিনেমাটি দেখেছেন। শো শুরু হওয়ার পরও হলের বাইরে পাঁচ শতাধিক দর্শক ভিড় করেছেন। ‘সাদা সাদা কালা কালা’ গানে মুখর হয়ে উঠেছে নন্দন চত্বর।
বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ও কলকাতার বাংলাদেশ উপহাইকমিশনের ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশের ৩৭টি চলচ্চিত্র নিয়ে গত শনিবার শুরু হয়েছে এ উৎসব। শুরুতে উৎসবে হাওয়ার চারটি শো ছিল, দর্শকের বিপুল আগ্রহে আরও দুটি শো বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন আয়োজকেরা। পূর্বনির্ধারিত সূচি অনুযায়ী আগামীকাল উৎসব শেষ হবে কিন্তু হাওয়া নিয়ে দর্শকের আগ্রহ বিবেচনা করে আগামী বৃহস্পতিবার পর্যন্ত শো চালিয়ে যাওয়া যায় কি না, তা নিয়ে আলোচনা চলছে।
‘হাওয়া’ নিয়ে আগ্রহ কেন
উৎসবে অন্য বাংলাদেশি সিনেমা ছাপিয়ে হাওয়া দেখার জন্য ভারতীয় দর্শকেরা আগ্রহী হয়ে উঠছেন কেন? উত্তর চব্বিশ পরগনা থেকে আসা অভিজিত মুখোপাধ্যায় নামের এক দর্শক প্রথম আলোকে বলেন, ‘“সাদা সাদা কালা কালা” গানটি ভাইরাল হওয়ার পর হাওয়া সিনেমার নাম জেনেছি। তখন থেকেই দেখার জন্য আগ্রহী হই। নন্দনে চলছে শুনেই দেখতে চলে এলাম।’
অতনু মিত্র নামের আরেক দর্শক বলেন, ‘ভারতে চঞ্চল চৌধুরীর একটি দর্শকশ্রেণি আছে। তাঁর নাটক আমরা নিয়মিত দেখি। চঞ্চল আছেন জেনেই সিনেমাটি দেখতে এসেছি। শো শেষে তাঁকে সামনাসামনি দেখলাম। এটা আমার জীবনের স্মরণীয় স্মৃতি।’
কলকাতায় হাওয়া নিয়ে বন্দনার মধ্যে অভিনেত্রী শুভশ্রী গাঙ্গুলিকে নিয়ে ছবিটি দেখেছেন তাঁর স্বামী পরিচালক রাজ চক্রবর্তী। চঞ্চল চৌধুরীর সঙ্গে তোলা একটি ছবি পোস্ট করে ফেসবুকে রাজ লিখেছেন, ‘হাওয়া দেখে মুগ্ধ। অসাধারণ অভিনয়, ক্যামেরা, ডিরেকশন এবং যার কথা সবচেয়ে বেশি বলতে হয়, চঞ্চল চৌধুরী। তিনি এলেন, অভিনয় করলেন এবং জয় করে নিলেন আমাদের মন।’
কলকাতার দর্শকদের উন্মাদনায় মুগ্ধ চঞ্চল চৌধুরী, উৎসবের শুরু থেকেই শহরটিতে আছেন তিনি। দর্শকদের সঙ্গে তিনিও হাওয়া উপভোগ করছেন, অভিজ্ঞতা বিনিময় করছেন। চঞ্চল চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘হাওয়া মুক্তির পর বাংলাদেশে যেমন দর্শকদের মধ্যে আগ্রহ দেখেছি, কলকাতায়ও তেমন দেখছি। এটি আমাদের জন্য ভালো লাগার।’
হাওয়া নিয়ে কলকাতার দর্শকদের উন্মাদনা প্রসঙ্গে চঞ্চল বলেছেন, ‘সিনেমাটি বাংলাদেশে খুব আলোচিত হয়েছে, দেশের বাইরেও প্রশংসিত হয়েছে। এই বিষয়গুলো গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে জেনে গেছেন। সেই কারণেই হয়তো দর্শকেরা ভিড় করছেন।’
ভিড় সামলাতে হিমশিম
ভারতীয় গণমাধ্যমগুলো বলছে, সিনেমার জন্য নন্দনে এমন ভিড় দেখা যায়নি। ভিড় সামলাতে হিমশিম নন্দন কর্তৃপক্ষ স্থানীয় পুলিশের সাহায্য নিয়েছে। টিকিট নয়, আগে এলে আগে পাবেন ভিত্তিতে সিনেমা দেখার সুযোগ পাচ্ছেন দর্শকেরা। অনেকে দুপুরের শো দেখার জন্য ভোর থেকে এসে সারিতে দাঁড়িয়েছেন। ‘সিনে মে সিনেমা’ নামের একটি ফেসবুক গ্রুপে স্বর্ণাভ মজুমদার নামের এক দর্শক লিখেছেন, ‘সামনে লম্বা লাইন, হাওয়া গরম। আমি আর আমার এক বন্ধু দাঁড়িয়ে পড়লাম। এই না হলে চলচ্চিত্র উৎসব? টিকিট কেটে হলে ঢুকে দেখে নিলে এই রোমাঞ্চটা অনুভব করা হতো কি? সাড়ে তিন ঘণ্টা অপেক্ষার পর যখন দুটো সিট দখল করতে পারলাম, উফ! সে এক বন্য আনন্দ।’ আগামীকাল নন্দনে হাওয়ার দুটি শো রয়েছে।
হলে মুক্তির দাবি
ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকেও সিনেমাটি দেখতে না পেরে অনেক দর্শক কলকাতার সিনেমা হলে হাওয়া মুক্তির দাবি তুলেছেন। অমর চক্রবর্তী নামের এক দর্শক বলেছেন, ‘বহু দর্শক সিনেমাটি না দেখে ফিরে গেছেন। পরদিন আবার সারিতে দাঁড়ালেও ঢুকতে পারছেন না। হলে সিনেমাটি মুক্তি দেওয়া হোক। আমরা টিকিট কেটেও দেখব।’
হাওয়া কলকাতায় মুক্তি দেওয়ার কোনো পরিকল্পনা আছে—এমন প্রশ্নের জবাবে মেজবাউর রহমান সুমন প্রথম আলোকে জানালেন, সাফটা চুক্তির আওতায় আরেকটি ছবি আমদানি করে হাওয়া পশ্চিমবঙ্গে মুক্তি দেওয়া কঠিন। তারপরও কলকাতার দর্শকদের আগ্রহের কথা বিবেচনা করে সেখানে সিনেমাটি মুক্তি দেওয়ার পরিকল্পনা করেছেন তাঁরা।