চলচ্চিত্র পুরস্কারের প্রথম আসর বসেছিল বঙ্গভবনে
১৯৭৬ সালের ২৪ মার্চ বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। আজকের এই দিনে প্রথম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ঘোষণা করে সরকার। পুরস্কার ঘোষণার ৪৮ বছর পূর্তি উপলক্ষে এই প্রতিবেদন।
১৯৭৬ সালের ৪ এপ্রিল। বঙ্গভবনে ছিল সাজ সাজ রব। বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার দেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম। ফলে আয়োজনের কোনো খামতি ছিল না।
এই জমকালো আয়োজনে রোশনাই ছড়িয়েছেন ঢাকাই চলচ্চিত্রের শীর্ষ তারকারা। আমন্ত্রিত অতিথিদের তালিকায় তিন বাহিনীর প্রধানসহ আরও অনেকেই ছিলেন।
এর আগে ২৪ মার্চ পুরস্কার ঘোষণা করেন তথ্যসচিব এ বি এম গোলাম মোস্তফা; প্রথম বাংলাদেশ জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার কমিটির চেয়ারম্যানও ছিলেন তিনি।
১৯৭৬ সালের ২৪ মার্চ প্রথম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ঘোষণা করেন তথ্যসচিব এ বি এম গোলাম মোস্তফা; প্রথম বাংলাদেশ জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার কমিটির চেয়ারম্যানও ছিলেন তিনি।
১৯৭৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমার নির্মাতা, শিল্পী ও কলাকুশলীদের ১২ শাখায় মোট ১৩ জনকে পুরস্কারের ঘোষণা দেওয়া হয়।
বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) বরাতে পরদিন ২৫ মার্চ খবরটি দৈনিক বাংলা, দৈনিক ইত্তেফাক, সংবাদসহ বেশ কয়েকটি সংবাদপত্র গুরুত্বসহকারে প্রকাশ করে।
এ বি এম গোলাম মোস্তফাকে উদ্ধৃত করে দৈনিক বাংলা লিখেছে, ভালো ও উন্নতমানের ছবি নির্মাণে উৎসাহ জোগানো ও কোনো বিশেষ চলচ্চিত্রে বিশেষ নির্মাণকুশলতার স্বীকৃতি দিতে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রবর্তন করা হয়েছে।
১৯৭৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমার নির্মাতা, শিল্পী ও কলাকুশলীদের ১২ শাখায় মোট ১৩ জনকে পুরস্কারের ঘোষণা দেওয়া হয়।
১৯৭৫ সালে বেবী ইসলামের ‘চরিত্রহীন’, নারায়ণ ঘোষ মিতার ‘লাঠিয়াল’, খান আতাউর রহমানের ‘সুজন সখী’, মোহসীনের ‘বাঁদী থেকে বেগম’, আলমগীর কবিরের ‘সূর্য কন্যা’—এর মতো হিট সিনেমা মুক্তি পায়।
এর মধ্যে ‘লাঠিয়াল’ সিনেমাকে ১৯৭৫ সালের সেরা সিনেমা হিসেবে নির্বচন করেন বিচারকেরা। সিনেমাটি পরিচালনার পাশাপাশি প্রযোজনাও করেছেন মিতা। সেরা সিনেমা, সেরা সেরা পরিচালক, সেরা অভিনেতাসহ সর্বোচ্চ পাঁচটি পুরস্কার পায় সিনেমাটি।
১৯৭৫ সালে বেবী ইসলামের ‘চরিত্রহীন’, নারায়ণ ঘোষ মিতার ‘লাঠিয়াল’, খান আতাউর রহমানের ‘সুজন সখী’, মোহসীনের ‘বাঁদী থেকে বেগম’, আলমগীর কবিরের ‘সূর্য কন্যা’—এর মতো হিট সিনেমা মুক্তি পায়।
‘লাঠিয়াল’–এ মূল চরিত্রে অভিনয়ের জন্য সেরা অভিনেতা হয়েছেন আনোয়ার হোসেন। সেরা অভিনেতার দৌড়ে আনোয়ারের সঙ্গে আরও ছিলেন রাজ্জাক, বুলবুল আহমেদ। ‘সুজন সখী’ সিনেমায় ‘সুজন’ চরিত্রে অনবদ্য অভিনয়ের জন্য তরুণ অভিনেতা ফারুকের জোরালো সম্ভাবনাও দেখছিলেন কেউ কেউ। তবে সেরা অভিনেতার পুরস্কার মেলেনি ফারুকের; ‘লাঠিয়াল’ সিনেমার জন্য সেরা পার্শ্ব অভিনেতার পুরস্কারেই সন্তুষ্ট থাকতে হয় তাঁকে।
অভিনেতাদের লড়াইটা হাড্ডাহাড্ডি হলেও অভিনেত্রীর লড়াইয়ে ছিলেন দুজন; ববিতা ও কবরী। ‘বাঁদী থেকে বেগম’ সিনেমায় এক কোচওয়ান পরিবারে বেড়ে ওঠা জমিদারের কন্যা ‘চাঁদনী’ চরিত্রে অভিনয় করে দর্শকের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছিলেন ববিতা। সেই চরিত্রই তাঁকে সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার এনে দিয়েছে। ‘লাঠিয়াল’–এও দেখা গেছে তাঁকে। পুরস্কার না পেলেও ‘সুজন সখী’ সিনেমার ‘সখী’ কবরীর অভিনয় দর্শকের হৃদয়ে দাগ কেটেছে।
চলচ্চিত্রের মাধ্যমে দেশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে অবদান রাখার জন্য চলচ্চিত্রকার জহির রায়হানকে একটি বিশেষ পুরস্কারের ঘোষণা দেওয়া হয়।
এই বছর নূন্যতম মানের অভাবে সংলাপ, গীত রচনা, শব্দগ্রহণ, চিত্রগ্রহণ (রঙিন) ও শিল্পনির্দেশনার মতো ক্ষেত্রে পুরস্কার দেওয়া হয়নি।
১৯৭৬ সালের ৪ এপ্রিল বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার তুলে দেন রাষ্ট্রপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম।
এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ
৪ এপ্রিল বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার তুলে দেন রাষ্ট্রপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম। বিজয়ীদের প্রত্যেকের জন্য ছিল ‘কলসি কাঁখে পল্লিবধূ’র আদলে সোনালি স্মারক। সেরা সিনেমা ও সেরা পরিচালকের জন্য ছিল ২৫ হাজার টাকা পুরস্কার। দুই পুরস্কার বাবদ ৫০ হাজার টাকা ও সোনালি স্মারক পুরস্কার পেয়েছিলেন ‘লাঠিয়াল’ নির্মাতা ও প্রযোজক মিতা।
পরদিন ৫ এপ্রিল সংবাদ’র প্রথম পৃষ্ঠায় এক কলামে ‘রাষ্ট্রপতি চলচ্চিত্র পুরস্কার দিলেন’ শিরোনামে একটি খবর প্রকাশিত হয়।
পুরস্কার লাভের পর আমার দায়িত্ব আরও বেড়ে গেল। আনোয়ার পুরস্কার লাভে আনন্দিত হয়েছেন আর ববিতা ভীষণ খুশি।নারায়ণ ঘোষ মিতা, পরিচালক
সেরা সিনেমা ‘লাঠিয়াল’ নিয়ে সেই প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘লাঠিয়াল একটি ব্যতিক্রমধর্মী প্রয়াস। চর এলাকার জীবনকেন্দ্রিক এই কাহিনিচিত্রে পূর্বাপর এক পরিচ্ছন্ন বক্তব্য ও রুচিশীল উপস্থাপনা লক্ষ করা যায়।’
সিনেমাটির প্রযোজক ও পরিচালক মিতা তাঁর প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘পুরস্কার লাভের পর আমার দায়িত্ব আরও বেড়ে গেল। আনোয়ার পুরস্কার লাভে আনন্দিত হয়েছেন আর ববিতা ভীষণ খুশি।’
পুরস্কার বিতরণী আয়োজনে প্রায় সবাই রাষ্ট্রপতির হাত থেকে পুরস্কার নেন। তবে প্রয়াত জহির রায়হানের পরিবারের কোনো সদস্য ছিলেন না। প্রয়াত গায়ক আবদুল আলীমের পুরস্কার গ্রহণ করেন জমিলা আলীম।
এই পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন তৎকালীন সেনাবাহিনীর প্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান, নৌবাহিনীর প্রধান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম এইচ খান, বিডিআর (এখন বিজিবি) প্রধান মেজর জেনারেল কাজী গোলাম দাস্তগীর। অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন মন্ত্রী পরিষদ বিভাগের সচিব শফিউল আলম।
পুরস্কারের তালিকা
শ্রেষ্ঠ ছায়াছবি: লাঠিয়াল
শ্রেষ্ঠ পরিচালক: নারায়ণ ঘোষ মিতা (লাঠিয়াল)
শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকার: খান আতাউর রহমান (সুজন সখী)
শ্রেষ্ঠ অভিনেতা: আনোয়ান হোসেন (লাঠিয়াল)
শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী: ববিতা (বাঁদী থেকে বেগম)
শ্রেষ্ঠ পার্শ্ব অভিনেতা: ফারুক (লাঠিয়াল)
শ্রেষ্ঠ পার্শ্ব অভিনেত্রী: রোজী (লাঠিয়াল)
শ্রেষ্ঠ সংগীত পরিচালক (যুগ্মভাবে) : দেবু ভট্টাচার্য ও লোকমান হোসেন ফকির (চরিত্রহীন)
শ্রেষ্ঠ গায়ক: আবদুল আলীম (সুজন সখী)
শ্রেষ্ঠ গায়িকা: সাবিনা ইয়াসমীন (বিভিন্ন চলচ্চিত্রের গানের জন্য)
শ্রেষ্ঠ চিত্রগ্রাক (সাদা কালো) : বেবী ইসলাম (চরিত্রহীন)
বিশেষ পুরস্কার: জহির রায়হান