বন্ধুদের সঙ্গে ব্যক্তিগত ভিডিও প্রকাশই কি কাল হলো পরী-রাজের সংসারে
২০২১ সালের কথা। নানা ঘটনায় বিনোদন অঙ্গনে পরীমনি তখন বেশ আলোচিত। অন্যদিকে শরিফুল রাজ ‘পরাণ’ মুক্তির সাফল্যে উড়ছিলেন। এর মধ্যেই পরী ও রাজের পরিচয়। সূত্রপাত নির্মাতা গিয়াসউদ্দিন সেলিম পরিচালিত সিনেমা ‘গুণিন’। তারপর দ্রুত সময়ে দুজনের প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়া। অল্প কয়েক দিন প্রেম করার সুযোগ পেয়েছিলেন পরীমনি ও শরিফুল রাজ। সিনেমার শুটিং করতে গিয়ে প্রেম। সিনেমা মুক্তির আগে বিয়ে ও সন্তান আগমনের খবর। পরীমনি ও রাজের জীবনটাই পুরোপুরি সিনেমার গল্পের মতো। সব কিছু ঠিকঠাক চলছিল। ঘুরাফেরা। আড্ডাবাজি। হইহুল্লোড় করে দিন পার করা। পরীমনির সঙ্গে হাত ধরাধরি করে আদালত চত্বরে রাজের যাওয়া। এ যেন একে অন্যের জন্য জান হাজির।
বছর ঘুরতে না ঘুরতেই যেন দৃশ্যপট বদলে যেতে লাগল। আস্তে আস্তে পরীমনি ও রাজের তিক্ততার খবর চাউর হতে থাকে। ইঙ্গিতপূর্ণ ফেসবুক পোস্টে দুজনের সম্পর্কের অবণতির আভাস মিলতে থাকে। এ বছরের মে মাসে সম্পর্কের অবণতি চরম আকার ধারণ করে। পরীমনি ও শরিফুল রাজ দুজনে দুজনকে নিয়ে নানা অভিযোগ সামনে নিয়ে আসে। কেউ সরাসরি বলেছেন, কেউবা ইঙ্গিতে। তাতে মোটামুটি স্পষ্ট হয়ে যায়, পরী ও রাজের বিচ্ছেদ এখন শুধু সময়ের ব্যাপার।
মে মাসের পর অবশ্য দুজনে এক হওয়ার আভাস দিয়েছিলেন। কিন্তু তা বেশিদিন স্থায়ী হতে দেননি। আবারও তাঁদের কাযর্ক্রমে বোঝা যায়, এই সম্পর্ক আর জোড়া লাগার নয়। একসঙ্গে পথচলার মতো অবস্থায় তাঁরা নেই। দুজনেই যেন একটা ‘নিরাপদ বিচ্ছেদ’ খুঁজছিল। ১৮ সেপ্টেম্বর পরীমনির তালাকের নোটিশ ইস্যুর পর রাজের মন্তব্য ছিল, আলহাদুলিল্লাহ কবুল, এটি বলায় তা যেন আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
এ বছরের মে মাসে চিত্রনায়ক শরীফুল রাজের ফেসবুক থেকে কয়েকটি স্থিরচিত্র ও ভিডিও প্রকাশ পায়। সেখানে অভিনেত্রী সুনেরাহ বিনতে কামাল একটি ভিডিওতে দেখা যায়, রাজের সঙ্গে সুনেরাহর বন্ধুত্বপূর্ণ ও ‘অসংলগ্ন’ কিছু আলাপচারিতা চলছে। সেগুলো রাজের ফেসবুক থেকে সামাজিক মাধ্যমে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এ নিয়ে নেটিজেনদের মধ্যে শুরু হয়েছে সমালোচনা। অন্য ভিডিওতে শরিফুল রাজের সঙ্গে নাজিফা তুষি ও তানজিন তিশাকেও দেখা যায়। এসব ভিডিও মোটেও ভালোভাবে নেননি পরীমনি। এরপর সুনেরাহ ও তানজিন তিশার পক্ষ থেকে বক্তব্যে আরও চটেছিলেন পরীমনি। একই সময়ে স্ত্রী পরীমনির চেয়ে বন্ধু সুনেরাহ, তিশা ও নাজিফা তুষির পক্ষ হয়ে কথা বলায় শরিফুল রাজের ওপর অসন্তুষ্ট হন পরীমনি। রাজ তখন প্রথম আলোকে বলেছিলেন, সুনেরাহ ও তানজিন তিশা ব্যক্তিগতভাবে তাঁর ভীষণ ভালো বন্ধু। সুনেরাহর সঙ্গে দারুণ একটা সিনেমার কাজ করেছেন। তিশার সঙ্গে কাজও হয়নি। কিন্তু তাঁরা খুব ভালো বন্ধু। তিনি নিজেও এসব ভিডিওর কারণে বিব্রত। সবাইকে নিয়ে মানুষ যেভাবে কথা বলতেছে, এটা সত্যিই অস্বস্তিকর।
বন্ধুদের সঙ্গে ফেসবুকে ভিডিও প্রকাশের পর পরই প্রথম আলোর ফেসবুক লাইভে কথা বলেন পরীমনি ও শরিফুল রাজ। বক্তব্যে এটুকু পরিষ্কার ছিল, তাঁরা দুজন আর দুজনের মাঝে নেই। এরপরও পরিচিতজন এবং শুভাকাঙ্ক্ষীরা চেষ্টা করেছিলেন, পরীমনি ও রাজ একত্রে থাকুক। বিভিন্ন সূত্রের খবর, পরীমনির চেষ্টাও ছিল অনেক। কিন্তু রাজের বাসা থেকে বের হয়ে অন্য কোথাও দিনের পর দিন থাকা। পরিবারের খোঁজখবর না নেওয়া, এসব যেন মে মাসের পর বাড়তেই থাকল। এর মধ্যে সন্তানের কারণে দুজনের একাধিকবার দেখা হয়। কিন্তু দুজনে আর নিজেদের মধ্যকার টান অনুভব করেন না।
সম্পর্ক ভাঙার ব্যাপারে পরীমনির বক্তব্য, ‘আমি সব ভুলে সুন্দর–স্বাভাবিক একটা পারিবারিক সম্পর্ক চেয়েছিলাম। কিন্তু সে কখনোই এই সম্পর্ককে অওন করেনি। সবার সামনে আমার বউ, আমার বাচ্চা করে বেড়ানো ভয়ংকর মানুষ একজন, যে কি না এই সম্পর্ককে শুধু নিজের স্বার্থে ব্যবহারই করে গেল। প্রতিনিয়ত! আমি এমন ভয়ংকর একজন মানুষকে বারবার সুযোগ দিয়েছি। সে–ও সুযোগ পেত; কারণ, আইনগতভাবে তার সঙ্গে আমার বিবাহবিচ্ছেদ হয়নি। এসবে বারবার আমি অসম্মানিত হয়েছি আপনাদের কাছেও। আমাকে ক্ষমা করবেন।’
এর পাল্টা জবাবে রাজ বলেছেন, ‘আমরা কেউই কিন্তু শিশু নই। আমার স্বার্থটাই–বা কিসের। আমি যেহেতু ভয়ংকর মানুষ, সেই ভয়ংকর মানুষকেই তো দেখছি বিয়ে করল, সংসার করে বাচ্চাও নিল! আমাকে ডিভোর্স দিয়েছে ভালো কথা, কিন্তু আমাকে নিয়ে মিথ্যাচার না করলে ভালো হয়। কারণ, আমারও একটা পরিবার আছে। সেখানে মা–বাবা, আত্মীয়স্বজন, পাড়া–প্রতিবেশী সবাই আছেন। একটা কথা পরিষ্কার করে বলতে চাই, আমি বিয়ের পর পরী বা বাবুকে ছাড়া অন্য কিছু ভাবিনি। একটা বছর আমি আমার কাজ থেকে দূরে ছিলাম। আশপাশের কারও ফোনকল ধরিনি। কারও সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করিনি। যতটুকু পেরেছি, স্ত্রী ও সন্তানের যত্ন করার চেষ্টা করেছি। আমাকে নিয়ে পরীর এ ধরনের মিথ্যাচার করার সুযোগ নেই। আমি এমন কিছু করিনি, যার জন্য প্রশ্নবিদ্ধ হতে হবে। আমি বারবার হেনস্তা হয়েছি। এসব নিয়ে আর বলতেও চাই না। তবে এখন পরী যেটা চাচ্ছে, সেটার প্রতি শ্রদ্ধা আছে। সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা আছে। এর বাইরে অন্য অভিযোগ এলে তা আমি প্রশ্রয় দিতে চাই না।’
পরীমনি বলেন, ‘রাজ বারবার অন্যায় করে ক্ষমা চেয়েছে। এসব ঘটনার সে পুনরাবৃত্তি করেছে। বারবার। সরি বলা, না খেয়ে থাকা, পা ধরে মাফ করে দাও, আর হবে না—এমনকি সুইসাইডের মতো হুমকিতেও ব্ল্যাকমেলের শিকার হতে হয়েছে আমাকে! একই রকম ভুলের ক্ষমা কতবার করা যায়, আমি জানি না।’
এর উত্তরে রাজ বলেছেন, ‘আমি এসবের কিছুই করিনি। এসব আমার নামে মিথ্যাচার। এগুলো নিয়ে আমাকে সম্পর্কে ভুলভাল কথা বলা। আমি এমন কিছুই করিনি। এটা কিন্তু পরীমনি, পরীমনির সঙ্গে বারবার এ রকম কিছু হবে! বারবার সে ক্ষমা করে দেবে! এটা পরীমনি নয়। আমি স্ট্রংলি বলছি, পরীমনির সঙ্গে এমন কিছু করিনি যে বারবার আমাকে অনুতপ্ত হতে হবে। মানুষ হিসেবে আমি কতটুকু কী করতে পেরেছি জানি না, কিন্তু আমি যে জেনুইন, এটা আমি জানি। কিন্তু তালাকের নোটিশের পর পরী যে এখন এ ধরনের মিথ্যচার করছে, এগুলো ঠিক নয়। এগুলো বাদে সে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তার প্রতি শ্রদ্ধা–ভক্তি সবই আছে। যেহেতু পরীমনি আমার এক্স ওয়াইফ, আমার সন্তানের মা, তাকে নিয়ে আমি আসলে এর বাইরে কোনো কথা বলতে চাই না’
চিত্রনায়ক শরিফুল রাজের সঙ্গে সম্পর্কের আনুষ্ঠানিক ইতি টানার ইঙ্গিত বেশ কিছুদিন ধরেই দিচ্ছিলেন পরীমনি। অবশেষে ১৮ সেপ্টেম্বর রাজের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক ছিন্ন করার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে তালাকের নোটিশ ইস্যু করেন পরীমনি।
ঢাকার উত্তর বাড্ডার একটি কাজী অফিস থেকে শরিফুল রাজের প্রতি তালাকের নোটিশ ইস্যু করেন পরীমনি। ১৮ সেপ্টেম্বর ইস্যু করা সেই নোটিশে পরীমনি বিচ্ছেদের জন্য চারটি কারণের কথা উল্লেখ করেছেন। এসব কারণের মধ্যে শুরুতেই আছে মনের অমিল হওয়া। এরপর আরও তিনটি কারণের মধ্যে বনিবনা না হওয়া, খোঁজখবর না নেওয়া এবং মানসিক অশান্তি সৃষ্টি করাকে উল্লেখ করেছেন পরীমনি।
২০২২ সালের ১০ জানুয়ারি প্রকাশ্যে আসে রাজ-পরীর সম্পর্কের খবর। পরীমনির পক্ষ থেকে ইস্যু করা তালাক নোটিশ ঘেঁটে দেখা গেছে, ২০২১ সালের ১৭ অক্টোবর তাঁদের বিয়ে নিবন্ধিত হয়। দুই পরিবারের সদস্যদের উপস্থিতিতে ১০১ টাকার দেনমোহরে ঘরোয়া আয়োজনে তাঁদের বিবাহ সম্পন্ন হয়। তার আগে হয় তাঁদের গায়েহলুদের অনুষ্ঠানও।
পরীমনি ও রাজের সংসারে শাহীম মাহমুদ রাজ্য নামের ১৪ মাস বয়সী একটি ছেলেসন্তান রয়েছে। দেড় বছরের দাম্পত্য জীবনে নানা ঘটনা আলোচনায় এসেছে পরীমনি ও রাজের সংসার। কখনো বিদ্যা সিনহা মিম, কখনো সুনেরাহ বিনতে কামালসহ অন্য কাউকে ঘিরে রাজের প্রতি সন্দেহের তির ছুড়েছেন পরীমনি। এসব নিয়ে কম জলঘোলা হয়নি।