রাফীর জাদুটা কী
ক্লাস নাইনের ছাত্র। নাটক-সিনেমার প্রতি দারুণ আগ্রহ। শর্টফিল্ম বানাতে মরিয়া সে। কিন্তু টাকা কোথায়? টাকার জন্য কান্না জুড়ে দিল। অগত্যা রাজি হলেন মা। ছেলেকে সঙ্গে করে বাজারে গেলেন। নিজের সোনার চেইন বিক্রি করে ১২ হাজার টাকা তুলে দিলেন হাতে। ছেলেটা বানাল প্রথম শর্টফিল্ম ‘আজব বাক্স’।
মায়ের সোনার চেইন বিক্রির টাকায় প্রথম স্বল্পদৈর্ঘ্য বানানো ছেলেটা আর কেউ নন, এ সময়ের আলোচিত নির্মাতা রায়হান রাফী। কথায় আছে, মায়ের আশিস সঙ্গে থাকলে সব কাজ সহজ হয়ে যায়। মায়ের আশীর্বাদে রাফীও ক্রমশ এগিয়ে চলেছেন।
বড় পর্দায় তাঁর তৃতীয় সিনেমা ‘পরাণ’। শরীফুল রাজ ও বিদ্যা সিনহা মিমকে নিয়ে নির্মিত এ সিনেমা দিয়ে নিজের আগের দুটি কাজকে নিজেই ছাড়িয়ে গেছেন। তরুণ নির্মাতা হিসেবে হয়েছেন প্রশংসিত। আফরান নিশো ও তমা মির্জাকে নিয়ে বানানো ‘সুড়ঙ্গ’ সিনেমাটি দিয়ে নিজেকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নেন রাফী।
সবশেষ ‘তুফান’ দিয়ে নতুনভাবে হাজির হয়েছেন এই নির্মাতা। সিনেমা হলে এত হুল্লোড় বহুদিন দেখা যায়নি। মধুমিতা হলে টিকিটের জন্য ভাঙচুরের মতো ঘটনাও ঘটেছিল। একইভাবে ছোট পর্দা ও ওটিটিতেও নিজের মুনশিয়ানা দেখিয়ে চলেছেন রাফী। তাঁর বেশির ভাগ নির্মাণই আলোচিত, প্রশংসিত। এই যে একের পর এক নিজেকে অতিক্রম করতে পারা, দর্শকের হৃদয় জিতে নেওয়া; রায়হান রাফীর জাদুটা ঠিক কী? কেন তাঁর সিনেমা একের পর এক ব্লকবাস্টার হিট? আর কেনই বা তাঁর সিনেমা আমাদের ভালো লাগে?
বিশ্বায়নের প্রভাবে পৃথিবী এখন মানুষের হাতের মুঠোয়। নতুন নতুন বিষয়ের সঙ্গে সবাই পরিচিত হচ্ছে। সিনেমা নির্মাণে বিশেষ করে গল্প বলার ঢঙে বৈচিত্র্য দেখা যাচ্ছে। রাফীর সিনেমাতেও কি বিষয়টা ফুটে উঠছে? ‘পরাণ’-এর গল্পে ছেলেটা বখাটে, যে মেয়েটাকে সে পছন্দ করে, মেয়েটা তাকে পছন্দ না করেও, ভালো না বেসেও ভালোবাসার অভিনয় করে। তার কাছ থেকে নানা ধরনের সুবিধা আদায় করে। পরে আরেকজনকে ভালোবাসে। ত্রিকোণ প্রেমের এমন গল্প কান পাতলেই আমরা শুনতে পাই। এই যে পরিচিত ঘটনাকে বুদ্ধিদীপ্তভাবে পর্দায় তুলে ধরতে পারা, এ কারণেই কি সিনেমাটি দর্শকদের ভালো লেগেছে?
ওটিটি প্ল্যাটফর্ম বিঞ্জে সম্প্রতি মুক্তি পাওয়া ওয়েব সিনেমা ‘মায়া’র দিকে চোখ ফেরানো যাক। পরিচালনার পাশাপাশি এ ছবির গল্পও লিখেছেন রাফী। এ গল্পটিও মানুষের অতিপরিচিত। একজন নারীর জীবনসংগ্রামের চিত্র ওয়েব ফিল্মের মধ্য দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন। স্বামী নেশাগ্রস্ত হলে একজন নারীর ওপর দিয়ে কী ঝড়ঝাপটা যায় কতটা অসহায়ত্ব তাকে ঘিরে ধরে, কত বাঁকা চাহনি তাকে সহ্য করতে হয়—নির্মাণের মুনশিয়ানা দিয়ে এসব দৃশ্যকেই জীবন্ত করে তুলেছেন রাফী। এই যে বাস্তবের ঘটনাকে, জীবনের ঘটনাকে সিনেমাটোগ্রাফিতে ফুটিয়ে তুলতে পারা—এটিও নির্মাতার জনপ্রিয়তার আরেক কারণ।
রাফীর ‘পোড়ামন টু’, ‘দহন’, ‘টান’, ‘সাত নম্বর ফ্লোর’ থেকে শুরু করে ‘পরাণ’, ‘সুড়ঙ্গ’ এবং ‘তুফান’ প্রতিটি সিনেমার গল্পেই বৈচিত্র্য লক্ষ করা যায়। গল্পগুলোর সঙ্গে দর্শক কোনো না কোনোভাবে নিজের জীবনের কিংবা চোখে দেখা বা শোনা বা পত্রিকায় পড়া ঘটনাকে মেলাতে পারেন। এই যে পর্দায় সমসাময়িক ঘটনাকে নিয়ে আসতে পারা, এটিও রাফীর সাফল্যের অন্যতম এক্স ফ্যাক্টর।
চরিত্র রূপায়ণের কৌশল কি রাফীর সিনেমার প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়িয়েছে? ‘পরাণ’ চলচ্চিত্রের বখাটে চরিত্র ‘রোমান’। সিনেমায় তাকে বখাটে হিসেবে উপস্থাপনে কোনো কমতি রাখেননি নির্মাতা। একইভাবে ‘শিফাত’, ‘স্বপন’, ‘তোতা মিয়া’, ‘অনন্যা’ প্রতিটি চরিত্রকেই আলাদা করা যায়। চরিত্রের বিষয়টা আরও ভালো অনুভব করা যায় ‘সুড়ঙ্গ’ সিনেমায়। মাসুদ চরিত্রে অভিনয় করা নিশোকে একেবারে ভিন্ন ধাঁচে তুলে ধরেছেন তিনি। ময়না ও জহির চরিত্র দুটিকেও বাস্তব রূপ দিয়েছেন।
‘তুফান’ সিনেমায় শাকিব খানের দ্বৈত চরিত্র। তুফান ও শান্ত। আলাদা দুটি চরিত্র, আলাদা তাদের বৈশিষ্ট্য। লুক, কস্টিটিউম থেকে শুরু করে কথোপকথন—সবেতেই দুজনকে ভিন্নভাবে এঁকেছেন রাফী। পুলিশ অফিসার চরিত্রটিও রাফীর হাতে নতুন ধাঁচে উপস্থাপিত হয়েছে। গতানুগতিক ধারা থেকে বেরিয়ে তাঁর বেশির ভাগ সিনেমায় চরিত্রটির আধুনিকায়ন করেছেন।
‘দুষ্টু কোকিল’, ‘লাগে উড়াধুড়া’ শিরোনামের ‘তুফান’ সিনেমার গান দুটি যে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে, বাংলাদেশের সিনেমার ক্ষেত্রে এ ঘটনা বিরল। সিনেমা জনপ্রিয় হওয়ার ক্ষেত্রে গান খুব বড় ভূমিকা রাখে। আর এই গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ সিনেমায় সংযোজনের ক্ষেত্রেও রাফী যথেষ্ট যত্নশীল। বিষয়টা আরও ভালো বোঝা যায় ‘লাগে উরাধুরা’ গান প্রসঙ্গে রাফীর বক্তব্য থেকে। ‘এমন একটা গান চাইছিলাম, যে গান দেশের মানুষকে মাতোয়ারা করবে। গানের সঙ্গে নাচবেন সব বয়সী দর্শক। এ জন্য একের পর এক অপেক্ষা করতে হয়েছে। চার মাস লেগেছে গানটির কথা, সুর, সংগীত ঠিক করতে।’
নির্মাতা আরও বলেন, ‘আমরা যখনই কোনো অনুষ্ঠান বা ঘরোয়া কোনো আয়োজনে যাই, তখন শোনা যায় হিন্দি গান। এটা দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। সেখানে “তুফান” নিয়ে শুটিংয়ের আগেই আমরা ভেবেছিলাম, এমন এক গান করব, যে গান আমাদের দেশের কথা বলবে। অনুষ্ঠান বা পার্টিতে আমাদের ঘরে ঘরে বাজবে।’ তাঁর সুড়ঙ্গ সিনেমার ‘গাঁ ছুয়ে বলো’ ও ‘পরাণ’ সিনেমার ‘চলো নিরালায়’ গান দুটিও জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
সিনেমার ক্ষেত্রে প্রচারণা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এ ক্ষেত্রেও নতুনত্ব আনার প্রচেষ্টা জারি রেখেছেন রাফী। কেবল প্রচারণার জন্যই একটি গান তৈরি করেছিলেন। গানটি ‘দামাল’ সিনেমায় দেখা যায়নি। এই যে প্রতিটি ধারায় নতুন নতুন ভাবনার সংযোজন। অভিনেতা-অভিনেত্রীদের থেকে সেরা পারফরম্যান্স বের করে আনার পাশাপাশি গল্প, সংলাপ, আবহসংগীত থেকে সিনেমাটোগ্রাফিতে নান্দনিকতা বজায় রাখার প্রচেষ্টায় কি এ নির্মাতার জাদু? এ কারণেই কি তাঁর সিনেমা ব্লকবাস্টার হিট?
অনেক তারকাই রাফীর চরিত্রে ধরা দিয়েছেন ভিন্নভাবে। ‘টান’-এর শবনম বুবলী আর অন্য সিনেমার বুবলীকে কি মেলানো যায়। একইভাবে বলা যায় ‘মায়া’য় ইমনের কথাও; এই ওয়েব সিনেমায় সম্ভবত ক্যারিয়ার–সেরা অভিনয় করেছেন ঢাকাই ছবির এই নায়ক। পাত্র–পাত্রীদের কাছ থেকে সেরা অভিনয় বের করে নিয়ে আসতে রাফীর জুড়ি মেলা ভার। একই কথা প্রযোজ্য ‘তুফান’-এর ক্ষেত্রে। এ ছবিতে যেভাবে ‘অভিনেতা শাকিব’কে আবিষ্কার করেছেন দর্শকেরা, সেটা পাওয়া গেছে কম সিনেমাতেই।
২৬ অক্টোবর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি আলোচনায় অংশ নেন রাফী। নিজের বক্তব্যে এই নির্মাতা বলেন, ‘সিনেমা এমনই শিল্প, যার মাধ্যমে প্রতিবাদ করা যায়, সমাজব্যবস্থাকে তুলে আনা যায়, এর মাধ্যমে একটা গল্পকে একটা জায়গায় বন্দী করা যায়।’ রাফী যে নিজের সিনেমায় তা ভালোভাবেই পেরেছেন, সেটা তাঁর সিনেমার দর্শকমাত্রই জানেন।