ক্যামেরার পেছনে আমজাদ হোসেন, কনকনে শীতের রাতে শুটিংয়ে ববিতা

দেশের বাইরের একটি চলচ্চিত্র উৎসবে আমজাদ হোসেনের সঙ্গে ববিতাছবি– ববিতার সৌজন্যে

মানিকগঞ্জের নদীতীরবর্তী এক গ্রামে ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’ সিনেমার শুটিং। সেখানে সারা দিন অপেক্ষায় ববিতা। অন্য শিল্পীরা শুটিংয়ে অংশগ্রহণ করলেও ববিতার ডাক আসে না। যখন ডাক আসে, তখন রাত দুইটা। কনকনে শীতের মধ্যে ওই রাতে আনন্দচিত্তেই সংলাপ দিতে দাঁড়িয়েছিলেন ববিতা। কারণ, ছবির পরিচালক আমজাদ হোসেন।

বরেণ্য এই পরিচালকের আজ প্রয়াণদিবস। ৭৬ বছর বয়সে ব্যাংককে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২০১৮ সালের ১৪ ডিসেম্বর মারা যান তিনি।

১৯৪২ সালে জামালপুরে জন্মগ্রহণ করেন আমজাদ হোসেন। ছোটবেলা থেকেই লেখালেখি শুরু করেন তিনি। পরবর্তী জীবনে তিনি অসংখ্য গল্প, কবিতা ও উপন্যাস রচনা করেছেন। সিনেমায় তাঁর পথচলা শুরু হয় অভিনয় দিয়ে। ১৯৬১ সালে ‘তোমার আমার’ সিনেমার মাধ্যমে প্রথম ক্যামেরার সামনে দাঁড়ান। পরবর্তী সময়ে তিনি কালজয়ী চলচ্চিত্রকার জহির রায়হানের সঙ্গে সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করেছিলেন। একসময় নিজেই পরিচালনায় নামেন এবং উপহার দেন একের পর এক জনপ্রিয় বাংলা চলচ্চিত্র। মুক্তিযুদ্ধ-পূর্বকালীন যে সিনেমা স্বাধীনতা আন্দোলনে গণজোয়ার এনেছিল, সেই ‘জীবন থেকে নেয়া’র কাহিনিকার, সংলাপ রচয়িতাও ছিলেন আমজাদ হোসেন। গ্রামবাংলার ভালোবাসার ছবি হিসেবে যে ছবিটি সবচেয়ে বেশি পরিচিত, সেই ‘সুজন সখী’রও কাহিনিকার, সংলাপ রচয়িতা তিনি। পৌরাণিক কাহিনি নিয়ে নির্মিত জনপ্রিয় ছবি ‘বেহুলা’র সংলাপও তাঁর লেখা। এ ছাড়া ‘ধারাপাত’, ‘আনোয়ারা’, ‘আবার তোরা মানুষ হ’, ‘জয়যাত্রা’, ‘আকাশ ছোঁয়া ভালোবাসা’র মতো জনপ্রিয় ছবিগুলোর কাহিনিকার তিনি।

অভিনেতা আমজাদ হোসেনও বেশ জনপ্রিয়। ‘জীবন থেকে নেয়া’র আলোচিত চরিত্র ‘মধু ভাই’রূপে অনবদ্য অভিনয় করে দর্শকদের হৃদয়ে তিনি গেঁথে আছেন। এ ছাড়া ‘হারানো দিন’, ‘আগুন নিয়ে খেলা’, ‘বেহুলা’, ‘প্রাণের মানুষ’, ‘প্রেমী ও প্রেমী’সহ অনেক সিনেমায় তিনি অভিনয় করেছেন।

অভিনেতা, পরিচালক, গীতিকার আমজাদ হোসেন
ছবি: সংগৃহীত

এক সময়কার বাংলাদেশিদের ঈদ বিনোদনের অন্যতম অনুষঙ্গ জনপ্রিয় টিভি সিরিজ ‘জব্বর আলী’র নাম ভূমিকায় তিনিই অভিনয় করেছেন। ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’, ‘সুন্দরী’ সিনেমার সেই কালজয়ী গানগুলোর রচয়িতাও তিনি। আমজাদ হোসেনের লেখা নাটক ‘ধারাপাত’ নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন সালাহউদ্দিন। এতে আমজাদ হোসেন নায়ক হিসেবে অভিনয় করেন। এরপর তিনি জহির রায়হানের ইউনিটে কাজ শুরু করেন। তাঁর পরিচালিত দর্শকপ্রিয় চলচ্চিত্রের মধ্যে আছে ‘বাল্যবন্ধু’, ‘পিতাপুত্র’, ‘এই নিয়ে পৃথিবী’, ‘বাংলার মুখ’, ‘নয়নমনি’, ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’, ‘সুন্দরী’, ‘কসাই’, ‘জন্ম থেকে জ্বলছি’, ‘দুই পয়সার আলতা’, ‘সখিনার যুদ্ধ’, ‘ভাত দে’, ‘হীরামতি’, ‘প্রাণের মানুষ’, ‘সুন্দরী বধূ’, ‘কাল সকালে’, ‘গোলাপী এখন ঢাকায়’, ‘গোলাপী এখন বিলেতে’ ইত্যাদি।

চলচ্চিত্র-সংশ্লিষ্ট অনেকের মতে, বাংলাদেশের চলচ্চিত্রশিল্পে যাঁরা কাজ করছেন, তাঁদের সঙ্গে গ্রামের যোগাযোগটা অতটা গভীর নয়। কিন্তু আমজাদ গ্রামের মানুষকে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে জানতেন, যার জন্য চলচ্চিত্রে তাঁর চরিত্রগুলো জীবন্ত হয়ে উঠেছে। তাঁর দেখার ভঙ্গিটা ছিল অন্যদের থেকে আলাদা, ছবিগুলোতেও তাঁর স্বাতন্ত্র্যের ছাপ স্পষ্ট। তাঁর অনেক ছবিতে লোকজ সংগীতকে ভেঙে আধুনিকীকরণ করা হয়েছে, যা অনেক বড় কাজ বলে মনে করেন অনেকেই। তাঁকে নিয়ে স্মৃতিচারণা করেছেন ববিতা, মৌসুমী, যা ২০২০ সালে প্রথম আলোতে প্রকাশ করা হয়েছিল। আজ জন্মদিন উপলক্ষে সেই লেখাটির কিছু অংশ আবার প্রকাশ করা হলো। আমজাদ হোসেনের কাজের ধারা ববিতার ভাষায় ‘অদ্ভুত সুন্দর’। তাঁর ছবিতে যে শিল্পীরা কাজ করতেন, সবাই বেশ তৃপ্তি পেতেন। তিনি বলেন, ‘এমন হতো, একটি দৃশ্যের শুটিং হবে। সকাল থেকে বসে আছি। সন্ধ্যায় তিনি তা ধারণ করলেন। আমরা মোটেও বিরক্ত হতাম না। তবে কোনো কিছু তিনি চাপিয়েও দিতেন না।’ ববিতা জানান, শুটিংয়ের আগে খুব একটা তিনি স্ক্রিপ্ট দিতেন না। একটা ধারণা দিয়ে রাখতেন। কখনো শুটিং স্পটেও সংলাপ বদলে যেত। ববিতা বলেন, ‘শুটিং স্পটে বসেও সংলাপ লিখতেন। আমরা চা খাচ্ছি, আড্ডা দিচ্ছি। তাকিয়ে দেখছি, মনোযোগ দিয়ে আমজাদ ভাই লিখছেন।’

‘গোলাপী এখন বিলাতে’ ছবির শুটিংয়ের জন্য আমজাদ হোসেন মৌসুমীকে এক দিনের শুটিংয়ের কথা বলে নিয়ে গিয়েছিলেন কমলাপুর রেলস্টেশনে। সেই ট্রেন গাজীপুর হয়ে কখন ময়মনসিংহ চলে যায় টের পাননি মৌসুমী। শুটিং করতে লেগে গিয়েছিল চার দিন। আমজাদ হোসেনের পরিচালনায় ‘আদরের সন্তান’ ও ‘গোলাপী এখন বিলাতে’ ছবিতে অভিনয় করেছেন মৌসুমী। তিনি বলেন, ‘আমজাদ হোসেন আমাদের চেয়ে অনেক বড়। ঘনিষ্ঠভাবে মেশার সুযোগ হয়নি। এরপরও বন্ধুত্বসুলভ ব্যবহার করতেন। কাজের ক্ষেত্রে দূরদর্শিতা তাঁর লেখার মতোই ছিল। একবার “গোলাপী এখন বিলাতে” ছবির শুটিং করার সিদ্ধান্ত হয় কমলাপুর রেলস্টেশনে। আমি স্টেশনে না গিয়ে কীভাবে কাজটি করা যায়, সে চিন্তা করছিলাম। কিন্তু আমজাদ ভাই এমনভাবে বলেন যে আর না করতে পারিনি। তবে মোটেও জোর করেননি। ধমকও দিতেন না। তিনি শিল্পীর মন বুঝতে পারতেন। কমলাপুর রেলস্টেশনে মেইল ট্রেনে আমাদের শুটিং শুরু হয়। ক্যামেরাম্যান জেড এইচ মিন্টু ভাই আমার গাড়িটি ময়মনসিংহ নিয়ে আসতে বলেছিলেন। এক দিনের শুটিং চার দিনে শেষ হয়েছিল। এরপরে ঢাকায় ফিরি।’

(লেখাটি আমজাদ হোসেনের জন্মদিনে প্রথম আলো অনলাইনে প্রকাশিত হয়েছিল। আজ আমজাদ হোসেনের প্রয়াণদিবসে তাঁকে স্মরণ করে আবার প্রকাশ করা হলো)