‘সাত ভাই চম্পা’র পরিচালক দিলীপ সোমকে মনে আছে?
বনে বাস করা দরিদ্র কাঠুরিয়ার মেয়েকে বিয়ে করে সোলেমানপুরের নিঃসন্তান বাদশা। কাঠুরিয়ার মেয়ে মর্যাদা পায় ছোট রানির। দরবেশের বরে সে অন্তঃসত্ত্বা হয়। বাদশার আগের ছয় রানি ষড়যন্ত্র করলেও শেষ পর্যন্ত ছোট রানি একে একে জন্ম দেয় সাত পুত্র ও এক কন্যা সন্তানের। ছয় রানি ষড়যন্ত্র করে আট পুত্র-কন্যাকে মাটিচাপা দেয়। তবে ছোট রানির সই মালিনী কৌশলে কেবল এক কন্যাকে বাঁচাতে পারে। বাদশাকে ভুল বুঝিয়ে ছোট রানিকে পাঠানো হয় বনবাসে। পরে দরবেশের বরে সাত পুত্র বাগানে ফুটে থাকে সাত চাঁপা ফুল হয়ে।
এটি বাংলা চলচ্চিত্রের আলোচিত একটি রূপকথার গল্পের সিনেমারূপ। ১৯৬৮ সালে পূর্ব পাকিস্তানে ‘সাত ভাই চম্পা’ নামের চলচ্চিত্রটি মুক্তি পায়। এটি সে সময় সবচেয়ে আলোচিত সিনেমা। সিনেমার কাহিনিটি দেশে শুধু সিনোমপ্রেমী নয়, সব শ্রেণির মানুষের মনে এখনো গেঁথে আছে। কিন্তু এই আলোচিত চলচ্চিত্রের পেছনের মানুষটিকে আমাদের মনে আছে?
গাজীপুরের শ্রীপুর গ্রামে ১৯৪১ সালে জন্ম নেওয়া এক টগবগে তরুণ নির্মাণ করেছিলেন ‘সাত ভাই চম্পা’র মতো চলচ্চিত্রটি। তাঁর নাম দিলীপ সোম। বাবা সুধীর সোম ও মা ননীবালা দম্পতির এই সন্তান ‘সাত ভাই চম্পা’ সিনেমা দিয়ে একক পরিচালক হিসেবে চলচ্চিত্র নির্মাণের যাত্রা করেন।
এর আগে বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ প্রযোজনায় ভারতের বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার রাজেন তরফদারের সঙ্গে সহকারী পরিচালক হিসেবে ‘পালঙ্ক’ ও ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ সিনেমা নির্মাণ করেন। বাংলাদেশের বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার, কাহিনিকার ও সংগীত পরিচালক খান আতাউর রহমানের সঙ্গে সহকারী পরিচালক ছিলেন ‘নবাব সিরাজউদ্দৌলা’ ছবিটিরও। তবে ‘সাত ভাই চম্পা’ সিনেমায় প্রথম পূর্ণাঙ্গ পরিচালক হিসেবে আবির্ভূত হন তিনি। এই সিনেমার জন্য তিনি সার্ক সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে পুরস্কার লাভ করেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দিলীপ সোম তিন সন্তানের জনক। ছেলে অসীম সোম। দুই মেয়ের একজন ঝুমা সোম ও অপরজন জয়া সোম। তাঁরা সবাই এখন ভারতের বর্ধমান শহরের বাসিন্দা। তাঁদের কেউ চলচ্চিত্রের সঙ্গে যুক্ত নন। দিলীপ সোম ১৯৯৭ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি একটি চলচ্চিত্রের শুটিং লোকেশন দেখতে সিলেটে গিয়েছিলেন। ফেরার পথে চুনারুঘাট এলাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান। তাঁর দেহ শ্রীপুরে চিতায় দাহ করা হয়। এর আগে বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তাঁকে রাষ্ট্রীয় সম্মাননা দেওয়া হয়।
১৯৫৯ সালে তিনি শ্রীপুর পাইলট উচ্চবিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক ও ১৯৬১ সালে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী সরকারি কলেজ থেকে আইএ পাস করেন। এরপর তিনি চলচ্চিত্রজগতে যুক্ত হন। তাঁর উল্লেখযোগ্য সিনোমগুলো হলো—‘মণিমালা’, ‘চম্পা-চামেলী’, ‘সোনা বউ’, ‘আলো তুমি আলেয়া’, ‘শহর থেকে দূরে’, ‘স্মৃতি তুমি বেদনা’, ‘তালুকদার’, ‘শেষ উপহার’, ‘গ্যাং লিডার’, ‘চিরদিনের সাথী, ‘হৃদয় আমার’, ‘মহামিলন’। উল্লেখযোগ্য জনপ্রিয় তিনটি গান—‘তুমি আমার হৃদয়ে যদি থাকো একদিন জানি কাছে আসবে’, ‘পৃথিবীকে ভালোবেসে সুরে সুরে কাছে এসে কত যে আপন হয়েছ’, ‘তোমাকে আমি রাখব ধরে, কখনো তোমায় ছাড়া বাঁচব না’।
গত সোমবার তাঁর জন্মভিটায় গিয়ে কথা হয় এই পরিচালকের স্বজনদের সঙ্গে। শ্রীপুর রেলস্টেশনের আগে দেখা যায়, শ্রীপুর বাজারে একটি সড়কের নামফলকে তাঁর নাম লেখা, অর্থাৎ তাঁর নামে সড়কটির নামকরণ করা হয়। তবে নামফলকটি প্রায় ঢাকা পড়ে আছে দোকানপাটের মালামালের আড়ালে। রেলস্টেশনের পেছনের সড়ক ধরে উত্তর দিকে ৪০০ মিটার এগিয়ে গেলেই রেলওয়ের পুরোনো বেশ কিছু স্থাপনা। এসব স্থাপনার ফাঁক গলে চলে গেছে পায়ে হাঁটা পথ। কিছু দূর হাঁটলেই তাঁর জন্মভিটা। তবে সেখানে এখন আর তাঁর সেই বাড়ি নেই। সবকিছু বিক্রি করে তাঁর উত্তরসূরিরা চলে গেছেন। নতুন বাসিন্দারা সেখানে বসবাস করছেন।
ওই এলাকায় গিয়ে দিলীপ সোমের বাড়ির খোঁজ করছি জেনে খুব আগ্রহ নিয়ে এক নারী এগিয়ে এলেন। হাত ধরে তাঁর ঘরের ভেতর নিয়ে দেয়ালে টাঙানো একটি ছবি দেখিয়ে বললেন, তিনিই দিলীপ সোম। ওই নারীর নাম শিলা সোম। তিনি দিলীপ সোমের ভাতিজা শম্ভুনাথ শুভর স্ত্রী। দিলীপ সোমের ছবিটি স্মৃতি হিসেবে খুব যত্নে আগলে রেখেছেন এই স্বজন।
সেখানে মিতা সোম নামের আরেক বাসিন্দার সঙ্গে দেখা হয়। দিলীপ সোম ছিলেন তাঁর চাচাশ্বশুর। দিলীপ সোম সম্পর্কে খোঁজ নেওয়ায় তিনি অবাক হলেন। তিনি বললেন, ‘এত বছরেও বিখ্যাত ব্যক্তিটির জন্মভিটায় কেউ খোঁজ নিতে আসেননি। আপনার আগ্রহ হলো কীভাবে? এগুলো এখন জেনে কী করবেন।’
দিলীপ সোমের ভাতিজা স্বপন সোমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, দেশের চলচ্চিত্রজগতে তাঁকে (দিলীপ সোম) অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। অথচ তিনি ও তাঁর কর্মগুলো এখনো অন্তরালেই রয়ে গেছে।
দিলীপ সোমের বাড়ির খোঁজ করতে সহযোগিতা করেন শ্রীপুরের একটি কলেজশিক্ষক মিশকাত রাসেল। তিনি জানান, স্থানীয় শ্রীপুর সাহিত্য পরিষদ ২০১৫ সালে দিলীপ সোমকে মরণোত্তর পুরস্কার দিয়েছেন। তিনি মনে করেন, এই মহান নির্মাতার স্মৃতি রক্ষায় রাষ্ট্রের আরও কিছু করা দরকার।