মেহজাবীন পেরেছেন, ‘মালতী’ পারল কি

‘প্রিয় মালতী’ সিনেমার দৃশ্যে মেহজাবীন চৌধুরীপ্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের সৌজন্যে

শেষ কবে হলে বাংলা সিনেমা দেখে মনে হয়েছে, পর্দায় সমাজের এক টুকরো চিত্র ফুটে উঠেছে? তাহলে ‘প্রিয় মালতী’ দেখতে চলে যান। শঙ্খ দাশগুপ্ত পরিচালিত সিনেমাটি দেখে মনে হবে এ যেন সিনেমা নয়, পর্দায় বাস্তবের এক নিখুঁত রূপান্তর।

একনজরে
সিনেমা: ‘প্রিয় মালতী’
ধরন: ড্রামা
পরিচালক: শঙ্খ দাশগুপ্ত
অভিনয়: মেহজাবীন চৌধুরী, নাদের চৌধুরী, আজাদ আবুল কালাম, রিজভী রিজু, মোমেনা চৌধুরী, সমু চৌধুরী

পলাশ আর মালতীর ছোট্ট সংসার। বিবাহবার্ষিকীতে দুজনে মিলে নৌকায় ঘুরতে বের হয়। কেক কাটে, ঘোরাঘুরি করে। মালতী অন্তঃসত্ত্বা। পলাশ একটা দোকানের সাধারণ কর্মচারী। মালতীকে খুব ভালোবাসে। আর দশটা নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের মতো সুখে সংসার করার স্বপ্ন দেখে তারা। তাদের কথোপকথনেও এটা ধরা পড়ে। মালতী পলাশকে বলে, ‘আমাকে একটা সেলাই মেশিন কিনে দাও, নায়িকা শাবানার মতো সেলাই করতে করতে একটা ফ্যাক্টরি দিয়া দিমু।’ উত্তরে পলাশ বলে, ‘আমিও তাহলে জসিমের মতো একটা ঠেলাগাড়ি কিনে নিই। ঘুরে ঘুরে লেইস ফিতা বিক্রি করি।’

তাদের এই সাজানো সংসার হঠাৎ ওলট–পালট হয়ে যায়। অন্যান্য দিনের মতো পলাশ দোকানে যায়। কিছুক্ষণ পর মালতী টিভিতে দেখে পলাশের দোকান যে ভবনে, তাতে আগুন লেগেছে। বারবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও পলাশকে পাওয়া যায় না। পলাশের দুই বন্ধুর সঙ্গে মালতী ঘটনাস্থলে যায়। কিন্তু সেখানে গিয়ে যা দেখে, নিমেষে তা বদলে দেয় তার জীবনের মোড়। এর পর থেকে একের পর এক কঠিন পরীক্ষার মুখে পড়তে থাকে মালতী। সে কি পারে এ লড়াই চালিয়ে যেতে? নাকি তাকে হার মেনে নিতে হয় নিয়তির কাছে?

‘প্রিয় মালতী’ সিনেমার দৃশ্য
ভিডিও থেকে

‘প্রিয় মালতী’ সিনেমায় ‘মালতী’ হয়েছেন মেহজাবীন চৌধুরী। এ সিনেমার মাধ্যমে বড় পর্দায় তাঁর অভিষেক হলো। ১৫ বছরের ক্যারিয়ারে নাটক, সিরিজে নানা ধরনের চরিত্রে অভিনয় করেছেন মেহজাবীন। তবে প্রিয় মালতী সিনেমায় যেন আগের সব কাজ ছাড়িয়ে গেছেন। নাটকের সেই ‘পাশের বাড়ি মেয়ে’ বা রোমান্টিক নায়িকা নন, বরং জটিল এক চরিত্রে, পুরো সিনেমাটিকে নিজের কাঁধে নিয়ে অনায়াসে হেঁটেছেন তিনি। অন্তঃসত্ত্বা ‘মালতী’ চরিত্রে পর্দায় এতটাই অসাধারণ, যেন নিজেকেই ছাপিয়ে গেছেন। পর্দার ‘মালতী’র সঙ্গে দর্শকও নিজেকে যুক্ত করতে পেরেছেন পুরোটা সময়। পলাশ আর মালতীর সুখের সংসার দেখে যে রকম আনন্দে মন ভরে উঠছিল, তেমনি মালতীর হাহাকার আর কষ্টে অজান্তেই চোখের কোণে জমছিল জল। চরিত্রটির অসহায়ত্ব যে নিখুঁতভাবে তুলে ধরেছেন, সেটা মেহজাবীনের অভিনয় সক্ষমতার আরেকটি স্বাক্ষর। বাংলাদেশের সিনেমায় শক্তিশালী নারী চরিত্রের তালিকা করলে নিশ্চিতভাবেই ‘মালতী’র নাম থাকবে।

এ সিনেমায় মেহজাবীনের বিপরীতে অভিনয় করেছেন রিজভী রিজু। চরিত্রটি ছোট হলেও তাঁর উপস্থিতি ছিল সাবলীল। মেহজাবীনের সঙ্গে তাঁর রসায়নও ভালো ছিল। বাবার চরিত্রে অসহায়তা আর লোভ—এই দুটি দিকই অত্যন্ত নিপুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন আজাদ আবুল কালাম। একইভাবে শাহজাহান সম্রাট ও নাদের চৌধুরী নিজেদের চরিত্রে সেরাটা দিয়েছেন। নেতিবাচক চরিত্রে আনিসুল হক বরুণের কথা আলাদাভাবে বলতে হয়। ব্যাপারী চরিত্রে তিনি ছিলেন লা–জওয়াব।

‘প্রিয় মালতী’র বিশেষ প্রদর্শনীতে নির্মাতা শঙ্খ দাশগুপ্ত। চরকির সৌজন্যে

‘প্রিয় মালতী’ শঙ্খ দাশগুপ্তর প্রথম সিনেমা। আগে ওটিটিতে মুক্তি পাওয়া তাঁর গুটি ও বলি সিরিজ যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা জানেন বাস্তবঘেঁষা গল্প পর্দায় তুলে আনতে তিনি কতটা পারদর্শী।

সিনেমার আবহসংগীত, মেকআপ, পোশাক আর শুটিং লোকেশন নিয়ে না বললেই নয়। পুরান ঢাকার সদরঘাট, শাঁখারীবাজার, গুলিস্তানের মতো জায়গায় চিত্রায়ণ সিনেমাটিকে করে তুলেছে আরও বাস্তব। ঢাকাকে এতটা বাস্তবভাবে খুব কম সিনেমাতেই দেখা গেছে। এ জন্য বিশেষ ধন্যবাদ পাবেন চিত্রগ্রাহক বরকত হোসেন পলাশ। রুসলান রহমানের মানানসই আবহ সংগীতের কল্যাণে মালতীর জীবনের উত্থান-পতনে নিজেকে আরও গভীরভাবে একাত্ম করতে পেরেছেন দর্শক।

‘প্রিয় মালতী’র পোস্টার। চরকি সৌজন্যে

অ্যাকশন, কমেডি আর থ্রিলারের ভিড়ে দর্শককে ভিন্ন কিছুর স্বাদ দেবে ‘প্রিয় মালতী’। সিনেমাটি অনেক প্রশ্ন তৈরি করবে, কখনো কখনো অস্বস্তিও। পর্দায় আরোপিতভাবে বক্তব্য হাজির না করেও বার্তা দিতে পেরেছে ‘প্রিয় মালতী’। জনপ্রিয় ধারার বাইরে গিয়ে এমন চ্যালেঞ্জিং বিষয়কে পর্দায় ঠিকঠাক তুলে ধরার জন্য নির্মাতা শঙ্খ পুরো নম্বর পাবেন। সিনেমার পুরোটায় যত্নের ছাপ স্পষ্ট। তাই দেখার পর মনে হয়, এটা তো আমাদেরই গল্প। যে গল্পের চরিত্ররা ঘুরে বেড়ায় আমাদের চারপাশে, কখনোবা আমরাই হয়ে উঠি সেই সব চরিত্র!

আরও পড়ুন