৫০ বছরে ‘আলোর মিছিল’
একটা সময় শুধু প্রেক্ষাগৃহে বসেই সিনেমা দেখতে হতো। সেই সময়ে এমন সব সিনেমা তৈরি হয়েছে, যা এখনো মানুষকে আলোড়িত করে। পাঠকদের জন্য ধারাবাহিকভাবে আমরা এ ধরনের সিনেমার গল্প শোনাব। আজ শুনব ‘আলোর মিছিল’-এর কথা—১৯৭৪ সালের আজকের দিনে মুক্তি পায় নারায়ণ ঘোষ মিতা পরিচালিত ছবিটি।
‘আলোর মিছিল’ ছবির পরিচালক নারায়ণ ঘোষ মিতা মারা গেছে দুই দশক আগে। প্রধান চরিত্রের অভিনয়শিল্পী রাজ্জাক, আনোয়ার হোসেন, খলিলউল্লাহ খান, সুরকার খান আতাউর রহমান, সংগীত পরিচালক সত্য সাহাসহ অনেকেই মারা গেছেন। বেঁচে থাকা অভিনয়শিল্পীদের মধ্যে কথা হয় সুজাতা, ববিতা ও সংগীতশিল্পী সাবিনা ইয়াসমীনের সঙ্গে।
ছবির গল্পে দেখা যায়, মাত্র স্বাধীন হওয়া দেশটি তখনো ঠিকঠাকভাবে গড়ে ওঠেনি। বিপর্যস্ত দেশটিতে তখন আলোর সন্ধানে মুক্তিকামীরা লড়ছে। আশপাশে অভাব-অনটন, দারিদ্র্য যখন গ্রাস করছে, ঠিক তখনই দেশের মধ্যে একশ্রেণির দুর্নীতিবাজ কালোবাজারি ব্যবসায়ী রাতারাতি ধনী হতে লাগল। সমাজের সুবিধাবাদী, লোভী মানুষেরা শুধু নিজের ক্ষমতা, বিত্তবৈভব ও প্রভাব–প্রতিপত্তির জন্য দেশের সর্বনাশ করার চেষ্টায় থাকল। মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যাশা, প্রাপ্তি, স্বপ্ন, স্বপ্নভঙ্গের নিদারুণ চিত্র—এই সবকিছু নিয়েই ১৯৭৪ সালে নারায়ণ ঘোষ মিতার পরিচালনায় মুক্তি পায় চলচ্চিত্রটি।
আলো নামের একটি মেয়ের মৃত্যুতে সিনেমার কাহিনি শেষ হয়। এই দুঃখ–কষ্টের কাহিনি আর সংলাপের বুননে ছিলেন ইসমাইল মোহাম্মদ। মাতৃ–পিতৃহীন আলো নামের মেয়েটি মামাবাড়িতে মানুষ। দাদু, মামা-মামি সবার কাছে সে বড় প্রিয়। সে গান জানে, নাচ শেখে। সাবিনা ইয়াসমীনের গাওয়া কালজয়ী গান, ‘এই পৃথিবীর পরে/ কত ফুল ফোটে আর ঝরে/ সে কথা কি কোনো দিন/ কখনো কারও মনে পড়ে’। ববিতা পর্দায় ঠোঁট মেলান।
গানটি প্রসঙ্গে কথা হয় সাবিনা ইয়াসমীনের সঙ্গে। জানালেন, তখন একের পর এক চলচ্চিত্রে গাইছিলেন। এরই ধারাবাহিকতায় সত্য সাহার কাছ থেকে এই গানটি গাওয়ার প্রস্তাব পান। এফডিসির স্টুডিওতে এই গানে কণ্ঠ দেন বলে জানালেন। সেদিন স্টুডিওতে সত্য সাহা ছাড়াও পরিচালক নারায়ণ ঘোষ মিতা ছিলেন। বললেন, ‘গানটি খুব বেশি পছন্দের ছিল। দাদাকে এ কথা বলার পর তিনি খুব খুশি হয়েছিলেন। অন্য রকম গান। কথাগুলো দারুণ। সুর তো ভীষণ প্রেমময়। গানের কথা-সুর মিলেমিশে একাকার হয়ে উঠেছিল। সুরের সঙ্গে মিলে স্বপ্নের মতো একটা আবহ তৈরি করেছিল। আর সিনেমার দৃশ্যের সঙ্গে পড়ে তো আরও অপূর্ব হয়ে উঠেছিল।’
মামা-মামি ও সদ্য প্রেমে পড়া হাফ ইঞ্জিনিয়ার যুবকের সোহাগে-আদরে; পড়াশোনা, নাচ–গানের অনুশীলনে ভালোই চলছিল আলোর জীবন। কিন্তু যুদ্ধ–পরবর্তী সময়ে কেরানি বড় মামা আলিমের (খলিলউল্লাহ খান) হঠাৎ বড়লোক হওয়ার বাসনায় কালোবাজারি ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন। রাতারাতি লাখ লাখ টাকার মালিক হন। বদলে যায় বাড়ির পরিস্থিতি। কিন্তু মধ্যবিত্ত পরিবারের সুখ নষ্ট হয়ে যায়। ছোট মামা রানা (রাজ্জাক) বিদেশ থেকে ফিরে বাকি পড়াশোনা ও ভালো চাকরিতে মন না দিয়ে দেশের কাজে যুক্ত হয়। এই কাজে তাকে উৎসাহিত করে আলিমের একসময়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু শহীদ আশরাফ (আনোয়ার হোসেন)। দেশ অন্তঃপ্রাণ এই মানুষটি ১৯৬৯ সালে লড়াকু ছাত্রনেতা থেকে একাত্তরে মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু দেশ স্বাধীন করার পরও নিজের জীবনে সচ্ছলতা ভোগ-সুখ-পরিবর্তন কিছুই আসেনি। দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করার সংগ্রামে আপসহীন। কালোবাজারিদের বিরুদ্ধে নতুন করে লড়াই-সংগ্রামের পথে রানার মতো ছাত্র-যুবদের অনেককে পাশে পেয়ে যায়।
ছবিটি মুক্তির আগে বেশ কয়েকটি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্রে দেশপ্রেমী মুক্তিযোদ্ধার অভিনয় করেন আনোয়ার হোসেন—এই চলচ্চিত্রে শহীদ আশরাফ চরিত্রেও তিনি যথাযথ। রানা চরিত্রে রাজ্জাক, আলো চরিত্রে ববিতা, আলিম চরিত্রে খলিলউল্লাহ, আলিমের স্ত্রী মীনা চরিত্রে রোজী আফসারী, আলোর দাদু নারায়ণ চক্রবর্তী, রানার প্রেমিকা দিনার চরিত্রে সুজাতা—সবার অভিনয় ছিল মনে রাখার মতো।
‘আলোর মিছিল’ ছবিতে রাজ্জাক ও ববিতাকে মামা-ভাগনি চরিত্রে দেখা গেছে। তবে এর আগে রাজ্জাকের বিপরীতে নায়িকা ছিলেন তিনি। তবে ববিতার শুরুটা হয়েছিল সংসার ছবিতে রাজ্জাকের মেয়ের চরিত্রে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে। পরে বেশ কয়েকটি ছবিতে রাজ্জাক-ববিতা জুটি হিসেবে জনপ্রিয় হন। প্রতিষ্ঠিত রোমান্টিক জুটিকে নারায়ণ ঘোষ মিতা পর্দায় উপস্থাপন করলেন অন্যভাবে। গতকাল বুধবার বিকেলে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা হয় ববিতার। জানালেন, খুব সম্ভবত ১৯৭৩ সালে ছবিটির শুটিং করেছিলেন। তিনি বললেন, ‘আমার বয়স তখন ১৭ বছর হবে। গেন্ডারিয়াতে থাকতাম। ছবিতে অভিনয়ের প্রস্তাব নিয়ে মিতা সাহেব বাড়িতে এলেন। গল্প বললেন। শুনে এত ভালো লাগল যে বলে বোঝাতে পারব না। কিন্তু পরিবার, শুভাকাঙ্ক্ষী ও চলচ্চিত্রের সবাই বলতে লাগল, তুমি রাজ্জাকের নায়িকা চরিত্রে অভিনয় করেছ। ‘টাকা আনা পাই, ‘পিচ ঢালা পথ’ ও ‘শেষ পর্যন্ত’ সুপার ডুপার হিট হয়েছে, সেখানে কেন তুমি রাজ্জাক ভাইয়ের সঙ্গে মামা-ভাগনির চরিত্রে অভিনয় করছ? ছবিতে নায়ক-নায়িকা রাজ্জাক ভাই ও সুজাতা ম্যাডাম। এই ছবিতে তুমি যদি ভাগনি হও, এরপর ওই ছবিতে নায়িকা হিসেবে থাকলে কেউ তোমাকে রাজ্জাকের নায়িকা হিসেবে মেনে নেবে না। সবার কথা শুনেছি, যখন সিদ্ধান্ত নেওয়ার পালা, তখন ভাবলাম—এই ছবিটা আমার করা উচিত। কারণ, এটা অসাধারণ দেশাত্মবোধের ছবি।’
এক নজরে
চিত্রনাট্য ও পরিচালনা: নারায়ণ ঘোষ মিতা
প্রযোজনা: ঝর্ণা পিকচার্স
গান গেয়েছেন: আবদুল জব্বার, সাবিনা ইয়াসমীন, খন্দকার ফারুক আহমেদ
কাহিনি ও সংলাপ: ইসমাইল মোহাম্মদ
চিত্রগ্রহণ: রফিকুল বারী চৌধুরী
সংগীত: সত্য সাহা
গীতিকার: মুস্তাফিজুর রহমান
নৃত্য: গওহর জামিল
পরিবেশনা: চিত্রলোক
কথায় কথায় ববিতা বললেন প্রথম দিনের শুটিংয়ের কথা। বললেন, ‘আমার বেশির ভাগ অংশের শুটিং হয়েছিল এফডিসিতে। খুব সম্ভবত এক নম্বর ফ্লোরে প্রথম দিন কাজ করেছি। সেট বানিয়ে বাড়ির সব দৃশ্য ধারণ করা হয়। ছবির শুটিংয়ে আমি যখন শট দিতে গিয়েছি, দেখতাম, চোখে কোনো গ্লিসারিন দিতে হতো না। এমনভাবে দৃশ্য বুঝিয়ে দিতেন, চোখ দিয়ে টপ টপ করে পানি পড়ত।’ প্রথম দিন কোন দৃশ্যের শুটিং করেছেন, জানতে চাইলে বললেন, ‘নিচতলা থেকে দোতলায় ট্রেতে করে চা নিয়ে যাওয়ার একটা দৃশ্য ছিল। সবাই ঘুমাচ্ছিল, প্রত্যেককে ডেকে ডেকে ঘরে চা দিচ্ছি।
একবারেই শটটি ওকে হয়।’ এই ছবির জন্য শাস্ত্রীয় নৃত্যও শিখতে হয়েছিল বলে জানালেন। মুক্তির পর ছবিটি মধুমিতা প্রেক্ষাগৃহে ভাইবোনসহ পরিবারের কয়েকজনকে নিয়ে উপভোগ করেছিলেন বলেও জানালেন। ববিতা বললেন, ‘বোরকা পরে দেখতে গিয়েছিলাম। আমার মারা যাওয়ার দৃশ্যে, ওভারলেপে একটা সংলাপ ছিল, “মামা যাসনে।” এদিকে রাজ্জাক ভাই বলছেন, ভাবি, আমাকে বিদায় দাও, আলোকে কবরস্থানে নিয়ে যেতে হবে। মাটি দেওয়া হবে। “মামা যাসনে” সংলাপ বলার পর হলের সবাই হাউমাউ করে কেঁদেছে।’
কথা হয় সুজাতার সঙ্গেও। তিনি রাজ্জাকের প্রেমিকা দিনা চরিত্রে অভিনয় করেন। তিনি বললেন, ‘এই সিনেমায় অভিনয়ের সুযোগ পেয়ে আমি খুব তৃপ্ত ছিলাম। নারায়ণ ঘোষ মিতা অনেক বড়মাপের পরিচালক ছিলেন। বড় বড় অভিনেতা-অভিনেত্রী এই ছবিতে অভিনয় করেন। আজিম সাহেবের পর রাজ্জাকের সঙ্গে আমার বেশ কিছু সিনেমা হিট হয়। ‘আলোর মিছিল’ও সেই রকম সফল একটি সিনেমা। মজুতদার বাবার বিরুদ্ধে আমি অন্যায়ের প্রতিবাদ করি। এ ছবিতে ববিতাও অভিনয় করেছে। দুই নায়িকা কাজ করলে নাকি প্রতিযোগিতা হয়, তেমন কিছুই ছিল না আমাদের মধ্যে। ও আমার জুনিয়র, শুটিংয়ে তাই স্নেহ করতাম।’
নারায়ণ ঘোষ মিতা ষাটের দশকে চলচ্চিত্রে নির্মাণ শুরু করেন। এই দশকের শেষ দিকে পারিবারিক টানাপোড়েন ঘিরে তিনি নির্মাণ করেন ‘এতটুকু আশা’ ছবিটি। পরের বছর নির্মাণ করেন ‘নীল আকাশের নিচে’। ‘আলোর মিছিল’ ছবিটি যাঁরা দেখতে চান, চাইলেই ইউটিউবে ঢুঁ মেরে দেখে নিতে পারেন।