রাজ তিলকে নতুন ‘হাওয়া’
রাজশাহী শহরের শেষ সিনেমা হলটি বন্ধ হয়ে যায় ২০১৮ সালের ১২ অক্টোবর। এরপর বন্ধ হয় পবা উপজেলার বাবুল হল। পুরো রাজশাহী জেলা হয়ে পড়ে সিনেমা হলশূন্য।
কিন্তু এর মধ্যে ঢাকাই চলচ্চিত্রের প্রতি নতুন করে দর্শকের টান বেড়েছে। সিনেমা দেখার জন্য দর্শক রাজশাহী থেকে পার্শ্ববর্তী জেলার হলগুলোতে ছুটছেন। তাঁরা সিনেমা হলের দাবি জানিয়েছেন। এবার আর তাঁদের অন্য কোনো জেলাতে যেতে হবে না। রাজশাহী শহরের উপকণ্ঠে পবা উপজেলার কাটাখালীতে চালু হচ্ছে ‘রাজ তিলক’। আজ শুক্রবার ‘হাওয়া’ দিয়ে শুরু হচ্ছে হলটির যাত্রা। ইতিমধ্যে সিনেমা প্রদর্শনের যাবতীয় কাজ শেষ করেছে কর্তৃপক্ষ।
রাজ তিলক হলে সর্বশেষ ২০১২ সালে সিনেমা প্রদর্শন করা হয়। এর পর থেকে হলটি বন্ধ হয়ে পড়ে ছিল। সম্প্রতি মালিকের কাছ থেকে পাঁচ বছরের জন্য ভাড়া নিয়েছেন দিনাজপুরের ফুলবাড়িয়া এলাকার সাজ্জাদ হোসেন। তিনি মূলত চলচ্চিত্রে ‘প্রোডাকশন ম্যানেজার’ হিসেবে কাজ করেন। থাকেন ঢাকায়। তিনি হলটি চালুর উদ্যোগ নেন। গত বছরের অক্টোবর থেকে হলটি সংস্কারে টানা কাজ করেছেন তিনি।
হল চালুর খবরে কাটাখালীতে হলটির সামনে দর্শকের আনাগোনা শুরু হয়ে গেছে। ছোট–বড় অনেকেই হলটিতে সিনেমা দেখার জন্য মুখিয়ে আছেন। ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়কের পাশে কাটাখালী পৌর এলাকায় হলটির সামনে গিয়ে দেখা যায়, ঝাড়বাতি দিয়ে সাজানো হয়েছে পুরো হল। হলজুড়ে হাওয়ার পোস্টার।
একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিশু মায়েশা পোস্টার দেখে সহপাঠীদের বলে উঠল, ‘এই যে চঞ্চল চৌধুরী। আমি সিনেমা দেখব।’ উপরে কয়েক বছর ধরে ‘রাজ তলক’ হয়ে থাকা হলটির নাম ‘রাজ তিলক’ করা হয়েছে। হলটির সামনে বড় করে ব্যানারে ‘সুখবর’ জানিয়ে লেখা আছে, ‘রাজ তিলক। রাজশাহীতে একমাত্র সিনেমা হল। উদ্বোধন আজ। সম্পূর্ণ ডিজিটাল সিনেমা হল। সব সিনেমাপ্রেমী দর্শকদের জন্য আমন্ত্রণ রইল।’
হলটির সামনে ১০ বছর আগে সিনেমা দেখা সাব্বিরের (২৪) সঙ্গে কথা হয়। কাটাখালীর বাসিন্দা সাব্বির বলেন, সেই ছোটকালে হাফপ্যান্ট পরে সিনেমা দেখেছি। এই হলে সিনেমা দেখার জন্য মুখিয়ে আছি। এ এ কে এম শামসুজ্জামান বলেন, শুক্রবার হাওয়ায় ভাসতে চান তাঁরা।
এখানেই পাওয়া গেল টানা ১৭ বছর হলটিতে টিকিট চেকারের দায়িত্ব পালন করা নাজমুল হকের ছেলে মোস্তাফিজুর রহমানকে (২৭)। তিনি বলেন, চলচ্চিত্রের সোনালি দিনে বাবা এত ব্যস্ত থাকতেন যে বাবাকে সব সময় সিনেমা হলে দেখেই বড় হয়েছেন। হলটি চালু হওয়ায় আবার কাজে ফিরতে চান তাঁর বাবা।
হলটির পাশেই কোমল পানীয় ও পান বিক্রি করেন মো. ডলার। তিনি বলেন, হলটি চালু হওয়ার তারিখ ঘোষণার পর থেকেই মানুষ আসা শুরু করেছেন। বাইরের লোকজন সিনেমা দেখতে এলে এই পৌরসভা আবার জমে উঠবে। ব্যবসায়ীদের ব্যবসা ভালো হবে।
১৯৯৮ সাল থেকে হলটির সঙ্গে আছেন আক্কাস আলী। তিনি এই হলের গেটম্যান হিসেবে কাজ করেছেন। এবারও হলটির নানা কাজ করছেন। তবে এখনো নির্দিষ্ট দায়িত্ব বুঝে পাননি। সিনেমা হলটির ইতিহাস নিয়ে তিনি বলেন, নওগাঁর আজিজ খান নামের এক ব্যক্তি হলটি নির্মাণ করেছিলেন। পরে ঢাকার শহিদুল হক সিকদার নামের এক ব্যক্তি হলটি কিনে নেন। তাঁর কাছ থেকে হলটি কিনে নেন রাজশাহীর রানা ও দুলু নামের দুই ভাই। তাঁদের কাছ থেকে আনোয়ারুল হক নামের আরেকজন হলটি কিনে নেন। সর্বশেষ ২০১২ সালে ‘কমন জেন্ডার’ সিনেমা চলাকালে হলটি বন্ধ হয়ে যায়। তখন চাঁপাইনবাবগঞ্জের রুম্মান আলী হলটি কিনে নেন। এরপর আর হলটি চালু হয়নি।
হলটির বর্তমান মালিক সাজ্জাদ হোসেন বলেন, সিনেমা ও সিনেমা হলের প্রতি ভালোবাসা থেকে সুন্দর করে এটিকে তিনি ঠিক করেছেন। ঠিক করতে কোনো কিছুতে কমতি রাখেননি। সবকিছু ডিজিটাল করেছেন।
টিকিটে টাকার ব্যবধান থাকলেও সিটের ভেদাভেদ রাখেননি। টিকিট ক্লাস থাকবে তিনটি—রিয়াল স্টল, ডিসি সার্কেল ও আপার ক্লাস। টিকিটের দামের ব্যবধানও খুব বেশি হবে না। হলটিতে সব মিলে একসঙ্গে পাঁচ শতাধিক দর্শক সিনেমা দেখতে পারবেন। তিনি উদ্বোধনের দিনে বিশেষ কোনো কর্মসূচি রাখেননি। দর্শকই এসে হলটি উদ্বোধন করবেন।
রাজশাহী ফিল্ম সোসাইটির সভাপতি আহসান কবির বলেন, সিনেমা হল চালুর খবরটি বর্তমান সময়ের সবচেয়ে ভালো খবরের মধ্যে একটি। গণমানুষের বিনোদনের মাধ্যমই হলো সিনেমা হল। এটা সিনেপ্লেক্স নয়। সেখানে সবাই যেতে পারেন না। সিনেমা হলে সব শ্রেণির মানুষ যেতে পারেন। এটি রাজশাহীর মানুষের জন্য আনন্দের খবর।