‘পরাণ’, ‘হাওয়া’, তারপর...
গত চার মাসে ১৫টির মতো বাংলা সিনেমা মুক্তি পেলেও একটাও সেভাবে ব্যবসা করতে পারেনি। লোকসান গুনছে সিংহভাগ সিনেমা। সিনেমাগুলোর প্রযোজক ও পরিচালকেরা বলছেন, চলমান অর্থনৈতিক সংকট, রাজনৈতিক পরিবেশ ও বড় বাজেটের কিছু সিনেমার কারণেই এ ব্যর্থতা। অন্যদিকে পরিবেশক ও অন্যরা বলছেন, ভালো গল্প, উপস্থাপনা ও জুতসই নির্মাণ, সঙ্গে প্রচারণা না থাকায় ছবিগুলো দর্শক হারিয়েছে।
পবিত্র ঈদুল আজহায় মুক্তি পেয়ে আলোচনায় এসেছিল ‘পরাণ’। একসঙ্গে ‘দিন: দ্য ডে’ ও ‘সাইকো’ মুক্তি পেলেও দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে পরাণ ছাড়া অন্য দুই সিনেমা সেভাবে সাড়া জাগাতে পারেনি। তারপর ‘হাওয়া’র ঢেউয়ে উড়তে থাকে ঢালিউড।
গত তিন মাসে ১৫টির বেশি নতুন সিনেমা মুক্তি পেয়েছে। সিনেমাগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘বিউটি সার্কাস’, ‘অপারেশন সুন্দরবন’, ‘আশীর্বাদ’, ‘রোহিঙ্গা’, ‘রাগী’, ‘হৃদিতা’, ‘বীরত্ব’, ‘ঈশা খাঁ’, ‘যাও পাখি বলো তারে’, ‘দামাল’, ‘বসন্ত বিকেল’, ‘কুড়া পক্ষীর শূন্যে উড়া’, ‘ভাইয়ারে’, ‘ভাঙন’ ও ‘দেশান্তর’। এসব সিনেমায় মৌসুমী, রিয়াজ, জয়া আহসান, অপু বিশ্বাস, শরীফুল রাজ, সিয়াম, বিদ্যা সিনহা মিম, ইমন, নুসরাত ফারিয়া, রোশান, পূজা চেরির মতো তারকারা ছিলেন।
পরাণ ও হাওয়ার পরে প্রচারণায় সাড়া জাগায় ‘অপারেশন সুন্দরবন’ ও ‘বিউটি সার্কাস’। কিন্তু প্রেক্ষাগৃহে মুক্তির পর সিনেমা দুটি তেমন ব্যবসা করতে পারেনি, জানালেন মাল্টিপ্লেক্স, যশোরের মণিহারসহ কয়েকটি হলের কর্তাব্যক্তিরা। পরে ‘হৃদিতা’, ‘আশীর্বাদ’ সিনেমাগুলোও দর্শক ধরে রাখতে পারেনি। অন্যদিকে ‘পরাণ’খ্যাত পরিচালক রায়হান রাফির ‘দামাল’ও প্রত্যাশা অনুযায়ী ব্যবসা করতে পারেনি। ‘দামাল’ নিয়ে রায়হান রাফি বললেন, ‘সেই অর্থে পরাণ-এর মতো সাড়া পাইনি। তবে সিনেপ্লেক্সে ব্যবসা করেছে। প্রত্যাশা আরও বেশি ছিল।’
চার মাসে মুক্তি পাওয়া সিনেমাগুলো নিয়ে হতাশা ব্যক্ত করলেন পরিবেশক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আওলাদ হোসেন, ‘ভালো গল্প, পরিপূর্ণ বিনোদনের সিনেমা গত চার মাসে ছিল না। তা ছাড়া গল্পে সমসাময়িক প্রসঙ্গ নেই। বাজেট ও তারকার দোহাই দিয়ে গল্পে পিছিয়ে থাকলে এখন দর্শক পাওয়া যাবে না। এতে শুধু সিনেমার সংখ্যা বাড়বে। হল বাঁচবে না। এখন দর্শকরুচি বদলে গেছে।’
মুক্তি পাওয়া সিনেমাগুলোর মধ্যে ৩৪টি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেয়েছিল ‘বীরত্ব’; ‘ঈশা খাঁ’ ১৮, ‘যাও পাখি বলো তারে’ ৩০, ‘বসন্ত বিকেল’ ১৯,‘ রোহিঙ্গা’ ১১টি হলে। অনেক সিনেমাই পরের সপ্তাহে আগের মতো হল ধরে রাখতে পারেনি। দ্বিতীয় সপ্তাহে সিনেমাগুলো নিয়ে হলমালিকেরাও আশাহত হন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে মণিহার হলের এক কর্তাব্যক্তি বলেন, তিন–চার দিন পরই কিছু ছবির আওয়াজ শেষ হয়ে যায়।
মুক্তির পর হলসংখ্যা কমার কারণ হিসেবে বীরত্ব সিনেমার পরিচালক সাইদুর রহমান বলেন, ‘আমাদের পরিবেশকদের কারণে পরের সপ্তাহে হলসংখ্যা ধরে রাখতে পারিনি। পরের সপ্তাহে অপারেশন সুন্দরবন-এর জন্য আমাদের অনেক হল মিস হয়ে গেছে। পরিবেশকেরা ব্যর্থ হলে আমাদের ব্যবসায়িকভাবে ক্ষতির মুখে পড়া ছাড়া কিছু করার থাকে না। পরপর দুই সপ্তাহ চললে আমরা আরও বেশি সাড়া পেতাম।’
স্টার সিনেপ্লেক্সে পরাণ, হাওয়া, অপারেশন সুন্দরবন, দামাল এখনো চলছে। স্টার সিনেপ্লেক্সের জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক মেজবাহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘সব সিনেমাতে এক রকম সাড়া পাওয়া যায় না। সব সিনেমা হিটও হবে না। পরাণ, হাওয়ার পর আমরা সে রকম সিনেমা পাইনি। অপারেশন সুন্দরবন নিয়ে কিছুটা আশাবাদী হয়েছিলাম। কিন্তু ব্যবসা গড়পড়তা। দামাল প্রথম সপ্তাহে স্লো গিয়েছে, এখন আবার কিছুটা ভালো করছে। সেটাও আরও সন্তোষজনক আশা করেছিলাম। কিন্তু হাওয়া, পরাণ-এর মতো কোনো সিনেমাই ব্যবসা করতে পারেনি।’
১১ নভেম্বর সমাজের ভাসমান মানুষের জীবনের গল্প নিয়ে মুক্তি পেয়েছিল মৌসুমীর ভাঙন। এ সিনেমাও তেমন দর্শক টানতে পারেনি। সিনেমাটির পরিচালক শাখাওয়াত মানিক বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে দেশের মানুষ উদ্বিগ্ন। শুধু ভাঙন নয়, কোনো সিনেমাই দর্শক দেখছে না। মানুষের মুখে মুখে এখন ২০২৩ সালের অর্থনৈতিক সংকট। এখন বিনোদনের জন্য কয়জন সিনেমা দেখবেন।’
সিনেমা পরিচালক ও বিশ্লেষক মতিন রহমান মনে করেন, ‘হাওয়া, পরাণ-এর মতো বছরে অন্তত ছয়টি ছবি দরকার। তাহলে হল চাঙা থাকবে। আর এ দুই সিনেমা আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছে, সিনেমা হিট হওয়ার জন্য বড় তরকা বা বাজেটের দরকার নেই। দরকার গল্প ও পরিকল্পনা।’