মৃত্যুর পর ফারুকের প্রথম জন্মদিন, কাঁদলেন স্ত্রী
গেল বছরের এই দিনেও তিনি ছিলেন। অসুস্থ অবস্থায় সিঙ্গাপুরের হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন নায়ক ও সংসদ সদস্য ফারুক। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে থাকা নায়ককে সেদিন জানানো হয় জন্মদিনের ফুলেল শুভেচ্ছা। অসুস্থ বাবাকে এদিন সারপ্রাইজ দিতে মা ফারহানা পাঠান দুই ছেলে–মেয়েকে জন্মদিনের ঠিক সপ্তাহখানেক আগে নিয়ে যান সিঙ্গাপুরে। ফারুকও তাঁর দুই সন্তানকে পেয়ে চমকে গিয়েছিলেন।
আজ নায়ক ফারুক অনতিক্রম দূরত্বে। জন্মদিনে তাঁকে শুভেচ্ছা জানানোর সুযোগ আর নেই। গত ১৫ মে তিনি অনন্তের পথে পড়ি জমিয়েছেন। গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলার তুমলিয়া ইউনিয়নের দক্ষিণসোম টিওরী কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের পাশের কবরস্থানে চিরঘুমে আছেন তিনি। চিরদিনের জন্য হারিয়ে ফেলা ফারুকের জন্মদিনে মন খুব বিষণ্ন স্ত্রী, দুই সন্তানসহ পরিবারের সবার। স্বামীর প্রসঙ্গ উঠতেই কাঁদছিলেন তিনি। কোনোভাবেই নিজের আবেগ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছিলেন না। চিরদিনের জন্য হারিয়ে ফেলা মানুষটিকে নিয়ে বললেন, ‘এই মানুষটা কিন্তু আমার বুকের মধ্যেই আছে।’
জন্মদিনে কেক কাটতে পছন্দ করতেন না আকবর হোসেন পাঠান ফারুক। কারণ, হিসেবে তাঁর স্ত্রী বলেন, ‘১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ডের পর থেকে কোনো দিন নিজের জন্মদিনে কেক কাটেনি ফারুক। তিন দশকের বেশি সংসার করছি, কখনো কেক কাটতে দেখিনি।’
বেঁচে থাকলে আজ ৭৫ বছর পার করতেন ফারুক। চিত্রনায়ক ফারুক সবার কাছে মিয়া ভাই হিসেবে বেশি পরিচিত ছিলেন। সবার কাছে যিনি ‘মিয়া ভাই’, সেই তিনি ফারহানা পাঠানের কাছে কী—জানতে চাইলে এই দিনে বললেন, ‘বাস্তবের মিয়া ভাই, আমার ভীষণ আদরের। ও হলো আমার চোখের মণি। ও হলো আমার জান। ও হলো আমার মানিক। এই মানুষটাই আমার বুকের মধ্যে আছে। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করি, সিঙ্গাপুরে দুইটা বছর বা আড়াই বছর এই মানুষটার সেবা করার সুযোগ পেয়েছি। এই সময়টাতে কোনো কষ্টই কষ্ট মনে হয়নি। আমি ফারুককে সেবা করতে পেরেছি, এটাই বড় আনন্দ ছিল। ওর হাসিটা ছিল অনেক সুন্দর। চেহারাটা দেখলেই মন ভরে যেত।’
অভিনয় দিয়ে সবার নজর কেড়ে নেওয়া ফারুক পরবর্তী সময়ে চলচ্চিত্র প্রযোজনাও করেন। এরপর ব্যবসায়ী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। ছিলেন পুরোদস্তুর একজন রাজনীতিবিদ। আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে ফারুক থেকেছেন আমৃত্যু। ছাত্রজীবন থেকে দলটির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ডাকে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধেও অংশ নেন। মৃত্যুর আগপর্যন্ত ঢাকা-১৭ আসনের সংসদ সদস্য ছিলেন। আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকটি অঙ্গসংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন। এর মধ্যে বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি ছিলেন ফারুক।
১৯৭৫ সালের পর থেকে মৃত্যুর আগপর্যন্ত কোনো বছরই নিজের জন্মদিন পালন করেননি ফারুক। ২০২০ সালের জন্মদিনে নিজেই সেই কারণ জানিয়েছিলেন অভিনেতা। ফারুকের কথায়, ‘আগস্ট শোকের মাস। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট রাতে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবার নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। সেই কালো রাতের পর থেকে বাঙালি জাতির জন্য এই মাস শোক আর বেদনার। পঁচাত্তরের ঘটনার পর আমার জীবন থেকে জন্মদিন পালন তুলে নিয়েছি। আমি ৪৫ বছর ধরে জন্মদিনের কেক কাটি না।’
চলচ্চিত্রে তাঁর পাঁচ দশকের বেশি সময়ের ক্যারিয়ার। এই সময়ে তিনি অভিনয় করেন বহু দর্শকপ্রিয় চলচ্চিত্রে। ফারুকের অভিনীত ‘মিয়া ভাই’ চলচ্চিত্রের সাফল্যের পর তিনি চলচ্চিত্রাঙ্গনে ‘মিয়া ভাই’ হিসেবে খ্যাতি পান। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ নানা সম্মাননায় ভূষিত হন নন্দিত এই চিত্রনায়ক। অভিনয় থেকে অবসর নেওয়ার পর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে ঢাকা-১৭ আসন থেকে প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি।
এইচ আকবর পরিচালিত ‘জলছবি’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে চলচ্চিত্রজগতে ফারুকের অভিষেক ঘটে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই তিনি চলচ্চিত্রে অভিনয় শুরু করেছিলেন। ১৯৭১ সালে মুক্তি পায় তাঁর অভিনীত প্রথম ছবি ‘জলছবি’। চলচ্চিত্র অঙ্গনে নায়ক ফারুক কিংবা মিয়া ভাই নামে পরিচিত হলেও তাঁর আসল নাম আকবর হোসেন পাঠান দুলু। ‘ফারুক’ নামটি মূলত ছিল চলচ্চিত্র অঙ্গনের। অভিনেতা এ টি এম শামসুজ্জামান, পরিচালক এইচ আকবর ও ফারুক নামের এক বন্ধু মিলে তাঁকে এই নাম দিয়েছিলেন। সেই থেকে ‘ফারুক’ নামেই পরিচিতি পান।
চলচ্চিত্রের নায়কের নাম ছোট হয়, এটা ছিল নামবদলের একটি কারণ। তবে আসল কারণও ছিল অন্য। সেটা অভিনেতা নিজেই জানিয়ে ২০১৬ সালে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘ছয় দফা আন্দোলনের পর আমি ওয়ান্টেড ছিলাম, যে কারণে নাম দিয়ে দিল ফারুক। ওরা বলল, এই নামে তোমাকে প্রথমে কেউ ধরবে না। দ্বিতীয়ত, চলচ্চিত্রের নামগুলো ছোট হলে ভালো হয়, সুন্দর হয়—যেমন রাজ্জাক, উজ্জ্বল, ফারুক, আলমগীর, শাবানা; নাম ছোট হলে ক্যাচি হয়।’
ফারুকের জন্ম ১৯৪৮ সালের ১৮ আগস্ট। বাবা আজগার হোসেন পাঠানের ছিলেন পাঁচ মেয়ে ও দুই ছেলে। ফারুক ছিলেন ভাইদের মধ্যে সবার ছোট। আগেই বলা হয়েছে, তাঁর প্রথম ছবিটি পরিচালনা করেন এইচ আকবর। প্রথম ছবিতে তাঁর বিপরীতে অভিনয় করেন কবরী। এ জুটিই করেছিলেন ‘সুজন সখী’ ছবিটি। কবরী ও ফারুক জুটি একসময় খুবই জনপ্রিয় ছিল। ছাত্রজীবন থেকে রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন ফারুক। বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে ফারুক জানিয়েছেন, ১৯৬৬ সালে ছয় দফা আন্দোলনে যোগ দেন তিনি। ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলন, সত্তরের নির্বাচন ও একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। যুদ্ধ থেকে ফিরে চলচ্চিত্রে মনোযোগ দেন।
১৯৭৩ সালে মুক্তি পায় খান আতাউর রহমান পরিচালিত ফারুক অভিনীত ‘আবার তোরা মানুষ হ’। ১৯৭৫ সালে মুক্তি পায় নারায়ণ ঘোষ মিতার ‘লাঠিয়াল’। এ ছবিতে ফারুকের চরিত্রটি সাড়া ফেলে। সে সময় থেকে গ্রামীণ পটভূমির চলচ্চিত্রে তাঁর আলাদা পরিচিতি পান তিনি। একই বছর মুক্তি পায় খান আতার আরেক সিনেমা ‘সুজন সখী’। গ্রামীণ পটভূমির গল্পে নির্মিত এ ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্র গ্রামীণ তরুণ সুজনের ভূমিকায় ফারুকের নামডাক ছড়িয়ে পড়ে। পরের বছর ১৯৭৬ সালে মুক্তি পায় আমজাদ হোসেনের ‘নয়নমণি’। এটিও সাড়া ফেলে। ১৯৭৮ সালে মুক্তি পায় শহীদুল্লা কায়সারের কালজয়ী উপন্যাস অবলম্বনে আবদুল্লাহ আল মামুনের সিনেমা ‘সারেং বৌ’। সিনেমায় কদম সারেং চরিত্রে জীবনঘনিষ্ঠ অভিনয়ের জন্য ক্ল্যাসিক অভিনেতা হিসেবে গণ্য হন।
আমজাদ হোসেনের ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’ ছবিতে মিলন চরিত্রে ফারুকের অভিনয় দর্শকমনে দাগ কাটে। অভিনয়গুণেই মানিকগঞ্জে জন্ম নেওয়া দুলু নায়ক ফারুক আত্মপ্রকাশ করেন। এরপর তিনি সবার প্রিয় ‘মিয়া ভাই’ হিসেবে পরিচিতি পান। প্রথম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান ১৯৭৫ সালে। নারায়ণ ঘোষ মিতা পরিচালিত বিখ্যাত ‘লাঠিয়াল’ সিনেমায় অভিনয় করার কারণে শ্রেষ্ঠ পার্শ্বচরিত্র ক্যাটাগরিতে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান। ২০১৮ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে আজীবন সম্মাননা অর্জন করেন তিনি।