সাফল্য ধরে রাখতে মূলধারার বাণিজ্যিক ছবির বিকল্প নেই
কেউ বলছেন চলচ্চিত্রে সুবাতাস বইছে। কেউবা নতুন দিনের ইঙ্গিতও বলছেন। কারণ, লম্বা সময় পর মাস খানেকের বেশি সময় ধরে দেশের প্রেক্ষাগৃহ দর্শকপূর্ণ। পরাণ ও হাওয়া—এই দুটি চলচ্চিত্র যাঁরাই দেখছেন, বেশির ভাগই দেশীয় চলচ্চিত্রের নতুন দর্শক। এখনো আগ্রহ নিয়ে দর্শক ছবি দুটি দেখছেন। কাছাকাছি সময়ে এমন আগ্রহ দেশের চলচ্চিত্রের দর্শকের ক্ষেত্রে দেখা যায়নি। চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এই সুবাতাস কত দিন বইতে থাকে, সেটাও দেখার বিষয়। কারণ হিসেবে তাঁরা বলছেন, ভিন্নধারার ছবি দিয়ে হঠাৎ সুবাতাস বইলেও তা হঠাৎই থেমে যেতে পারে।
সারা বছর দেশের প্রেক্ষাগৃহগুলো সচল থাকে মূলধারার বাণিজ্যিক চলচ্চিত্র দিয়ে। তাই তো মূলধারা ও স্বাধীন ধারার চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সবারই মত, মূলধারার ছবি তৈরিতে আগের চেয়ে বেশি যত্ন নিতে হবে। একই সঙ্গে স্বাধীন ধারার চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে লগ্নি ফেরত আনার মতো ছবি বানাতে হবে। তবেই এসব ছবির প্রযোজকেরাও স্থায়ীভাবে ছবি বিনিয়োগে আস্থা পাবেন।
সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে হিট ছবি পরাণ। অর্ধকোটি টাকার কম বাজেটের এ ছবি কয়েক গুণ বেশি টাকা নিজেদের ঘরে তুলেছে। প্রযোজক, পরিচালক ও প্রেক্ষাগৃহ কর্তৃপক্ষ সূত্রে তেমনটাই জানা গেছে। প্রযোজক এরই মধ্যে নতুন চলচ্চিত্রে বিনিয়োগের ইচ্ছা পোষণও করেছেন। তবে ছবিটি একেবারে আমজনতার কাছে যেতে পারেনি বলে মত দিয়েছেন পরিচালক রায়হান রাফি। এটার বড় একটা কারণ হিসেবে বললেন, দেশের বিভিন্ন প্রান্তের প্রেক্ষাগৃহে দর্শককে ছবিটি দেখানো সম্ভব হয়নি।
রায়হান রাফি বললেন, ‘ইন্ডাস্ট্রির জন্য ‘পরাণ’ও দরকার। কারণ, এই ছবির মাধ্যমে আমরা নতুন ফ্যামিলি অডিয়েন্স পেয়েছি। তবে এটা অস্বীকার করার উপায় নেই, আমজনতাকে ধরতে পারিনি। আমরা আরবান এরিয়াতে বেশ ভালো ছিলাম, রুরালে অতটা না। আমজনতা, আরবান ও রুরাল দর্শককে ধরতে শাকিব খানের বিকল্প নেই। মধুমিতা ও সিনেপ্লেক্সে শাকিব খানের দর্শক যেমন আছে, তেমনি আরেকটা বড় দর্শকও আছে, যাদের এসি লাগে না, তারা শুধু পর্দা দেখতে পারলেই হলো। তাদের আমরা রিচ করতে পারিনি। তারা অ্যাগ্রেসিভ অডিয়েন্স। তাদের গরম পানিতে চুবায়ে রাখলেও শাকিব খানের সিনেমা দেখবে। এ ধরনের অডিয়েন্সসহ পেতে হলে শাকিব খান ছাড়া বিকল্প নেই, তিনি আমাদের দেশের বিগ সুপারস্টার।’
কথায়–কথায় রায়হান রাফি এ–ও জানিয়ে রাখলেন, তাঁর পরিচালিত পরের ছবি ‘দামাল’ নিয়ে এরই মধ্যে হইচই শুরু হয়েছে। প্রেক্ষাগৃহ কর্তৃপক্ষের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে ছবিটি আছে। এরই মধ্যে সামনের ঈদের ছবির পরিকল্পনাও করছেন তিনি, যে ছবি আমজনতার হবে। রাফি বললেন, ‘হলমালিকেরা যখন ব্যবসা করে, তখন ধারাবাহিকভাবে ভালো মানের গল্পের ছবি লাগে। আবার কিন্তু ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। ছবি যখন থাকবে না, তখন নোংরামি শুরু হবে। যেমনটা হচ্ছে আশীর্বাদ নিয়ে, যা কখনোই কাম্য নয়। তাই সবাই মিলে পরিকল্পনা করে ছবি মুক্তি দিতে হবে।’
বিশ্বের বড় বড় চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রি সিনেমা নির্মাণের জন্য যতটা যত্নশীল, তা প্রচার–প্রচারণার জন্য ততটাই গুরুত্ব দিয়ে থাকে। একসময় ঢালিউডেও সিনেমা হলে দর্শক ফেরাতে বর্ণাঢ্য প্রচারণার ব্যবস্থা করা হতো। কিন্তু নতুন দশকে প্রচারণার চিত্র চলচ্চিত্রপাড়া থেকে বলতে গেলে উধাও হয়ে গিয়েছিল। এখন তা আবার বাড়তে শুরু করেছে। ছবিসংশ্লিষ্ট সবাই ছুটে চলছেন এক সিনেমা হল থেকে অন্য সিনেমা হলে, এক জেলা থেকে অন্য জেলায়। রাতদিন নির্ঘুম ব্যস্ত তাঁরা ছবির প্রচারে। প্রযোজক, পরিচালক ও শিল্পীরা এর সুফল ভোগ করছেন। ভালো ছবি বানানোর পাশাপাশি তাই পরিকল্পনা করে প্রচারণাটাও জরুরি মনে করছেন নাট্যজন নাসির উদ্দীন ইউসুফ। একই সঙ্গে ছবি মুক্তি নিয়ে ঝগড়া–বিবাদ না করে প্রযোজক, পরিচালক, পরিবেশক ও হলমালিকদের একসঙ্গে বসে সমঝোতার মাধ্যমে মুক্তির কথা ভাবতে হবে বলেও জানালেন তিনি।
আগেও নাসির উদ্দীন ইউসুফ বলেছেন, মূলধারার বাণিজ্যিক চলচ্চিত্র ভালো করলে স্বাধীন ধারার চলচ্চিত্রগুলোও ভালো করবে। এই কথার সূত্র ধরে তিনি বললেন, ‘ছবি ভালো হওয়ার পাশাপাশি প্রেক্ষাগৃহের পরিবেশও ভালো থাকতে হবে। প্রেক্ষাগৃহ যদি এয়ারকন্ডিশনড হয়, তাহলে দর্শক হাওয়া খেতে কিংবা আড্ডা দিতে হলেও যাবে। আমরা গরমের মধ্যে দর্শককে রীতিমতো সেদ্ধ বানিয়ে ছবি দেখাই, এটা তো মোটেও ঠিক নয়। এটার পরিবর্তন করতে হবে, আধুনিকায়ন করতে হবে। ভালো ছবি বানাতে হবে।’
‘পরাণ’ ছবিটি না দেখতে পারলেও এটি বেশ যত্ন নিয়ে বানিয়েছে বলে জানতে পেরেছেন বলে জানালেন নাসির উদ্দীন ইউসুফ। অন্যদিকে কাছাকাছি সময়ে মুক্তি পাওয়া স্বাধীন ধারার চলচ্চিত্র ‘হাওয়া’ দেখে ভালো লেগেছে এবং এটি তাঁর ভালো ছবি মনে হয়েছে বলেও জানিয়ে রাখলেন।
তিনি বললেন, ‘প্রেক্ষাগৃহে দর্শক ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হলে অবশ্যই মূলধারার বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের যত্ন নিতে হবে বেশি। মূলধারার ছবির ক্ষেত্রে আধুনিক দৃষ্টি, আধুনিক মনন এবং টেকনিক্যালি ভেরি ফাইন ছবি বানাতে হবে, কালার ওয়াইজ ও সাউন্ড ওয়াইজ। তখন আমরাও বাধ্য হব মূলধারার বাণিজ্যিক ছবি নিয়ে কথা বলতে, এখন যা বলা হয় না। স্বাধীন ধারার ছবির ক্ষেত্রে বিনিয়োগের অভাব আছে, তখন ধারাবাহিকতা থাকবে। আর সবচেয়ে বড় কথা, নতুন দর্শককদের অনুপ্রাণিত করতে হবে। কোন ছবি কীভাবে ডিস্ট্রিবিউট হবে, এটা নিয়েও আলোচনা হতে হবে। হাওয়া ছবিটি দেখে আমার ভালো ছবি মনে হয়েছে, কিন্তু এটা আমজনতার ছবি না, মধ্যবিত্তই বেশি দেখেছে ছবিটি।’
দেড় দশকে ‘মনপুরা’, ‘আয়নাবাজি’, ‘ঢাকা অ্যাটাক’, ‘দেবী’ সাফল্য দেখিয়েছে ঠিকই, কিন্তু এসব ছবির পরিচালক ও প্রযোজককে নিয়মিত পাওয়া যায়নি। মধুমিতা মুভিজ ও মধুমিতা প্রেক্ষাগৃহের কর্ণধার ইফতেখার উদ্দিন নওশাদ বললেন, ‘হঠাৎ পাওয়া সাফল্যে আমাদের যেমন লাভ নেই, তেমনি দর্শকেরাও নিয়মিত থাকে না। এই যেমন এখন হাওয়ার দর্শক কমতে শুরু করেছে। আমরা অন্য ছবি চালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছি। তাই মনে করি, আমাদের বেশি জোর দিতে হবে মূলধারার বাণিজ্যিক ছবির প্রতি। দর্শককে টানতে ভালো গল্প, ভালো অভিনয়, ভালো গানের ছবিই লাগবে বেশি। এসব না থাকলে দু–তিন বছর পর আবার এ রকম জোয়ার আসবে, আবার নিভে যাবে। আমরা চাই, এই হাওয়া যেন সব সময় বইতে থাকে। আমরা মানছি, পরাণ ও হাওয়া ভালো গেছে। এখন এসে দর্শক কমতে শুরু করেছে। ব্যবসা কমে আসছে। ধারাবাহিকতা তো থাকতে হবে।’
নাসির উদ্দীন ইউসুফ ও ইফতেখার উদ্দিন নওশাদের মূলধারার বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রে জোর দেওয়ার বিষয়ের সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন আয়নাবাজিখ্যাত পরিচালক অমিতাভ রেজা। তিনি যোগ করলেন, ‘সহজ কথা হচ্ছে, ভালো ছবি, ভিন্নধর্মী গল্প বলতে হবে। সারা পৃথিবীজুড়ে নতুন করে গল্প বলার ঢং তৈরি হয়েছে, শুধু বাংলাদেশে না। পিপল আর ইউজড টু সি নন–স্টুডিও ফিল্ম। স্টুডিও ফিল্মে একধরনের জনরা থাকে।
এদিকে মহামারির কারণে গল্পের প্রতি মানুষ আস্থাশীল হয়ে ছবি দেখার অভ্যস্ততা তৈরি করেছে। বাংলাদেশেও একধরনের মধ্যবিত্ত দর্শক তৈরি হয়েছে, যারা এই ধরনে অভ্যস্ত। অডিয়েন্স যেহেতু তৈরি হয়েছে, অস্থায়ী পুঁজি যারা লগ্নি করত, তাদের পুঁজি যদি স্থায়ী হয়, তাহলে এই ইন্ডাস্ট্রি তৈরি হবে। আমরা হাওয়া, আয়নাবাজি, দেবীসহ যেসব ছবির নাম বলতেছি, তার পাশাপাশি শাকিব খানের ছবিও তো বাণিজ্য করে যাচ্ছে। অস্থায়ী পুঁজি যখন স্থায়ী পুঁজিতে পরিণত হবে, তখন চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিয়াল সাপ্লাই চেইনের মতো তৈরি হবে। এখন লগ্নি যারা করছে, তারা যদি এটাকে স্থায়ী করে তোলে, এ ধরনের ছবি যথারীতি হবে।’
অমিতাভ রেজা এ–ও জানিয়ে রাখলেন, ‘একটা কথা জরুরি, মননশীল প্রযোজক প্রয়োজন। আমরা যে সিনেমা করতে চাই, তাতে লগ্নিকারকের রুচি জরুরি।’
চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, পরাণ ও হাওয়া ছবির এবারের অডিয়েন্স একেবারে আলাদা। মূলধারার বাণিজ্যিক ছবির দর্শক আগে ছিল, সেটাও আলাদা। সব সময় থাকবে। ওদের দর্শককে ক্যাটার করার জন্য সব সময় ছবি হাজিরও থাকতে হয়। সব ধরনের দর্শককে ক্যাটার করার জন্যও ছবি থাকতে হবে। একধরনের ছবি থাকলে শুধু চলবে না।