‘সাধারণ মানুষের এই বন্ধন যেন ছিঁড়ে না যায়’
দেশের সাধারণ মানুষের মতোই নতুন করে স্বপ্ন দেখছেন নির্মাতারা। তবে শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর দেশজুড়ে তৈরি হওয়া সহিংসতা, নৈরাজ্য নিয়েও চিন্তিত তাঁরা। প্রথম আলোকে নিজেদের ভাবনা জানিয়েছেন নির্মাতা পিপলু আর খান
এই আন্দোলনে আমাদের যা অবদান, তা নিতান্তই ক্ষুদ্র। তবে আমার ব্যক্তিগত উপলব্ধি এই যে দেশের এই দুর্যোগকালে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের মানুষদের মধ্যে সংহতির নতুন একধরনের চেহারা দেখা গেছে। এটা আমার মনে নতুন আশার সঞ্চার করেছে। তা ছাড়া আন্দোলন চলাকালে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে থাকা আমার প্রজ্ঞাবান সহকর্মীদের কাছ থেকে আমি অনেক কিছু শিখেছি। আশা করছি আগামী দিনে তাঁরা তাঁদের বিদ্যা, বুদ্ধি ও প্রজ্ঞা দিয়ে দেশের সাংস্কৃতিক পরিকাঠামো তথা দেশ গঠনে যৌক্তিকভাবে অবদান রাখতে পারবেন।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে আমরা দৃশ্যমাধ্যম শিল্পীসমাজের বন্ধু, সহকর্মীরা মিলে জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণে সমাবেশ করার চেষ্টা করি। কিন্তু সেখানে আন্দোলন করা সম্ভব হয়নি। বাধার মুখে আমরা পূর্বঘোষিত জায়গা থেকে সরে এসে ফার্মগেট আনন্দ-ছন্দ সিনেমা হলের সামনে দাঁড়াই এবং শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সহমত পোষণ করি। আমাদের অনেক শিল্পীবন্ধু সশরীর আসতে না পারলেও আমি মনে করি স্পিরিটে তাঁরা আমাদের সঙ্গেই ছিলেন।
বৃষ্টিস্নাত সেই দুপুরে এই জড়ো হওয়াটা ছিল আমাদের সবার জন্য তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়। প্রথমবারের মতো আমরা এমন জায়গায় পৌঁছাতে পেরেছি, যেখানে সাংস্কৃতিক মাধ্যমের সব শিল্পী ও কলাকুশলীর গৃঢ় নিহিত বক্তব্য, মানবতা ও সাম্যের মর্যাদার অধীনে রাষ্ট্রযন্ত্রের ন্যারেটিভকে পরিবর্তন করতে চাই। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, দৃশ্যমাধ্যম শিল্পীসমাজের ব্যানারে আমরা আমাদের কর্তব্য পালন করতে চেয়েছি। আমরা ছাত্রদের স্পিরিটের সঙ্গে ছিলাম। আমি আগেই বলেছি, ছাত্রদের তুলনায় আমাদের অবদান খুবই নগণ্য। আমরা কেবল নাগরিক হিসেবে আমাদের নৈতিক দায়িত্ব পালন করেছি।
দৃশ্যমাধ্যম শিল্পীসমাজের একজন হিসেবে আমার উপলব্ধি এই যে আমাদের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের বেশ কিছু জায়গায় পরিবর্তন জরুরি। সেগুলো নিয়েই আমরা আগামী কর্মপন্থা ঠিক করব। দৃশ্যমাধ্যমের বেশ কয়টি সংগঠনের সঙ্গে বসে আলাপ–আলোচনার মাধ্যমে আমরা সিদ্ধান্ত নেব আমাদের আগামী দিনের ভাবনা কী হবে। দেশ ও সমাজ গঠনে শিল্পীদের কী ভূমিকা রয়েছে, সেই দিকগুলো নিয়ে আমরা সম্মিলিতভাবে একটা প্রস্তাবনা হাজির করব। সেই লক্ষ্যে ১০ আগস্ট আমরা জাতীয় শহীদ মিনারে সম্মিলিতভাবে হাজির হব।
শিক্ষার্থীদের এই বিজয়ের মধ্যে দিয়ে একটা পরিবর্তনের সূচনা দেখতে পেলাম। আশা করি এই পরিবর্তন যথাযথ, সময় উপযোগী ও সবার জন্য মঙ্গলময় হবে। দৃশ্যমাধ্যম শিল্পীসমাজের একজন হিসেবে আমার উপলব্ধি এই যে আমাদের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের বেশ কিছু জায়গায় পরিবর্তন জরুরি। সেগুলো নিয়েই আমরা আগামী কর্মপন্থা ঠিক করব। দৃশ্যমাধ্যমের বেশ কয়টি সংগঠনের সঙ্গে বসে আলাপ–আলোচনার মাধ্যমে আমরা সিদ্ধান্ত নেব আমাদের আগামী দিনের ভাবনা কী হবে। দেশ ও সমাজ গঠনে শিল্পীদের কী ভূমিকা রয়েছে, সেই দিকগুলো নিয়ে আমরা সম্মিলিতভাবে একটা প্রস্তাবনা হাজির করব। সেই লক্ষ্যে ১০ আগস্ট আমরা জাতীয় শহীদ মিনারে সম্মিলিতভাবে হাজির হব।
এই বিপ্লবের মধ্য দিয়ে আমরা ইতিমধ্যেই তারুণ্যের শক্তি টের পেয়েছি। আমাদের মাথায় রাখতে হবে, একজন শিল্পী হিসেবে এই নতুন জেনারেশনের চিন্তাচেতনা, দর্শন থেকে শিল্পী হিসেবে আমরা কীভাবে শিক্ষা নিতে পারি এবং আমাদের কাজে কীভাবে তার প্রতিফলন ঘটাতে পারি। কিন্তু দেশের চলমান অনেক ঘটনা দেখেই আমি বিপন্ন, বিষণ্ন বোধ করেছি। বস্তুত আমি খুবই মর্মাহত। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িটি নেহাত একটি বাড়ি নয়, এটি আমাদের ঐতিহ্য। আন্দোলন–পরবর্তী সময়ে যাঁরাই এই বাড়িসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় অগ্নিসংযোগ করেছেন, মহান জাতীয় সংসদসহ বিভিন্ন জায়গায় লুটপাট করেছেন; আমি মনে করি তাঁরা আমার কিংবা এই বিপ্লবের গোত্রভুক্ত নন। এসব মানুষের শুভবুদ্ধির উদয় হোক, এটাই আমার কাম্য। কারণ, ছাত্রদের এই বিপ্লব আমাদের অগ্নিসংযোগ, লুটপাট করতে শেখায় না; বরং জাতি–ধর্ম–বর্ণনির্বিশেষে দেশের সব নাগরিকের মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে বাঁচতে শেখায়।
এই বিপ্লবের ফলে আমরা নতুন করে দেশ নিয়ে ভাবছি। আশা করব এই ভাবনার আওতায় যেন সবাই থাকে। সমতল থেকে পাহাড়, এই মুক্তি যেন সবার হয়। দেশের সব সাধারণ মানুষের মৌলিক অধিকার যেন সংরক্ষিত হয়। যে লক্ষ্যে ছাত্র-জনতার এই বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে, আগামীর বাংলাদেশে যেন সেগুলোর প্রতিফলন ঘটে।
সর্বোপরি আমি মনে করি, ছাত্রদের জুলাই বিল্পব অন্যায়ের বিরুদ্ধে আমাদের সবাইকে সংঘবদ্ধ করেছে, ঐক্যবদ্ধ হতে শিখিয়েছে। এই শিক্ষা আমরা যাতে ভুলে না যাই। সাধারণ মানুষের এই বন্ধন যেন ছিঁড়ে না যায়।