এখানে প্রবীর মিত্র থাকেন...
প্রবীর মিত্র এখন আর তাঁর পুরোনো ঠিকানা সেগুনবাগিচায় থাকেন না। দীর্ঘদিনের আবাস ছেড়ে ধানমন্ডিতে বাসা নিয়েছেন তিনি। শেখ জামাল ক্রিকেট একাডেমির কাছে একটি বাসায় সন্তানদের নিয়ে থাকেন। ঠিকানামতো সেই বাসায় হাজির হয়ে জানা গেল, অভিনেতা থাকেন চারতলায়। ড্রয়িংরুমে বসতেই এগিয়ে এলেন প্রবীর মিত্রের ছেলে মিথুন মিত্র, তিনি পেশায় ব্যাংক কর্মকর্তা। কুশল বিনিময় শেষে জানালেন, বাবার ফিজিওথেরাপি চলছে, কিছুক্ষণের মধ্যেই আসছেন।
কয়েক বছর ধরে হাঁটুর হাড়ক্ষয় রোগে ভুগছেন প্রবীর মিত্র। মাঝে দিল্লিতে অস্ত্রোপচার করা হলেও পুরোপুরি সেরে ওঠেননি, রুটিনমাফিক ফিজিওথেরাপি নিতে হয়। স্বাভাবিক হাঁটাচলা করতে পারেন না, চলাচলের জন্য তাঁর ভরসা হুইলচেয়ার। বাসার বাইরে খুব একটা যাওয়া হয় না। পত্রিকা পড়ে কিংবা টিভি দেখে, শুয়েবসে সময় কাটছে তাঁর। মাঝেমধ্যে হাসপাতালে যেতে হয়। মুক্ত পরিবেশে আলো-হাওয়ার কিছুটা স্পর্শ পান।
মিথুন মিত্রের সঙ্গে আলাপচারিতার ফাঁকেই হুইলচেয়ারে চেপে এলেন প্রবীর মিত্র, মুখে সেই ‘সিগনেচার’ হাসি। পরনে পাঞ্জাবি আর লুঙ্গি, সাদা চুল, খোঁচা খোঁচা সাদা দাড়িতে শুভ্র একটা ভাব চেহারায়। দীর্ঘদিন ধরে রোগশোকের সঙ্গে লড়াই চালিয়েও মুখের হাসিটা ধরে রেখেছেন তিনি, তবে সেই হাসির আড়ালে জমানো দুঃখগাথাও আছে। কী সেই দুঃখগাথা? এই দুঃখ তুমুল ব্যস্ত একজন শিল্পীর কাজ না পাওয়ার। প্রবীর মিত্র বলে গেলেন, ‘আমি ভালো নেই। কী করব বুঝতে পারি না। কিছুই ভালো লাগে না। বেকার হয়ে বসে আছি। কেউ কাজের জন্য ডাকে না। পারলে আজ থেকেই কাজ করি। কিন্তু পাই না।’
চলচ্চিত্রেই একটা জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন, চার দশকের বেশি সময় কাজ করছেন সিনেমায়। তাঁর জীবনের সঙ্গে মিশে থাকা প্রিয় এফডিসি ও চলচ্চিত্র থেকে অনেক দিন ধরেই দূরে আছেন প্রবীর মিত্র। এফডিসি নিয়ে জমানো স্মৃতি এখনো পোড়ায় তাঁকে। চলচ্চিত্রের সেই সোনালি দিনগুলো তাঁর কাছে এখন সুদূর অতীত।
‘তিতাস একটি নদীর নাম’, ‘দুই পয়সার আলতা’, ‘বড় ভালো লোক ছিল’, ‘বেদের মেয়ে জোসনা’র মতো চলচ্চিত্রে অভিনয় করে দর্শকদের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছেন। বছর কয়েক আগে সর্বশেষ বৃদ্ধাশ্রম সিনেমায় ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়েছিলেন। তারপর সিনেমা করতে পারেননি। এফডিসিতে যাওয়া-আসা কমে গেছে, সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কমেছে সহশিল্পীদের যোগাযোগ।
খানিকটা অভিমানের সুরেই বলেন, ‘কেউ আমার খবর নেয় না। যেন কারোরই খবর নেওয়ার দরকার নেই। শুধু ভাবি, কেউই তো আমার খোঁজখবর নেয় না। আমিও কারও খোঁজখবর নিই না। কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে জীবনটা।’
মাঝে শিল্পী সমিতির নির্বাচনের আগে ভোট পাওয়ার আশায় কয়েকজন প্রার্থী খোঁজ নিলেও আগে-পরে আর কেউ খোঁজ নেননি বলে জানালেন অভিনেতার ছেলে মিথুন মিত্র। বিষয়টি নিয়ে তাঁরা বিস্মিত। আক্ষেপ ফুটে উঠল প্রবীর মিত্রের কণ্ঠেও, ‘শিল্পী সমিতিও খোঁজ নেয় না। শিল্পীদের খোঁজ নেওয়া উচিত, কিন্তু নেয় না। কেন নেয় না, আমি জানি না।’
অভিমান ও আক্ষেপ নিয়ে অনেক কথা বলতে বলতে কাজের প্রসঙ্গ আসতেই যেন ভুলে গেলেন সব। বোঝা গেল, কাজ ও পুরোনো আড্ডায় ফিরতে কতটা মুখিয়ে আছেন তিনি, ‘এফডিসিতে যাইতে ইচ্ছা করে, এফডিসিতে গেলে মনে হয়, আমি নিশ্বাস ছাড়লাম। না গেলে মনে হয়, আমি না খেয়ে আছি। মন উদাস লাগে। রোজ এফডিসিতে যেতে চাই।’
প্রবীর মিত্রকে নিয়ে প্রায়ই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা ধরনের গুজব রটে, যা নিয়ে ভীষণ বিরক্ত অভিনেতার পরিবার। মিঠুন মিত্র জানালেন, ফেসবুকে ছড়ানো বিভ্রান্তিকর তথ্য নিয়ে বিব্রত হতে হয় তাঁদের। প্রবীর মিত্রের তিন ছেলে ও এক মেয়ে—মিঠুন মিত্র, ফেরদৌস পারভীন, সিফাত ইসলাম ও সামিউল ইসলাম। এর মধ্যে সামিউল মারা গেছেন। প্রবীর মিত্রের স্ত্রী অজন্তা মিত্র প্রয়াত হয়েছেন ২০০০ সালে।
১৯৪৩ সালের আজকের দিনে কুমিল্লার চান্দিনায় জন্মগ্রহণ করেন প্রবীর মিত্র। আজ ৮১ পেরিয়ে ৮২ বছরে পা রাখলেন এই প্রবীণ অভিনেতা। তাঁর পুরো নাম প্রবীর কুমার মিত্র। পুরান ঢাকায় বড় হওয়া প্রবীর মিত্র স্কুলজীবন থেকেই নাট্যচর্চার সঙ্গে যুক্ত হন। স্কুলজীবনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ডাকঘর নাটকে অভিনয় করেছিলেন তিনি।
১৯৬৯ সালে প্রয়াত এইচ আকবরের জলছবি চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য প্রথম প্রবীর মিত্র ক্যামেরার সামনে দাঁড়ান। যদিও চলচ্চিত্রটি মুক্তি পায় ১৯৭১ সালের ১ জানুয়ারি।
ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে প্রবীর মিত্র ‘নায়ক’ হিসেবে কয়েকটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। এরপর চরিত্রাভিনেতা হিসেবে কাজ করেও তিনি পেয়েছেন দর্শকপ্রিয়তা। ‘তিতাস একটি নদীর নাম’, ‘জীবন তৃষ্ণা’, ‘সেয়ানা’, ‘জালিয়াত’, ‘ফরিয়াদ’, ‘রক্ত শপথ’, ‘চরিত্রহীন’, ‘জয় পরাজয়’, ‘অঙ্গার’, ‘মিন্টু আমার নাম’, ‘ফকির মজনু শাহ’, ‘মধুমিতা’, ‘অশান্ত ঢেউ’, ‘অলংকার’, ‘অনুরাগ’, ‘প্রতিজ্ঞা’, ‘তরুলতা’, ‘গাঁয়ের ছেলে’, ‘পুত্রবধূ’সহ চার শতাধিক চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি।