জাতীয় পুরস্কার পাওয়া শিশুশিল্পীরা কোথায়
কেউ এসেছিল অভিনয়শিল্পী হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে। কেউ এসে দেখেছিল সেই স্বপ্ন। একটি বা দুটি ছবিতে অভিনয়ের পর শিশুশিল্পী হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার আনন্দে আত্মহারা করেছিল তাদের। কিন্তু গত বিশ বছরে এদের বেশির ভাগ শিশুর আর শিল্পী হয়ে ওঠা হয়নি। হয়তো তাদের সুযোগ দেওয়া হয়নি, নয়তো পারিবারিক ও পারিপার্শ্বিক নানা কারণে তাদের আর অভিনয় করাই হয়নি।
কামরাঙ্গীরচরে মুদিদোকান চালান নুরুল ইসলাম বাবু। তারেক মাসুদ পরিচালিত ‘মাটির ময়না’ ছবিতে আনোয়ার চরিত্রে অভিনয় করে শ্রেষ্ঠ শিশুশিল্পী হিসেবে বিশেষ শাখায় জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিলেন তিনি। তাঁর সঙ্গে শ্রেষ্ঠ শিশুশিল্পী হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাওয়া আরেক শিশু রাসেল ফরায়েজির খোঁজই পাওয়া যায়নি। প্রথম ছবিতে অভিনয় করে ভূয়সী প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন দুজন। ভেবেছিলেন, পুরস্কার তাঁদের ভাগ্য বদলে দেবে। কিন্তু দুজনের কেউই পরে আর কোনো ছবিতে অভিনয়ের সুযোগ পাননি।
বাবু চেয়েছিলেন ভালোভাবে অভিনয় শিখে এই অঙ্গনেই ক্যারিয়ার গড়বেন। সেটা হয়নি। অন্তত চলচ্চিত্রের সঙ্গে থাকার জন্য একসময় পরিচালক মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর টিমে ক্যামেরা সহকারী হিসেবে কাজ করেছেন তিনি। তখনকার কথা স্মরণ করে বাবু বলেন, ‘কেউ যখন কাজ দিল না, তখন চেয়েছিলাম প্রোডাকশন বয় হিসেবে কাজ করি, সেটাও হয়নি। এখন বেঁচে থাকার অভিনয় করছি।’ তিনি জানালেন, অভিনীত চরিত্রের মতো বাস্তব জীবনেও তাঁর সহশিল্পী রাসেল ছিলেন ছিন্নমূল। ছবি মুক্তির পর কাজের জন্য কিছুদিন ঘোরাঘুরি করেছিলেন। পরে কাজ না পেয়ে আবারও ছিন্নমূলের দলে যোগ দেন তিনি। জাতীয় পুরস্কার পাওয়ার পরও রাস্তায় আর স্টেশনে ঘুমাতেন রাসেল।
শিশুশিল্পী হিসেবে এ পর্যন্ত জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার যাঁরা পেয়েছেন, তাঁদের বেশির ভাগই এখন সিনেমার সঙ্গে নেই। পুরস্কারপ্রাপ্ত সেসব ছবির নির্মাতা ও দলের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা যায়, ‘কখনো মেঘ কখনো বৃষ্টি’ ছবির প্রিয়াঙ্কা, ‘দূরত্ব’ ছবির অমল, ‘প্রার্থনা’ ছবির যারা যারিব, ‘খণ্ডগল্প ৭১’–এর সেমন্তীসহ প্রায় ছয় শিশুশিল্পী এখন আর অভিনয়ে নিয়মিত নেই। যে দু–একজন আছেন, তাঁদের সুযোগের রয়েছে যথেষ্ঠ অভাব। সে রকম একজন হুমায়ূন আহমেদের ‘ঘেটুপুত্র কমলা’ ছবির অভিনেতা হাসান ফেরদৌস মামুন। তিনি বলেন, ‘হুমায়ূন আহমেদ স্যারের ছবিতে অভিনয় করে ভেবেছিলাম, অনেকেই কাজে ডাকবে। কিন্তু সে রকম হয়নি। এখনো অভিনয় শিখছি, কিন্তু কেউ সেভাবে কাজে ডাকছে না।’
তিন বছর বয়স থেকে ভাই কিরণ হোসাইনের সঙ্গে থিয়েটারে যাতায়াত ছিল আবির হোসেন অংকনের। যাওয়া–আসা করতে করতে অভিনয়ের প্রতি ভালোবাসা জন্মে। অভিনয় শিখতে শিখতেই চলচ্চিত্রে কাজের সুযোগ আসে। প্রথমবার ‘বৈষম্য’ ছবিতে অভিনয় করেই জুটে যায় জাতীয় পুরস্কার। কিন্তু পরে আর সুযোগ হয়নি অংকনের। বর্তমানে জার্মানির একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছেন অংকন। তিনি বলেন, ‘দেশে অভিনয় পেশার ভবিষ্যৎ যদি বিন্দুমাত্র অনুকূল দেখতাম, তাহলে দেশেই পড়াশোনা ও অভিনয়টা করতাম। কিন্তু আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে সে রকম কোনো সুযোগ-সুবিধা আমি পাইনি। রাষ্ট্রের উচিত মেধাবীদের কাজে লাগানো। নয়তো মেধাবী মানুষগুলো হতাশ হয়ে পড়বেন।’
২০০৯ সালে ‘গঙ্গাযাত্রা’ ও ২০১৩ সালে ‘অন্তর্ধান’ ছবিতে অভিনয় করে জাতীয় পুরস্কার পান সৈয়দা ওয়াহিদা সাবরীনা। তারপর থেকে তাকে আর পর্দায় পাওয়া যায়নি। এর মধ্যে একাধিক ছবিতে কাজের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছেন তিনি। এবারে এ লেভেল পরীক্ষা দিয়েছেন তিনি। অভিনয় থেকে সরে থাকা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘অভিনয়ে প্রচুর সময় দিতে হয়। পড়াশোনার পাশাপাশি সেটা সম্ভব নয়। এ জন্য পড়াশোনাটাই ঠিকমতো করছি।’
জানালেন, অভিনয় করার খুব একটা ইচ্ছা নেই তাঁর। তবে পড়াশোনা শেষে বাবা ওয়াহিদুজ্জামানের মতো নির্মাতা হতে চান তিনি। ২০১৬ সালে ‘শঙ্খচিল’ ছবির জন্য জাতীয় পুরস্কার পায় সাঁজবাতি। পরে অনেক ছবির প্রস্তাব পেয়েও ফিরিয়ে দিয়েছে। কিন্তু অভিনয়ের সংকোচ কাটেনি তার। আপাতত পড়াশোনা নিয়েই ব্যস্ত থাকতে চায়, অভিনয়ে ফেরার তেমন ইচ্ছা নেই।
তবে এসব হতাশার পাশাপাশি আশা জাগায় দীঘির মতো শিল্পী। শিশুশিল্পী হিসেবে বেশ কয়েকবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়ে এ বছর নায়িকা হিসেবে অভিষেক হয়েছে তাঁর। এ ছাড়া চলতি বছর ঘোষিত ২০১৯ সালের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাওয়া দুই শিল্পী নাইমুর রহমান আপন ও আফরিন আক্তার রাইসাও অভিনয়টা চালিয়ে যেতে আগ্রহী।