কেমন চলচ্চিত্র পারে দর্শক ফেরাতে
সেই দিন আর নেই। ছবি দেখার জন্য অগ্রিম টিকিট কেনা, হলের বাইরে কালোবাজারিদের টিকিট বিক্রি, লাইন ধরে হলে ঢোকা—এখন আর এমন দৃশ্য দেখা যায় না। হলে অগ্রিম টিকিট বিক্রি হয় শুধু কিছু বিদেশি ছবির ক্ষেত্রে। বাংলাদেশি ছবির ক্ষেত্রেও কদাচিত ঘটছে। চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট কয়েকজনের কাছে প্রশ্ন ছিল, কোন ধরনের চলচ্চিত্র আবার প্রেক্ষাগৃহে দর্শক এনে দিতে পারে, সেটাই জানার চেষ্টা করা হয়েছে।
ঢালিউডে দেড় দশকের বেশির সময় ধরে দাপটের সঙ্গে কাজ করছেন শাকিব খান। সিনেমা হলমালিকদের মতে, এখনো তাঁর অভিনীত ছবিই আগ্রহ নিয়ে দেখছেন দর্শক। তবে তাঁকেও ভালো মানের ছবির সংখ্যা বাড়াতে হবে। গেল কয়েক বছরে তাঁর অভিনীত শিকারি, নবাব, ভাইজান এলো রে ও পাসওয়ার্ড সিনেমার হলে দর্শক ছিল লক্ষণীয়। করোনার এই সংকটে গত ঈদেও দর্শকের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। গত ঈদে শাকিব খান ছাড়া শহুরে প্রেক্ষাগৃহে সিয়ামের ছবির প্রতিও দর্শকের আগ্রহ ছিল।
বাংলাদেশে গত কয়েক বছরে রোমান্টিক ছবি তৈরি হয়েছে সবচেয়ে বেশি। চলচ্চিত্র পরিচালকদের মতে, এসবে দর্শকের মধ্যে একঘেয়েমি তৈরি হয়েছে। ফেসবুকে চলচ্চিত্রের বিভিন্ন গ্রুপে এসব নিয়ে চলে নানা আলোচনা। অনেকের মতে, ধুন্দুমার অ্যাকশন কিংবা পারিবারিক গল্পে দারুণ কোনো ছবি হলে দর্শক আবার ফিরতে পারেন প্রেক্ষাগৃহে।
জ্যেষ্ঠ অভিনয়শিল্পী আলমগীর দর্শক কমে যাওয়ায় আক্ষেপ প্রকাশ করেন। তার মতে, পারিবারিক ছবিই পারে আবার দর্শক ফেরাতে। অ্যাকশনধর্মী ছবিও দরকার মনে করছেন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘অনেক দিন হলো দেশে পারিবারিক ছবির অভাব দেখতে পাচ্ছি। গ্রামীণ ছবির অভাব। অ্যাকশনধর্মী ছবির অভাব। আমাদের আসলে কোনো কিছুই হচ্ছে না। যা হচ্ছে, তা–ও কিছুই হচ্ছে না। কী বানাচ্ছে এসব! ভালো পরিচালকদের দিয়ে ভালো গল্প নিয়ে ছবি বানালে বাংলাদেশি দর্শক দেখবেনই। হলে হুমড়ি খেয়ে পড়বেনই।’
বাংলাদেশের চলচ্চিত্র যে কয়েকজন নির্মাতার হাত ধরে আন্তর্জাতিকতার পথে হেঁটেছে, তাঁদের অন্যতম মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। তাঁর ছবিতে দেখা গেছে ইরফান খান, নওয়াজুদ্দিন সিদ্দিকী, এ আর রাহমানের মতো শিল্পীদের। ফারুকীর মতে, ‘কোনো এক ধরনের প্রোডাক্ট দিয়ে সব ধরনের দর্শকের চাহিদা মেটানো যাবে, ব্যাপারটা বোধ হয় এ রকম নয়। দর্শক অনেক রকমের। তাঁদের স্বাদও অনেক রকম। একই দর্শকের আবার অনেক রকম জিনিসও পছন্দ হতে পারে। ফলে আমি মনে করি, আমাদের নানা ধরনের ছবি লাগবে। আমাদের একটা শিকারি বা পাসওয়ার্ড যেমন লাগবে, তেমনি একটা মনপুরাও লাগবে। আয়নাবাজি লাগবে, থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার লাগবে, টেলিভিশন লাগবে, ঢাকা অ্যাটাক লাগবে, রেহানা মরিয়ম নূর লাগবে, আরও কিছু লাগবে।’
পোড়ামন ২, দহন, টান, সাত নম্বর ফ্লোর বানিয়ে পরিচিতি পেয়েছেন তরুণ পরিচালক রায়হান রাফী। ঈদে মুক্তির অপেক্ষায় আছে তাঁর পরিচালিত পরাণ ছবিটি। এই পরিচালক বললেন, ‘যাঁরা ক্ল্যাসিক দর্শকের জন্য সিনেমা বানাচ্ছেন, তাঁরা আবার আমজনতার কথা ভাবছেন না। যাঁরা আবার আমজনতার জন্য বানাচ্ছেন, তাঁরা আবার ক্ল্যাসিক দর্শকদের কথাও ভাবছেন না। আমাদের এখন দুটোকে একসঙ্গে ব্লেন্ড করে ছবি বানাতে হবে।’
দেশা : দ্য লিডার বানিয়েই নিজের অবস্থান জানান দিয়েছিলেন তরুণ পরিচালক সৈকত নাসির। সম্প্রতি মুক্তি পেয়েছে এই পরিচালকের তালাশ। মুক্তির অপেক্ষায় রয়েছে ক্যাসিনো, বর্ডার, পাপসহ আরও কয়েকটি ছবি। এই পরিচালক বলেন, ‘এককথায় যদি বলতে হয়, তাহলে বলব, মাসালা ছবি লাগবে। ফাটানো অ্যাকশন ছবি দিয়েই দর্শক ফেরানো সম্ভব। দক্ষিণি ছবিতে যেমন হয়, অ্যাকশন ও কমেডি দুটোই সুন্দরভাবে উপস্থাপন করতে হবে, তেমনটাই এখন বানাতে হবে। লার্জার দ্যান লাইফ কনটেন্ট প্রেক্ষাগৃহে আনতে পারলেই দর্শকেরা হুমড়ি খেয়ে পড়বেন।’
৫০টি চলচ্চিত্র বানিয়েছেন কাজী হায়াৎ। তাঁর ছবি দেখার জন্য একটা সময় দর্শকেরা প্রেক্ষাগৃহে ভিড় করতেন। সর্বশেষ মুক্তি পাওয়া ছবি বীরও প্রশংসিত হয়েছে, দুটি বিভাগে পেয়েছে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। এই পরিচালক বললেন, ‘আমার মনে হয়, মানুষ এখনো সিনেমার মধ্যে ভালো ভালো কথা শুনতে চায়। আমাদের পারিবারিক ছবি করার মতো স্টার আর্টিস্ট এখন আর নেই। যেমন নারায়ণ ঘোষ মিতা বানাত, পারিবারিক ছবির মধ্যে অ্যাকশন ফরমেট নিয়ে এসেছিল এ জে মিন্টু। সেই ধরনের ছবিগুলো এখন আর হচ্ছে না। আমার ধারণা, এ জে মিন্টু যে ধরনের ছবি বানাত—অ্যাকশন প্লাস পারিবারিক ফরম্যাট, কাজী হায়াৎ যে ধরনের ছবি বানাত—বক্তব্যধর্মী, গণমানুষের কথা বলত—সে ধরনের ছবি কেউ বানাতে পারলে আবার দর্শক ফিরবেনই। ফিরতে বাধ্য। আমাদের পক্ষে তো আর ওসব বানানো সম্ভব নয়। কাউকে এগিয়ে আসতে হবে।’
চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, মূলধারার বাণিজ্যিক চলচ্চিত্র প্রভাব বিস্তার না করতে পারলে কিংবা ব্যবসায়িকভাবে সফল না হলে বিকল্প ধারার চলচ্চিত্রেরও মাথা তুলে দাঁড়ানো মুশকিল বলে মনে করছেন বিকল্প ধারার পরিচালকেরাও।