গুপী গাইনের চরিত্রে নায়কোচিত সুদর্শন সৌমিত্রের চেয়ে কিছুটা বোকামি সারল্যমাখা তপেনই যে ভালো করেছেন, এটা আজ নিশ্চয়ই সৌমিত্রও স্বীকার করবেন। ‘অপরাজিত’র জন্য কিশোর অপুকে খুঁজছিলেন সত্যজিৎ। সৌমিত্র এসেছিলেন দেখা করতে। ‘অপরাজিত’র জন্য বয়সে একটু বড় হয়ে গিয়েছিলেন সে সময়কার কলেজে পড়া সৌমিত্র। কিন্তু পরবর্তী যুবক অপু হিসেবে সত্যজিৎ ওকেই যে তখনই মনস্থির করেছিলেন, সে পছন্দটা কতই না মোক্ষম ছিল।
বাঙালি চিরকাল যখন তাদের প্রিয় চরিত্রে যুবক—অপুর কথা ভাববে, সৌমিত্রের কিছুটা লাজুক, কিছুটা ভাবুক, সংবেদনশীল ও উজ্জ্বল মুখটাই তাদের চোখের সামনে ভেসে উঠবে। কেউ বলতে পারেন, বাংলা সিনেমার পর্দায় সৌমিত্রর যে দ্রুত ও ক্রমবিকাশ, তা তাঁর প্রথম জীবনে অত বড় সুযোগ পাওয়ার কারণেই। এ প্রসঙ্গে বলতে চাই, সুযোগ তার সামনেই আসে, যে প্রস্তুত থাকে। ওই যে হ্যামলেট বলেছিল, ‘রেডিনেস ইজ অল’ আর সুযোগটাই দেখা হবে? সাফল্যের পেছনে প্রস্তুতি ও পরিশ্রমের যে কষ্টসাধ্য পর্বগুলো থাকে, সেটাও তো দেখতে হবে। নিজের শরীরকে (অভিনেতার যা সবচেয়ে বড় অস্ত্র। ‘দেহতট সনে নট সকলি হারায়’)। নিজের কণ্ঠকে, নিজের অভিব্যক্তিগুলোকে যে কত পরিশ্রম ও শৃঙ্খলাবোধ দিয়ে একজন অভিনেতা তিল তিল করে গড়ে তোলেন ও রক্ষা করেন, বাংলা চলচ্চিত্রে সৌমিত্র তার
কত রকম বৈচিত্র্যময় চরিত্রেই না তাঁকে আমরা দেখেছি। ‘অভিযান’-এর কিছুটা রুক্ষ প্রকৃতির নরসিং, ‘কাপুরুষ’-এর সত্যিই কাপুরুষ অমিতাভ, ‘কোনি’-এর ক্রীড়াপাগল ক্ষিদদা, ‘ঝিন্দের বন্দী’র তলোয়ার চালানো ময়ূরবাহন, ‘অশনি সংকেত’-এর চশমা-আঁটা পণ্ডিত গঙ্গাচরণ, ‘শাখা প্রশাখা’র অপ্রকৃতিস্থ প্রশান্ত এবং সত্যজিতের অমর সৃষ্টি ‘ফেলুদা’ তো বটেই। সত্যজিৎ যেন সৌমিত্রকে কল্পনা করেই চরিত্রটা এঁকেছেন—ঋজু দেহ, তীক্ষ্ণ বুদ্ধির এক বাঙালি শার্লক হোমস, যে শারীরিক কসরতে নয়, বুদ্ধির জোরে হারায় অপরাধীকে। প্রচলিত বাংলা সিনেমার কিছু ফর্মুলা আছে—বাবার ফর্মুলা, বড় ভাইয়ের ফর্মুলা, প্রেমিকের ফর্মুলা, বন্ধুর ফর্মুলা; যেখানে অভিনয়টা ঘটে ওই ফর্মুলা অনুযায়ীই, চরিত্র অনুযায়ী নয়।
জীবিকার প্রয়োজনে সৌমিত্রকে হয়তো এ ধরনের অনেক ফর্মুলা চরিত্রে পরবর্তীকালে অভিনয় করতে হয়েছে। কিন্তু সেসব বাণিজ্যিক ছবিতেও সৌমিত্রের যত্নশীল অভিনয়টা আলাদাভাবে চোখে পড়ে। আসলে বাঙালি জীবনে তো তেমন যুদ্ধ নেই, অ্যাডভেঞ্চার নেই, ফলে ব্যতিক্রমী চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগও কম। কেবল সত্যজিৎ রায়ের ছবিতেই সৌমিত্র হয়তো তাঁর অপার অভিনয়ের ক্ষুধাটা কিছুটা মেটাতে পেরেছিলেন। কাস্টিংয়ের ক্ষেত্রে অত খুঁতখুঁতে সত্যজিৎ রায়ও যে একটার পর একটা ওঁর মোট ১৪টি ছবিতে সৌমিত্রকে ডেকেছেন, সে তো আর এমনি নয়। প্রকৃত সিনেম্যাটিক অভিনয়ের ক্ষেত্রে আসল মুক্তাকে চেনার ব্যাপারে সত্যজিতের চেয়ে বড় জহুরি ভারতবর্ষে আর কেই-বা ছিলেন! তবে এই সত্যজিৎ রায়ই, সৌমিত্র চাওয়ার পরও, গুপী গাইনের চরিত্রটি তাঁকে যে দেননি, তাতে সত্যজিতের সেই বাস্তববোধেরই প্রমাণ আবারও মিলল যে, কোনো শিল্পীরই প্রকাশ বিচিত্রগামী হলেও সর্বত্রগামী হওয়ার প্রয়োজন নেই।
একটা বিরল উদাহরণ হয়ে রইবেন। সাধনা ও এষণা সব সাফল্যেরই মূল কথা।
অভিনয়শিল্পের ক্ষেত্রেও আলাদা কোনো ফর্মুলা নেই। ‘ঝিন্দের বন্দী’ ছবির জন্য ঘোড়ায় চড়া শিখেছেন, ‘হুইল চেয়ার’ ছবির জন্য ছয় মাস ধরে হুইলচেয়ারে বসে চলাফেরার অভ্যাস করেছেন, আর ‘চারুলতা’র জন্য তো নিজের হাতের লেখাটাই পাল্টে ফেললেন। খুব যুবক বয়স থেকেই সৌমিত্র স্টার হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু তারকা হওয়ার সুখ তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করার চেয়ে নানা বিচিত্র ধরনের চরিত্রে অভিনয়ের সৌমিত্রর যে আন্তরিক আগ্রহ ও নৈপুণ্য, তা তাঁকে ভারতীয় সিনেমায় ব্যতিক্রমী করেছে। তাই আজ নাসিরুদ্দিন শাহকেও বলতে শুনি, চলচ্চিত্রে অভিনয়ের ক্ষেত্রে সৌমিত্র তাঁর আদর্শ।
একজন শিল্পী যে ব্যতিক্রমী হন, তার এক বড় কারণ নিহিত থাকে তাঁর শৈশব, কৈশোর, যৌবন, তথা বেড়ে ওঠার দিনগুলোর ওপর, যখন তাঁর সংবেদনশীলতা ও শিল্পবোধ, মানুষ ও জীবন সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি একটা সুনির্দিষ্ট রূপ নিতে থাকে। সৌমিত্রর বেড়ে ওঠার পর্বটা দেখা যাক। সৌমিত্রদের আদি দেশ কুষ্টিয়ার কাছে শিলাইদহের কয়া গ্রামে। সেদিক থেকে লালনের দেশের মানুষ তিনি। শৈশব-কৈশোর কেটেছে কৃষ্ণনগরে—দ্বিজেন্দ্রলালের শহরে। কলকাতার কাছের এই মফস্বল শহরের সুনাম ছিল এর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের জন্য, বিশেষ করে সংগীতের আবহের জন্য। কৃষ্ণনগরের প্রভাব সৌমিত্রর শিল্পীজীবনে নিঃসন্দেহে এক ইতিবাচক প্রভাব। মা–বাবা, ভাইবোন, পাড়া–প্রতিবেশী নিয়ে মফস্বল শহরের যে বাঙালি মধ্যবিত্ত জীবন, তার মধ্যে এমন একটা স্নিগ্ধতার দিক আছে, জীবন ও চারপাশের মানুষদের প্রতি তা এমন কিছু ভালোবাসার স্নেহ–মমতার বন্ধন তৈরি করে দেয়, যা একজন মানুষের বেড়ে ওঠার জন্য খুবই স্বাস্থ্যকর।
তা ছাড়া আধা শহর কৃষ্ণনগরে গ্রাম কাছেই। প্রকৃতির সম্ভার চারপাশে। এ–ও একধরনের মানসিক ভারসাম্য আনে। বড় নগরের যে উন্মুললক্ষণাক্রান্ততা, তা থেকে মুক্ত থাকতে সাহায্য করে প্রকৃতির কাছাকাছি থাকার জীবনবোধ।
তরুণ বয়সে কলকাতায় এসে প্রগতিশীল রাজনৈতিক ও উচ্চ একটা সাংস্কৃতিক আবহে থাকাটাও সৌমিত্রর গড়ে ওঠার পেছনে এক বড় ভূমিকা রেখেছে। আর এক বড় অবদান ছিল অবশ্যই শিশির ভাদুড়ীর সাহচর্য ও স্নেহাশীষ, যে শিশিরবাবু একদিন তাঁকে ব্রেশট পরতে দিয়েছিলেন, শিখিয়েছিলেন মঞ্চে হাঁটা ও স্বর প্রক্ষেপণের নানা সূক্ষ্ম কলাকৌশল। অভিনয়ের যে উচ্চ আদর্শ শিশিরবাবু নিজের ক্ষেত্রে চর্চা করতেন, তা তাঁর এই তরুণ ভাবশিষ্যের মধ্যে যে যথেষ্টই চালিয়ে দিতে পেরেছিলেন, সৌমিত্রর গোটা অভিনয়জীবনই তার প্রমাণ। উপদেশ-পরামর্শ অনেকেই পায়, বিশেষ করে তরুণ বয়সে, কিন্তু তা গ্রহণ করার বুদ্ধি ও বিবেচনাবোধটাও তো থাকা চাই। বাংলা সিনেমার সৌভাগ্য যে তরুণ সৌমিত্রর সেটা ছিল। শিশিরবাবুর প্রভাবও হয়তো একটা কারণ যে সিনেমার পর্দায় এত বড় সাফল্যের পরও মঞ্চের প্রতি সৌমিত্র আজীবন দায়বদ্ধ থেকেছেন। অবশ্য সৌমিত্র ভাগ্যবান যে তাঁর চারপাশে তিনি আর যেসব অভিনয়শিল্পীর সাহচর্য পেয়েছিলেন—ছবি বিশ্বাস, পাহাড়ি সান্যাল, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়, জহর রায়, তুলসী চক্রবর্তী, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়—তাঁরা প্রত্যেকেই ছিলেন বাংলা সিনেমার পর্দায় এবং মঞ্চের অভিনয়ের একেক দিকপাল ও এই শিল্পের প্রতি গভীরভাবে একনিষ্ঠ।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের অভিনয়দক্ষতার বড় বৈশিষ্ট্যগুলো কী কী? প্রথমেই বলব বাচনিক অভিনয়ে ওঁর অসামান্য দক্ষতা। সংলাপটা বলার সময় যেখানে যেটুকু জোর, যেখানে একটু থামা, এসব ব্যাপারে ওঁর জুড়ি মেলা ভার। আর এটা তখনই সম্ভব, যখন সংলাপের লাইনগুলো একজন অভিনেতার খুব ভালোভাবে আত্মস্থ (মুখস্থ নয়) থাকে। আর সেটা থাকলে একজন অভিনেতা কেবল লিখিত সংলাপটিই নয়, টেক্সটের ‘বিটুইন দ্য লাইনস’ যা আছে, তা–ও তুলে ধরতে পারেন। এটা দুঃখজনক যে অনেক অভিনেতা–অভিনেত্রী, বিশেষ করে ইদানীং টিভি নাটকের সহজিয়া পথের কারণে শুটিংয়ের আগে সংলাপগুলো তেমন আত্মস্থ করে নেন না। ঢাকার অভিনেতা–অভিনেত্রীদের সঙ্গে কাজ করতে কেমন লাগল, একবার এটা জিজ্ঞেস করায় শাবানা আজমি যেন আমাকে কোনো ভয়াবহ গোপন কথা বলছেন, এভাবে ফিসফিস করে বলছিলেন যে ‘জানো ওরা লাইন শিখে আসে না’। এটা যে একজন অভিনেতা–অভিনেত্রীর জন্য কত বড় অপরাধ, তা ওঁর চোখে–মুখের বেদনাতেই ফুটে উঠেছিল।
তবে ভালো সংলাপ বলার জন্য কেবল লাইনগুলো আত্মস্থ করাই তো যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন ভাষার ওপর দখল। আমাদের এই বাংলা ভাষা—মানব মনের নানা বিচিত্র ভাবপ্রকাশে তার কতই না সমৃদ্ধি, কতই না সম্ভাবনা। কিন্তু সৌমিত্রর মতো এ রকম হাতে গোনা খুব কম অভিনেতাই আজ আছেন, ভাষার উচ্চারণ ও প্রকাশে যাঁদের রয়েছে পরিপূর্ণ দখল। বাংলা ভাষার ওপর এই সুগভীর দায়বদ্ধতার কারণেই কি হিন্দি ছবি তাঁকে তেমন আকর্ষণ করেনি। সংলাপের ওপর সৌমিত্রের দখলের একটা উদাহরণ দিই।
‘ঘরে বাইরে’তে সন্দ্বীপের অত বড় বক্তৃতাটা দর্শকদের মোটেই একঘেয়ে লাগে না (বিমলা তো ওই বক্তৃতা শুনেই ওর প্রেমে পড়ে গেল!)। কারণ, সৌমিত্র জানেন যে বাক্যের মধ্যে কখন বিরতি দিতে হবে, কখন স্বরটাকে খাদে নামাতে হবে, কোন বাক্যাংশের সময় গলাটা চড়বে উচ্চগ্রামে। হয়তো ভাষার ওপর এই নিপুণ দখলের কারণেই প্রচলিত ধারণার বাইরে গিয়ে সত্যজিৎ রায় সৌমিত্রকে নিখিলেশ না করে সন্দ্বীপ চরিত্রে অভিনয় করালেও, বাকপটু সন্দ্বীপের চরিত্রে সৌমিত্র ঠিকই উতরে যান। আসলে একজন ভালো অভিনেতার কণ্ঠে বৈচিত্র্যটা থাকা চাই। নানা ধরনের চরিত্র, নানা ধরনের উচ্চারণ—শিক্ষক, বেকার যুবক, মধ্যবিত্ত, চাকুরে, গাড়ির ড্রাইভার—কত রকম উপভাষা, কত রকম অভিব্যক্তি। আমার ধারণা, সৌমিত্রর আবৃত্তির চর্চাটি এ ক্ষেত্রে তাঁর জন্য খুবই সহায়ক হয়েছে। আর এ কেবল আমার ধারণা নয়, তাঁর ‘আবোল তাবোল’ আবৃত্তির অসামান্য ক্যাসেটটি তো যেকোনো বাঙালিকেই মুগ্ধ করবে। তবে চলচ্চিত্রে অভিনয় তো কেবল বাচনি অভিনয় নয়, সিনেমায় অভিনয় হচ্ছে পর্দায় বাস্তব জীবনের একটা ক্ষণিক উপস্থিতিকে পরিপূর্ণভাবে ফুটিয়ে তোলা। ফলে তিনিই ভালো অভিনেতা, যিনি কথা না বললেও যতক্ষণ পর্দায় আছেন, তাঁর উপস্থিতিটা যেন প্রতি মুহূর্তে অনুভব করা যায়। সংলাপ না থাকলেও কাম্য তাঁর জীবন্ত এক উপস্থিতি—চোখের চাহনি, শরীরভাষা, সবটা দিয়েই অভিনয়।
যে সংলাপ চিত্রনাট্যে নেই, যে শব্দগুলো অনুচ্চারিত রাখা হয়েছে, কিন্তু রয়েছে চরিত্রের মস্তিষ্কের কোষে কিংবা জিবের তলায়, তাকে শরীরভাষা, চোখের চাহনি বা মুখের অভিব্যক্তি দিয়ে ফুটিয়ে তুলতেও সৌমিত্রর নৈপুণ্য মুগ্ধ করে। এই শরীরভাষার ক্ষেত্রে তাঁর দক্ষতা আমরা দেখেছি ‘দেখা’ ছবিতে, যেখানে অন্ধ হওয়ার কারণে অভিনেতার হাতে সবচেয়ে বড় যে এক অস্ত্র, সেই চোখের কাজের সুযোগ ছিল না।
শারীরিক অভিনয়ের ক্ষেত্রে সৌমিত্রর দক্ষতার একটা বিশেষ উদাহরণ দিতে চাই। সত্যজিৎ রায়ের ‘শাখা প্রশাখা’র খাবার টেবিলের সেই দৃশ্যটি। হাতের আন্দোলনের সঙ্গে সঙ্গে অপ্রকৃতিস্থ প্রশান্তরূপী সৌমিত্র যেভাবে ঘাড়টাও আন্দোলিত করা শুরু করেন, তা দৃশ্যটার নাট্যগুণ অনেকখানি বাড়িয়ে দেয়। সৌমিত্রর আরও বড় গুণ যে তিনি জানেন যে চলচ্চিত্রে অভিনয় মূলত আন্ডার–অ্যাক্টিং এবং কোনো সুনির্দিষ্ট ম্যানারিজমে নিজেকে আবদ্ধ রাখেন না। তবে ভালো অভিনয়ের যে প্রধান পূর্বশর্ত, জীবনের বৈচিত্র্যময় রূপকে জানা, জানা হাজারো রকমের মানবচরিত্রকে এবং তার জন্য সাধারণ মানুষের সঙ্গে নিয়মিত মেলামেশা—এটাও সৌমিত্রর জীবনের একটা বড় ইতিবাচক দিক বলে মনে করি। তাঁর সমসাময়িক আরেকজন সুদক্ষ চলচ্চিত্রাভিনেতা উত্তম কুমার তারকার ইমেজে নিজেকে আবদ্ধ রেখে সাধারণ মানুষের জীবন থেকে নিজেকে কিছুটা দূরে রেখেছিলেন। আমাদের ভাগ্য ভালো যে সৌমিত্র সেটা করেননি। ভালো অভিনয়ের আকাঙ্ক্ষা তাঁকে জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে টেনে নিয়ে গেছে। আসলে পৃথিবীর পাঠশালায় শেখার তো কোনো বিকল্প নেই। যার জীবনাভিজ্ঞতা প্রচুর, সেই–ই তো স্তানিশ্লাভস্কির ‘অ্যান অ্যাক্টর প্রিপারস’ থেকে সবচেয়ে বেশি নিতে পারে।
তবে পড়াশোনার গুরুত্বটা থেকেই যায়। আর সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো সর্ব অর্থে শিক্ষিত অভিনেতা খুব তো বেশি আসেননি ভারতবর্ষের চলচ্চিত্রে। বাংলা সাহিত্য এবং পশ্চিমা নাটক, চলচ্চিত্র ও সাহিত্যের সঙ্গে সুগভীর পরিচিতি একজন অভিনেতা হিসেবে সৌমিত্রকে নিঃসন্দেহে ঋদ্ধ করেছে। শিক্ষা মানব চরিত্রে একরকম আলোকের আভা এনে দেয়—সংস্কারমুক্তির আলোক। মানুষের অধিকারের প্রতি বাড়ায় দায়বদ্ধতা—ওই ‘হীরক রাজার দেশে’র পণ্ডিতের মতো। গ্রামের ছেলে অপু শহরে এসেছে শিক্ষার অন্বেষণে, শিক্ষা পেয়েছে। ‘সমাপ্তি’র অপূর্বকৃষ্ণ, ‘অশনি সংকেত’-এ গঙ্গাচরণ ও ‘গণদেবতা’য় দেবু, পণ্ডিত বলতে বাংলা চলচ্চিত্রে ওই সৌমিত্রই এবং বিশেষ করে একটা চরিত্রের কথা বলব, রাজা মিত্রের ‘একটি জীবন’–এর সেই অসামান্য জ্ঞানতাপস বৃদ্ধ শিক্ষকের কথা, কেবল শিক্ষার অন্বেষা যাকে লার্জার দ্যান লাইফ এক চরিত্রে পরিণত করেছে। সৌমিত্র আমাদের চারপাশের বাঙালি মধ্যবিত্তের চরিত্রগুলোতে অভিনয় করলেও বাঙালি মানসের গভীরে যে আকাঙ্ক্ষা—শিক্ষা ও সংস্কারমুক্তির এক আলোকিত মানুষ, সেই স্বপ্নের সঙ্গে তিনি নিজেকে একাত্ম করাতে পেরেছেন, ছুঁতে পেরছেন বাঙালির অবচেতন স্বপ্নকে। একজন অভিনেতা হিসেবে এটা তাঁকেও লার্জার দ্যান লাইফ এক মানুষে পরিণত করেছে। একজন তারকার ইমাজ থেকে এ অনেক বড় ইমেজ। আর শিক্ষার এই ব্যাপারটি তো কেবল তাঁর অভিনয়ের ক্ষেত্রে নয়, যে মানুষটি আটটি কাব্যগ্রন্থ লেখেন, খলিল জিব্রানের অনবদ্য ‘প্রফেট’ মাতৃভাষায় অনুবাদ করেন, বছরের পর বছর ‘এক্ষণ’–এর মতো মননশীল একটা পত্রিকা সম্পাদন করেন, বোঝা যায় শিক্ষা তাঁর মজ্জার ভেতরেই ছিল।
এটা দুঃখঞ্জনক যে সত্যজিৎ রায়ের পরে বাংলাভাষী ছবি আর তেমন উন্নত হচ্ছে না, ফলে সৌমিত্রর অভিনয় নৈপুণ্যটা ইদানীং কিছুটা অব্যবহৃত থাকছে।
তবু সুদীর্ঘ ৪০ বছর ধরে পর্দায় ও মঞ্চে নিরবচ্ছিন্ন অভিনয় করে যাওয়া এবং একটা গুণগত মান বজায় রেখেই—এ খুবই বড় এক অর্জন। আর তার কারণটা বোধ হয় এই যে শিল্প সম্পর্কে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় সর্বদাই একটু অত্যন্ত উচ্চমানদণ্ড নিজের মনের মধ্যে সৃষ্টি করে রেখেছিলেন। সত্যজিৎ যখন তাঁকে সে সুযোগ দিয়েছেন, তখন সেই মান অনুযায়ী কাজ করেছেন। অন্য নির্মাতাদের চরিত্রগুলোতে তেমন সুযোগ হয়তো পাননি, কিন্তু তার মাঝেও অভিনয়শিল্পের প্রতি তাঁর গভীর দায়বদ্ধতার ছাপ, তিনি নিয়মিতই রেখে গেছেন।
অভিনয়, চলচ্চিত্র, নাটক, সাহিত্য—এসবের প্রকৃত প্রয়োজনটা জীবনে আসলে কী? আসল প্রয়োজনটা হচ্ছে, এসব আমাদের উন্নত মানুষ হতে সাহায্য করে। তাই একজন ভালো অভিনেতা হওয়াই কেবল যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন উন্নত মানুষ হওয়া। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো উন্নত একজন মানুষ বাঙালি সংস্কৃতিতে আর কজন আছেন? এখানেই এই ব্যতিক্রমী অভিনেতাটির আজন্ম সাধনার সার্থকতা।