সংগ্রামের সেই দিনগুলোর গল্প শোনালেন অনুপম খের
কৌতুক, খল অভিনেতা, বিত্তশালী বাবা কিংবা রাজনীতিবিদ—কত বিচিত্র চরিত্রে দেখা গেছে বলিউডের অন্যতম বর্ষীয়ান অভিনেতা অনুপম খেরকে। টেকো মাথার লোকটা শুধু অভিনয়গুণ দিয়ে বারবার আলোচনায় এসেছেন।
অনুপম খেরের অভিনয়জীবনের বয়স ৩৫ বছর। ৫১৫টির বেশি ছবিতে এখন পর্যন্ত অভিনয় করেছেন তিনি। ক্যারিয়ারে অনেক ওঠানামাও দেখেছেন। কিন্তু আজও অভিনয় ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারেন না তিনি। আবার এমনও দেখা গেছে, এই বয়সে ফিটনেসের জন্যও আলোচনায় হচ্ছে তাঁকে নিয়ে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনুপম খেরের জিমের ছবি দেখলে তাক লেগে যায়। বর্ণাঢ্য জীবনযাপন তাঁর।
অথচ এই লোকটির অভিনয়জীবনের শুরুটা নিদারুণ সংগ্রামের ছিল। অর্থের অভাব ছিল, থাকার জায়গা ছিল না। এমনও অনেক রাত গেছে তাঁর, সমুদ্রের তীরে সৈকতের বালুতে, ট্রেন স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে ঘুমাতে হয়েছে তাঁকে। মায়ের থেকে মিথ্যা বলে ১০০ টাকা নিয়ে অডিশন দিতে গিয়েছিলেন অনুপম খের।
একেবারেই নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা মানুষ অনুপম খের। বাবা ছিলেন বন বিভাগের সাধারণ এক কেরানি। অনুপম খের ইনস্টাগ্রামে নিজেই জীবনসংগ্রামের কথা তুলে ধরেছেন। লন্ডন থেকে সেই বার্তায় তিনি লিখেছেন, ‘যখন খুব ছোট ছিলাম, দাদাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আমরা এত গরিব। তবুও কীভাবে এত সুখে আছি? তখন তিনি বলেছিলেন, “দারিদ্র্য আমাদের সবচেয়ে সস্তা বিলাসিতা।” আমার বাবা খুব আশাবাদী ছিলেন। পরীক্ষায় কখনো ৬০-এর মধ্যে ৫৯ পেলেও বাবা বলে গিয়েছেন, পরেরবার যেন আরও ভালো হয়। আর এটাই আমাকে অদম্য সাহস জোগায় জীবনের ব্যর্থতার সময়।’
অনুপম খের লিখেছেন, ‘মঞ্চ আমার প্রথম প্রেম, খুব ভালোবাসতাম। সারাক্ষণ অভিনয়ের কথা ভাবতাম। একদিন চণ্ডীগড়ে একটি বিজ্ঞাপন প্রকাশ হয়, সেখানে বলা ছিল বিজ্ঞাপনে অভিনয়ের জন্য লোক দরকার। কিন্তু হাতে টাকা নেই। মায়ের থেকে পিকনিকের কথা বলে ১০০ রুপি নিয়ে অডিশন দিতে গেলাম। পরে অবশ্য মা জানতে পেরেও কিছু বলেনি, তিনি মেনে নিয়েছিলেন।’
চণ্ডীগড়ে অভিনয়ের ক্লাসে ভর্তি হতে চেয়েছিলেন অনুপম খের। সেখানে তিনি দুই বছর শিক্ষকতাও করেছিলেন। এ তথ্য দিয়ে অনুপম খের লিখেছেন, ‘একদিন জানতে পারি, মুম্বাইয়ে একটি নাটকের স্কুল আছে। সেখানে আবেদন করলে আমাকে ডাকা হলো। দেওয়া হলো একটি ছোট্ট ঘর। কিন্তু কোনো টাকাপয়সা কিছুই দিল না। বেশির ভাগ দিন খিদে পেটে ঘুমাতে হতো। পকেটে টাকা থাকত না। এমনও হয়েছে, কখনো সাগরপাড়ে সৈকতে, স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে ঘুমিয়ে কাটিয়েছি।’
কষ্টের এই সময় বাবা–মাকে জানাতে চাননি অনুপম খের। তাই তিনি দাদাকে লিখে পাঠালেন, ফিরতে চান তিনি। কিন্তু দাদা সায় দিলেন না। পাল্টা লিখলেন, ‘অনুপম, তুমি তো সেই মানুষ, যে পানির স্রোতে বেরিয়ে গেছ, সে আবার বৃষ্টির পানিতে ভয় পাচ্ছ! তুমি এভাবে কোনোও দিনই বড় হতে পারবে না।’ কী করতে হবে বুঝে গেছেন অনুপম খের। বুঝে গেলেন মুম্বাই ছেড়ে ফেরা যাবে না।
এভাবে চলতে থাকে জীবন। এর মধ্যে একদিন সুযোগ চলে আসে। সময় মহেশ ভাটের একটি ছবিতে কাজ পান অনুপম খের। কিছু টাকা আর থাকার জায়গাও মেলে। কিন্তু সে সুখ স্থায়ী হয়নি। একদিন তিনি জানতে পারেন, ওই চরিত্রের জন্য অন্য কাউকে নেওয়া হয়েছে। চলে গেলেন মহেশ ভাটের কাছে। সরাসরি জিজ্ঞাসা করলেন, মহেশ ভাট তা স্বীকারও করেন। এবার ভেঙে পড়েন অনুপম খের। এ প্রসঙ্গে তিনি লিখলেন, ‘আমি সেই মুহূর্তে মুম্বাই ছেড়ে বাড়ি যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম, ঠিক সেই সময়ই মহেশ ভাট বলেন, “তোমার মতো এই চরিত্রে কেউ এত ভালো অভিনয় করতে পারবে না। তাই তোমাকে ছাড়া এই ছবি বানাব না।” আমাকে ডাকা হলো এবং আমি জীবনে প্রথম সিনেমায় অভিনয় করি মহেশ ভাটের হাত ধরে।’
বর্ষীয়ান এই অভিনেতা বলেন, ‘আজ পর্যন্ত ৫০০-র বেশি সিনেমা আমার হয়ে গিয়েছে। কিন্তু এখনো আমি ধন্যবাদ জানাই প্রতিদিন, সেই দিনগুলোকে, যখন শুধু ব্যর্থতাই ছিল। আমি ধন্যবাদ জানাই, সেই সব মানুষকে, যাঁরা আমায় অযোগ্য মনে করে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁদেরও ধন্যবাদ জানাই, যাঁরা আমায় সাহায্য করতে এগিয়ে আসেননি। এত কিছু না হলে আজকের আমি হতে পারতাম না। আর এটাই এখন বাস্তব।’
৬৪ বছর বয়সী অনুপম খের জানিয়েছেন, প্রতিদিন কাজে যাওয়ার সময়ে নিজেকে বলেন অভিনয় সম্পর্কে কিছু জানেন না। ‘ওটাই একমাত্র উপায়। যদি নিজের জ্ঞান নিয়ে বড়াই করা শুরু করি, তাহলে নতুন আর কিছু শিখতে পারব না।’
জানা গেছে, আগস্টে তাঁর আত্মজীবনী ‘লেসনস লাইফ টট মি, আননোইলিংলি’ প্রকাশ পাবে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমার জীবনের মতো আমার আত্মজীবনীও খুব ইন্টারেস্টিং হবে। আমি আমার জীবনকে সব সময় অটোবায়োগ্রাফির দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে এসেছি। আমি যখন নবাগত ছিলাম, তখন প্রচুর আত্মজীবনী পড়তাম। সফলদের জীবন আমাকে খুবই প্রেরণা জোগাত। আমি এক নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে উঠে এসেছি। আমার আত্মজীবনীও যদি অন্যকে প্রেরণা জোগায়, তাহলে খুব ভালো লাগবে।’