শেষ দিন এ কী করলেন দীপিকা!
অ্যাসিড-সন্ত্রাসের শিকার লক্ষ্মী আগরওয়ালের জীবনী নিয়ে একটি চলচ্চিত্র তৈরি করবেন মেঘনা গুলজার। তাঁর বাবা গুলজার ভারতের প্রখ্যাত কবি, গীতিকার, চিত্রনাট্যকার, চলচ্চিত্র পরিচালক ও প্রযোজক। মেঘনা গুলজারের নতুন ছবির নাম ‘ছপাক’। ‘রাজি’ বানিয়ে এর আগে ফিল্মফেয়ার পুরস্কার জিতেছেন তিনি। ‘ছপাক’ ছবিতে সেই লক্ষ্মী আগরওয়ালের চরিত্রটির জন্য তাঁর খুব পছন্দ দীপিকা পাড়ুকোনকে। কিন্তু মাত্র ‘পদ্মাবত’ ছবিতে দারুণ গ্ল্যামারাস চরিত্রে যিনি অভিনয় করেছেন, সেই তিনি অ্যাসিডদগ্ধ কোনো মেয়ের চরিত্রে অভিনয় করতে রাজি হবেন তো? ছবিতে লক্ষ্মী আগরওয়ালের চরিত্রের নাম মালতী।
‘ছপাক’ ছবিতে অভিনয়ের প্রস্তাব নিয়ে গত বছর শেষ দিকে দীপিকা পাড়ুকোনের সঙ্গে আলোচনা করেন মেঘনা গুলজার। সবকিছু শুনে ছবিটিতে অভিনয় করতে রাজি হয়ে যান দীপিকা পাড়ুকোন। শুধু তা-ই নয়, ছবিটি প্রযোজনা করার ব্যাপারেও তিনি আগ্রহ প্রকাশ করেন। এরপর মুম্বাই মিররকে দীপিকা পাড়ুকোন বলেন, ‘যখন গল্পটি শুনেছিলাম, তখন আমি স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। ঘটনাটি আমাকে গভীরভাবে স্পর্শ করেছে। অ্যাসিড-সন্ত্রাস এক ভয়ংকর সহিংসতা। এর বিরুদ্ধে আমাদের সবাইকে প্রতিবাদ করতে হবে। আর যারা এই সহিংসতার শিকার, তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে, তাদের মনে শক্তি ও সাহস জোগাতে হবে।’ তিনি আরও বললেন, ‘আমি মনে করি, এ ধরনের গল্পগুলো সিনেমায় বলা দরকার। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি গল্প, সত্য ঘটনা। আশা করছি, দারুণ কিছু আসছে।’
আর মেঘনা গুলজার বলেন, ‘আমার বারবার মনে হয়েছিল, আমি যেমনটা চাইছি, তাতে রাজি হবেন না দীপিকা। তিনি এই ছবি করতে চাইবেন না। কিন্তু তিনি তা করেননি। পরপর তিনটি গভীর চরিত্র করার পর একটি হালকা ছবি করতে চেয়েছিলেন দীপিকা। আর আমার ছবিটি অ্যাসিড-সন্ত্রাস নিয়ে। এক অ্যাসিড-আক্রান্ত নারীর সাহস ও শক্তির গল্প। তাতে রাজি হয়েছেন দীপিকা।’
২৫ মার্চ ছবিটির শুটিং শুরু হয়। সেদিন সকালে ইনস্টাগ্রামে দীপিকা পাড়ুকোন ছবির ফার্স্ট লুক প্রকাশ করেন। সেখানে দীপিকা পাড়ুকোনকে দেখে আঁতকে, শিউরে ওঠেন ভক্তরা। প্রথমে নিজেকে দেখে নাকি আঁতকে ওঠেন দীপিকা নিজেও। কোথায় সেই চিরচেনা সুন্দর চেহারা? এ যে অ্যাসিড-আক্রান্ত বীভৎস এক মুখ! তবে সেই মুখের এক কোণে তখনো লেগে আছে সেই হাসি, যে হাসি কেড়ে নিতে পারেনি অ্যাসিডও। যে হাসি অ্যাসিড-সন্ত্রাসীদের চিৎকার করে বলে, অ্যাসিড মুখ পোড়াতে পারলেও হাসি থামাতে পারে না। জীবন বা স্বপ্ন কোনোটাই পোড়ানো যায় না অ্যাসিডে।
ছবির ক্যাপশনে দীপিকা পাড়ুকোন লিখেছেন, ‘একটা চরিত্র, যা আমার সঙ্গে সারা জীবন থাকবে...মালতী। আজ থেকে শুরু হলো শুটিং। মুক্তি পাবে ২০২০ সালের ১০ জানুয়ারি।’
এরপর মুম্বাই মিররের একটি প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, এ ধরনের সাহসী আর অনুপ্রেরণার চরিত্র বাছাইয়ের জন্য অনেকেই দীপিকা পাড়ুকোনকে ধন্যবাদ ও অভিনন্দন জানিয়েছেন। ছবিতে তাঁর কুঁচকে যাওয়া ত্বক, ভ্রু-হীন চেহারা, মুখের সর্বস্ব পোড়া—এই লুক খুবই প্রশংসিত হয়েছে।
গত বুধবার শেষ হলো ‘ছপাক’ ছবির শুটিং। জানা গেছে, সেদিন শুটিংয়ের সেটে এক আবেগঘন পরিস্থিতি তৈরি হয়। শুটিং শেষ হওয়ার পর প্রায় সব ছবির সেটেই একটি ঘরোয়া আয়োজন হয়। এই আয়োজনের নাম ‘আসি’। অনেক দিন একসঙ্গে কাজ করতে গিয়ে শিল্পী ও কলাকুশলীদের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সবাই মিলে একটা পরিবার হয়ে যায়। শুটিংয়ের শেষ দিন একে অন্যের কাছ থেকে বিদায় নেন। সাধারণত হাসিখুশির মধ্য দিয়েই তা শেষ হয়। কিন্তু ‘ছপাক’ ছবির সেটে ‘আসি’ বলতে গিয়ে পরিচালক মেঘনা গুলজারকে জড়িয়ে ধরেন দীপিকা পাড়ুকোন। এ সময় তিনি নিজের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি, কাঁদতে শুরু করেন। আবেগে ভেসেছেন মেঘনা গুলজার নিজেও।
শুটিং শুরু হওয়ার পর মেঘনা গুলজার এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘দীপিকা কিন্তু চরিত্রটিতে ঢুকে পড়েছেন। তিনি মালতীর মাঝেই বাস করছেন। মালতীকে নিজের মধ্যে ধারণ করেছেন। শুটিং শুরুর আগে তিনি চরিত্রটি নিয়ে যথেষ্ট হোমওয়ার্ক করেছেন।’
ছবির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র সংবাদমাধ্যমকে জানায়, শুটিং চলাকালে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন দীপিকা। হঠাৎ সবকিছু কেমন স্থবির হয়ে পড়েছিল। ঘটনাটি এমন আকস্মিকভাবে ঘটে যায় যে কেউ কিছুই বুঝে উঠতে পারেনি। হঠাৎ ঘটলেও অবশ্য দ্রুত তা সামলে নিয়ে আবার শুটিং শুরু করা হয়।
দীপিকা পাড়ুকোন তাঁকে জড়িয়ে ধরেছেন—ছবিটি মেঘনা গুলজার টুইটারে শেয়ার করেছেন। তাঁদের পাশে আছেন বিক্রান্ত মাসে। ছবিতে তিনি মালতীর স্বামী অমল। ক্যাপশনে লিখেছেন, ‘মালতী আর অমলকে আমার সঙ্গে বয়ে বেড়াব।’ দীপিকা আর বিক্রান্তকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন পরিচালক।
‘ছপাক’ ছবির কাহিনি তৈরি হয়েছে দিল্লির একজন সাধারণ নারী লক্ষ্মী আগারওয়ালকে নিয়ে। মাত্র ১৫ বছর বয়সে ভয়ংকরভাবে অ্যাসিড-সন্ত্রাসের শিকার হন। নাঈম নামের প্রায় দ্বিগুণেরও বেশি বয়সী এক ব্যক্তি লক্ষ্মীকে প্রথমে প্রেম ও পরে বিয়ের প্রস্তাব দেন। স্বাভাবিকভাবেই লক্ষ্মী আর তাঁর পরিবার তা প্রত্যাখ্যান করে। ২০০৫ সালের এক সুন্দর সকালে লক্ষ্মী যখন হেঁটে বাজারে যাচ্ছিলেন, তখন বিয়ারের বোতলভর্তি অ্যাসিড ছুড়ে দেওয়া হয় তাঁর দিকে। অ্যাসিডে পুড়ে যায় লক্ষ্মীর মুখ, হাত। মুহূর্তেই সুন্দর মুখ হারিয়ে যায় অ্যাসিডের বীভৎসতার আড়ালে। রাস্তায় গড়িয়ে পড়ে চিৎকার করতে থাকেন লক্ষ্মী, আশপাশের মানুষগুলো তখনো হতভম্ব হয়ে দেখেছে সেই দৃশ্য! প্রায় পাঁচ মিনিট পর এক ট্যাক্সিওয়ালা এগিয়ে আসেন। পাঁজাকোলা করে তাঁকে গাড়িতে তুলে হাসপাতালে নিয়ে যান। শুরু হয় যমে মানুষে টানাটানি। ডাক্তারদের হার না মানা মানসিকতা লক্ষ্মীকে ফিরিয়ে আনে নিশ্চিত মৃত্যু থেকে।
লক্ষ্মীর গল্পটা হয়তো শেষ হয়ে যেত এখানেই। যেমন শেষ হয়ে যায় অন্যান্য হাজারো অ্যাসিডদগ্ধ নারীর। স্বাভাবিক জীবন শেষ হয়ে যায়। ঘোমটার আড়ালে লুকিয়ে জীবনকে তারা বয়ে নিয়ে যায়। একটা স্বাভাবিক মৃত্যু পর্যন্ত টেনে নেওয়া সে এক যন্ত্রণাদায়ক ক্লান্তিকর যাত্রা। কিন্তু দ্বিতীয়বার জীবন পেয়ে হার মানেননি লক্ষ্মী। বেআইনিভাবে রাস্তায় অ্যাসিড বিক্রি করা যাবে না—২০০৬ সালে হাইকোর্টে এই রায় চেয়ে আবেদন করেন। এর আগে এই আইনের আবেদনের জন্য রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে ৩০ হাজার মানুষের স্বাক্ষর সংগ্রহ করেছেন। দীর্ঘ সাত বছরের সংগ্রাম শেষ হয় ২০১৩ সালে। অবশেষে আদালত রায় দেন, ‘প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স ছাড়া অ্যাসিড কেনাবেচা করা যাবে না, পুরো ব্যাপারটাতে সরকারের নজরদারি থাকতে হবে।’
এর মধ্যে নিজের পড়াশোনা শেষ করেছেন। অ্যাসিড-আক্রান্ত নারীদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে খুলেছেন এনজিও। ভারতের তরুণদের অনেকেই তাঁকে চেনেন ‘প্রেরণাদায়ক বক্তা’ হিসেবে। এই হার না মানা মনোভাবের জন্য লক্ষ্মীকে পুরস্কৃত করেছেন সাবেক মার্কিন ফার্স্ট লেডি মিশেল ওবামা। তা ছাড়া ভারত সরকারও তাঁকে ভূষিত করেছে নানা পুরস্কারে। পেয়েছেন আন্তর্জাতিক সম্মাননা।
এখন এক কন্যাসন্তানের মা লক্ষ্মী একটা টিভি চ্যানেলে উপস্থাপিকা হিসেবে যুক্ত আছেন। সেই লক্ষ্মীই ‘মালতী’ হয়ে বড় পর্দায় হাজির হবেন দীপিকার এই নতুন ছবিতে।