মৃণালের চোখে মৃণাল
মৃণাল সেন। ফরিদপুরের ছেলে। পড়ালেখা করতে কলকাতা গিয়েছিলেন। সেই যে কলকাতার প্রেমে পড়া, আর ফেরেননি। শুধু তো লেখাপড়া নয়, জড়িয়ে পড়লেন অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে। দেশের দারিদ্র্য, বৈষম্য দেখে দেখে ফুঁসছিলেন। নিজের ভেতর জ্বলছিল আগুন। সে আগুন কী করে বাইরে আনেন? নাটক, গান তো আছে, আর কী করা যায়? তখনই আরেকবার প্রেমে পড়া। কলকাতা কিংবা স্ত্রী গীতা সেন নয়। মৃণাল প্রেমে পড়লেন চলচ্চিত্রের। নিজের ভেতরে ফুঁসে ওঠা আগুন, ফুলকি হয়ে বেরিয়ে পড়তে লাগল সেলুলয়েডের ফ্রেমে ফ্রেমে।
বাম আন্দোলন কিংবা শ্রেণি সংগ্রামের সঙ্গে মৃণালের যোগটা পুরোনো। তাই তাঁর চলচ্চিত্রে স্বভাবতই উঠে এসেছে নিম্নবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষের জীবন। সাতচল্লিশের দেশভাগের পরে দেশজুড়ে ব্যক্তিক, পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক যে সংকট প্রকট হয়ে ওঠে, তা-ই রাস্তা তৈরি করে দেয় মৃণালের ছবি নির্মাণের বিষয় নির্ধারণে। বাংলা চলচ্চিত্রের তিনজন পুরোধা চলচ্চিত্রকার বললে সত্যজিৎ রায় ও ঋত্বিক ঘটকের পাশে অনায়াসে নাম আসে মৃণাল সেনের। সত্যজিৎ ও ঋত্বিক পরিচিত স্বীয় পরিচয়ে। আর মৃণালের নাম বললে বিদগ্ধজনেরা এক কথাই বলেন, মৃণাল রাজনৈতিক কিংবা মৃণালের চলচ্চিত্র রাজনৈতিক। কিন্তু ফরিদপুরের আইনজীবী বাবার সন্তান নিজের চোখে কেমন? চলুন মৃণালের কাছ থেকেই জেনে নেওয়া যাক খানিকটা।
সাতচল্লিশের দেশভাগের পরে দেশজুড়ে ব্যক্তিক, পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক যে সংকট প্রকট হয়ে ওঠে, তা-ই রাস্তা তৈরি করে দেয় মৃণালের ছবি নির্মাণের বিষয় নির্ধারণে। বাংলা চলচ্চিত্রের তিনজন পুরোধা চলচ্চিত্রকার বললে সত্যজিৎ রায় ও ঋত্বিক ঘটকের পাশে অনায়াসে নাম আসে মৃণাল সেনের।
১৯২৩ সালের ১৪ মে ফরিদপুরে এক মফস্বল শহরে জন্ম মৃণাল সেনের। পৃথিবীতে এসে চোখ মেলে দেখলেন বিশাল একান্নবর্তী পরিবারে জন্ম তাঁর। আইনজীবী বাবা স্বাধীনতাসংগ্রামীদের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন অনেকবার। বিপ্লবীদের সভায় দেশাত্মবোধক গান গেয়েছিলেন তাঁর মা। শৈশব থেকেই এমন পরিবেশে বড় হয়েছেন। সেই মৃণাল কীভাবে কলকাতা গেলেন, ভিড়ে গেলেন বাম সমমনা বন্ধুদের সঙ্গে, তারপর গণনাট্য, সেখান থেকে চলচ্চিত্রে—তারই এক বয়ান দিয়েছিলেন ১৯৯৪ সালের ১২ জুলাই। বেঙ্গালুরুর ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব অ্যাডভান্সড স্টাডিজে দেওয়া সেই ভাষণে মৃণাল তুলে আনেন নিজের জীবনকে নিজেরই বয়ানে।
কলকাতা: আউটসাইডার থেকে এল ডোরাডো
১৯৪০ সালে পড়ালেখার জন্য কলকাতায় এলেন তরুণ মৃণাল সেন। মফস্বল ছেড়ে এত বড় শহরে এসে হকচকিয়ে যান। নিজেকে এই শহরের একজন মানুষ হিসেবে খাপ খাওয়াতে হিমশিম খাচ্ছিলেন। নিজেকে মনে হচ্ছিল বহিরাগত। ‘এভাবেই আমাদের ছোট গ্রামের সকলের চেনা এক যুবক শহরে একাকিত্ব বোধ করতে লাগল। আমি হয়ে গেলাম “আউটসাইডার”’, মৃণালের ভাষ্য।
তবে মৃণাল দেখতে পেলেন, ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হচ্ছেন তিনি। জুটতে লাগল বন্ধু। বন্ধুর দল ক্রমে বড় হয়। একসময় ভিড়ে যান ছাত্রসমাজের নানা আন্দোলনে। গ্রামের সেই তরুণটি খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এসে শহুরে হওয়ার পথ ধরলেন। মৃণাল বলেন, ‘আমি ভেতরে-ভেতরে পাল্টাচ্ছিলাম। তখনই আমার হাতে এল, রবীন্দ্রনাথের লেখা “সভ্যতার সংকট”। আস্তে আস্তে আমি চারপাশটাকে যেন আরও ভালোভাবে বুঝতে পারলাম। কলকাতার বহিরঙ্গের সে দুঃসময়, আমার মননে হয়ে উঠল এক পরম সুসময়।’
শুরু হয়ে গেল কলকাতার সঙ্গে দোস্তি। এই শহরের মানুষের জীবন কখন যেন আপন হয়ে উঠল মৃণালের। মৃণাল হয়ে উঠলেন কলকাতারই অংশ। পরে এই প্রভাব পড়বে তাঁর ছবিতে। তাঁর ছবিতে আপন হয়ে উঠবে কলকাতার জীবনযাপন। তিনি তৈরি করবেন কলকতা ত্রয়ী—‘ইন্টারভিউ’, ‘কলকাতা ৭১’ ও ‘পদাতিক’। মৃণাল বলেন, ‘তখন থেকেই কলকাতার প্রতি আমার ভালোবাসার শুরু। আমার কাছে কলকাতা হয়ে উঠল এক এল্ ডোরাডো। কলকাতা মানেই যেন উত্তেজক এক শহর আবার একই সঙ্গে উদ্বেগেরও। শুরুর সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত কলকাতা মানেই আবেগ, তারুণ্য, যৌবন, বিপ্লবের শহর।’
তাঁর ছবিতে আপন হয়ে উঠবে কলকাতার জীবনযাপন। তিনি তৈরি করবেন কলকতা ত্রয়ী—‘ইন্টারভিউ’, ‘কলকাতা ৭১’ ও ‘পদাতিক’।
গণনাট্য, গীতা সেন ও ‘রাতভোর’
কলকাতায় তখন গণনাট্য আন্দোলনের জোয়ার। বিজন ভট্টাচার্য, সুধী প্রধান, ঋত্বিক ঘটক, তাপস সেন, উৎপল দত্ত, মৃণাল সেনরা ছুটে বেড়াচ্ছেন নাটক নিয়ে। সেই দলে যুক্ত হয়েছেন গীতা সেনও। মহড়া থেকে ফেরার পথে বাড়িতে গীতাকে এগিয়ে দিয়ে আসেন বন্ধুরা। কখনো কখনো মৃণালও পৌঁছে দিয়ে আসেন। কিছুটা দায়িত্ব নিয়েও। হয়তো মুখে বলেননি ‘ভালোবাসি’। কিন্তু গীতা বুঝতেন, তাঁর প্রতি মৃণালের একটা ‘সহানুভূতি’ ছিল। ধীরে ধীরে মৃণালের মধ্যে একটা দায়িত্বের ব্যাপারও গড়ে উঠছে। গীতা সেনের ভাষায়, ‘অন্য সময়েও দেখতাম উনি আমাকে বেশ প্রোটেকশন দিতেন। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি আমাদের মধ্যে প্রেমের কথা, প্রেমের চাওয়াচাওয়িটা ছিল না। একটা মেয়ে, বড় অসহায়, তাঁকে খানিকটা সাহায্য করা। এ রকমই ছিল ব্যাপারটা। পরে অবশ্য দুই পরিবারের লোকেরা মিলে আমাদের বিয়ে ঠিক করলেন।’
নাটক চলছে। আন্দোলন চলছে। তারই মধ্যে ধীরে ধীরে গড়ে উঠছে ছবি করার ঝোঁক। পকেটে ছবি তৈরির বাজেট নিয়ে ঘুরতেন। চেষ্টা চালাতেন ছবি করার। কিন্তু উপায়টা আর হয়ে ওঠে না। অর্থাভাবটা এতটাই প্রকট হয়ে ওঠে যে লক্ষ্ণৌতে চলে যান। চাকরি নেন মেডিকেল রিপ্রেজেনটেটিভের। তবু মন থেকে ছবি করার চেষ্টাটা মোছেননি। গীতা সেনের ভাষায়, ‘সেখান থেকে লেখা চিঠিতে ওর ছবি করার ইচ্ছেটা বুঝতে পারতাম। আমার বড় কষ্ট হতো।’
১৯৫৩ সালে বিয়ে হয় মৃণাল ও গীতার। আর তারপরই তাঁর প্রথম ছবি ‘রাতভোর’ নিয়ে কাজ শুরু। কলকাতার অশ্বিনী দত্ত রোডের একটি বাড়িতে থাকতেন। ১৯৫৫ সালে তৈরি প্রথম ছবিটি নিয়ে যদিও সন্তুষ্ট ছিলেন না মৃণাল।
শুরুটা ছিল ‘দুর্ঘটনা’
মনের ভেতরে যে অদম্য যে ইচ্ছা লালিত ছিল, তারই বহিঃপ্রকাশ ‘রাতভোর’। মৃণাল সেনের প্রথম ছবি। কিন্তু যে মৃণাল মানুষের কাছে স্বমহিমায় উদ্ভাসিত, সেই মৃণাল এখানে ঠিক ধরা দিলেন না। তাঁকে আমরা দেখতে পাব আরও পরে। মৃণাল সেনেরও তা-ই ভাবনা। তিনি বলেন, ‘১৯৫৫ সালে তৈরি প্রথম ছবি আমার কাছে আক্ষরিক অর্থেই এক দুর্ঘটনা। আমার দ্বিতীয় ছবির নাম “নীল আকাশের নীচে”। সেটাও ছিল অতিরিক্ত আবেগপ্রবণ, আঙ্গিকভাবেই দুর্বল এক ছবি।’
তবে দ্বিতীয় ছবি থেকেই রাজনৈতিক চলচ্চিত্রের আভাস দিয়ে যাচ্ছিলেন মৃণাল। তাঁর কাছে ছবিটি গ্রহণযোগ্য এ কারণে, এটির প্রেক্ষাপট রাজনৈতিক। মৃণাল সেন বলেন, ‘যে গুণের জন্য আজও আমি ছবিটিকে গুরুত্ব দিই, তা হলো ছবিটির রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত।’
যে গুণের জন্য আজও আমি ছবিটিকে গুরুত্ব দিই, তা হলো ছবিটির রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত।মৃণাল সেন, পরিচালক
১৯৬০ সালে তিনি বানান ‘বাইশে শ্রাবণ’। ছবিটি মৃণালের পছন্দের। প্রথম দুই ছবিতে যে আবেগের ঘনঘটা ছিল, এই ছবিতে তা ম্লান হয়ে গেল। বরং তার বদলে উঠে এল সমাজ বাস্তবতা। মৃণাল বলেন, ‘আমার তৃতীয় ছবি “বাইশে শ্রাবণ” আমাকে তৃপ্তি দেয়। অসাধারণ কিছু নয়, তবু এই ছবি আমার একান্ত আপন।’
‘বাইশে শ্রাবণ’-এ উঠে এসেছে প্রত্যন্ত গ্রামের নানা সমস্যার কথা। পাশাপাশি ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের প্রসঙ্গও। জন্ম, মৃত্যু ও ক্ষয়ে যাওয়া সম্পর্কের দলিল এই সিনেমা। মৃণাল সেন ছবিটিকে চিত্রায়িত করেছেন এভাবে, ‘দুর্ভিক্ষের করাল প্রভাবে কীভাবে মানুষের সুকুমার প্রবৃত্তি নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল, সেটা তুলে ধরাই ছিল আমার উদ্দেশ্য। এটা এক দুর্বিষহ সময়ের নিষ্ঠুর ছবি। স্বাভাবিকভাবেই এই ছবি বাণিজ্যিক সাফল্যের মুখ দেখেনি। তা সত্ত্বেও “বাইশে শ্রাবণ”-এর এক অন্তর্লীন জোরের শক্তি আমার ভবিষ্যৎ চলচ্চিত্রের প্রেরণা। আমি নিয়মিত ছবি করা শুরু করলাম।’
ফরাসি নবতরঙ্গ ও কলকাতা ত্রয়ী
এরই মধ্যে বেশ কিছু ছবি করা হয়ে গেছে মৃণাল সেনের। প্রশংসার পাশাপাশি জুটেছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। বাণিজ্যিকভাবেও সফল হয়েছে কিছু ছবি। কলকাতার সেই ‘আউটসাইডার’ এখন চলচ্চিত্রকার হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছেন। চলছে নিজের ছবির ভাষা, নির্মাণ ও বিষয় নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা। বলছি ‘পুনশ্চ’, ‘অবশেষে’, ‘প্রতিনিধি’, ‘আকাশকুসুম’, ‘মাটির মনীষ’, ‘ভুবন সোম’-এর কথা। ঠিক এ সময়ে কলকাতার চলচ্চিত্রে এক নতুন হাওয়া দিল ফরাসি নবতরঙ্গ। মৃণাল সেনও ওই হাওয়ায় নিজেকে উড়িয়ে দিলেন। মূলধারার ছবি করার পদ্ধতির বদলে এক নতুন পথের কথা ভাবতে লাগলেন। আর ১৯৭১ সালে মৃণাল হাজির হলেন এক নতুন ধারার চলচ্চিত্র নিয়ে।
‘ইন্টারভিউ’। মৃণালকে মানুষ চিনলেন তাঁরই রূপে। মৃণাল বলেন, ‘...১৯৭১ সালে “ইন্টারভিউ” ছবিতে আমি এক অদ্ভুত পরিচয়লিপি ব্যবহার করলাম। চিত্রনাট্য, পরিচালনা ও গিমিক—মৃণাল সেন। সত্যি কথা বলতে “ইন্টারভিউ” ছবিটি তার বিষয়গুণে এক নতুন চলচ্চিত্র নির্মাণ রীতি দাবি করেছিল। প্রচলিত অর্থে “গল্প” বলতে যা বোঝায়, তা এ ছবিতে ছিল না। এটা ছিল এক শহুরে যুবকের ইন্টারভিউ দেওয়ার জন্য একটি স্যুট জোগাড় করার প্রচেষ্টার ছবি।’
এই ছবি দিয়ে সিনেমার তথাকথিত ধারা ভেঙে নতুন ধারার নিরীক্ষায় ব্যস্ত হয়ে উঠলেন মৃণাল সেন। তিনি বলেন, ‘সিনেমা-ভেরিতে আদলে তাঁর এই স্যুটের সন্ধানে ঘুরে বেড়ানোর দৃশ্যাবলি ছবিতে একটা তথ্যচিত্রেরও ধাঁচ এনে দেয়। সিনেমা থেকেও এবং অন্যান্য শিল্পকলার সমন্বয়ে গড়ে ওঠা এক শিল্পে আমি অত্যুৎসাহে সিনেমা তৈরির যাবতীয় প্রথা ভাঙার খেলায় মেতে উঠলাম।’
সিনেমা নিয়ে মৃণাল সেনের নিরীক্ষা আর ভাঙা-গড়ার খেলা চলতে থাকে। চলচ্চিত্রকার হিসেবে মৃণাল সেন কিংবা তাঁর চলচ্চিত্র ক্রমেই রাজনৈতিক হয়ে ওঠে। পরপর তিনি তিনটি ছবি করে ফেলেন। ‘ইন্টারভিউ’, ‘কলকাতা ৭১’ ও ‘পদাতিক’। কলকাতার সে সময়ের উত্তাল দিনগুলোর ছাপ স্পষ্ট হয়ে ওঠে ছবিগুলোতে। প্রশংসা যেমন পান, তেমনি পেয়েছেন সমালোচনাও। তবে সবকিছু ছাপিয়ে মৃণাল সেন চলচ্চিত্রকার হিসেবে হয়ে উঠলেন দারুণভাবে আলোচিত। মৃণাল সেন বলেন, ‘সময়ের চাপকে আমরা অস্বীকার করতে পারলাম না এবং আমাদের ছবির মধ্য দিয়ে আমরা যেন বিদ্রোহী হয়ে উঠলাম। আমাদের ছবিগুলো এক অর্থে প্রচারধর্মী হয়ে পড়ল। ১৯৭৩ সালে তৈরি “পদাতিক” ছবিটি অন্য দুটি ছবি থেকে আলাদা ছিল। এই অর্থে যে এই ছবিতেই প্রথম সামাজিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলা ছাড়াও চরিত্রগুলোর মধ্যে আত্ম-অনুসন্ধানের প্রচেষ্টাও দেখা গেল।’