নীনা গুপ্তার জানা-অজানা কথা আছে যে বইতে
উপমহাদেশের মানুষ নাকি আত্মজীবনী লিখতে জানেন না। এমন কথা প্রায়ই শোনা যায়। বলা হয়, আত্মজীবনী লিখলে নাকি কিছু অংশ এড়িয়ে যান লেখক। নিজের ভালো দিকটাই শুধু তুলে ধরেন।
বলিউড তারকা নীনা গুপ্তা ব্যতিক্রম। আত্মজীবনী ‘সাচ কাহু তো’ (যদি সত্যি বলি)–তে শাবানা আজমি, রেখা, স্মিতা পাতিল, ডিম্পল কাপাডিয়ার সমসাময়িক এ অভিনেত্রী অবলীলায় অনেক কথাই বলে গেছেন। সত্য নাকি মিথ্যা, তিনিই ভালো বলতে পারবেন। তবে তিনি বলে গেছেন অনেক কিছু।
দুই মলাটে বন্দী পাতায় পাতায় এক নারীর টিকে থাকার সংগ্রাম, একাকিত্ব, প্রেম, বিয়ে, সন্তানসহ আরও অজানা কথা উঠে এসেছে। এসেছে বিখ্যাত ক্রিকেটারের সন্তানের স্বীকৃতি না নেওয়া, চলচ্চিত্র প্রযোজকের অনৈতিক প্রস্তাবের কথাও।
বইটি প্রকাশ করেছে পেঙ্গুইন ইন্ডিয়া। সম্প্রতি বলিউড তারকা কারিনা কাপুর খান এব সোনালী বেন্দ্রের সঙ্গে ভার্চুয়াল এক আড্ডায় অংশ নেন নীনা। যেখানে নীনা বইয়ের বিভিন্ন অধ্যায় নিয়ে কথা বলেন, বর্ণনা করেন।
আত্মকথায় তাঁর ব্যক্তিগত এবং পেশাগত জীবনের অনেক অজানা বিষয় উঠে এসেছে। ভারতীয় গণমাধ্যম ‘হিন্দুস্তান টাইমস’ সে বই এবং সাক্ষাৎকার অবলম্বনে বেশ কিছু প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
প্রযোজকের সঙ্গে তিক্ত অভিজ্ঞতা
দক্ষিণি এক প্রযোজকের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন নীনা। সেদিন মুম্বাইয়ের জুহুর পৃথ্বী থিয়েটারে কাজ ছিল। জুহুতেই পৃথ্বী থিয়েটারের কাছাকাছি একটি হোটেল ছিল। সেখানে এক প্রযোজকের সঙ্গে দেখা করতে গেলেন। সাক্ষাতের সময় আগেই ঠিক করা ছিল। তবে কিন্তু যখন প্রযোজকের কক্ষে গিয়েছিলেন, তখন কেমন যেন অস্বস্তি, ভয় লাগছিল। নীনার মনে খটকা, ভুল করছেন না তো! বইতে ঠিক এভাবে লিখেছিলেন, ‘মনে ডাকছিল তাঁর রুমে গেলে খারাপ কিছু ঘটতে পারে। এ কারণে আমি তাঁকে নিচে লবিতে আসার জন্য বলেছিলাম।’
তবে নীনার তখন কাজের বেশ প্রয়োজন। দরকার ছিল সুযোগ। নানা কিছু ভেবে একসময় ওপরে গেলেন। রুমে ওই প্রযোজক (নাম প্রকাশ করেননি) নানা গল্প শুরু করেছেন। তিনি কী কী করেছেন, কাকে কাকে বলিউডে ব্রেক দিয়েছেন, কার যাত্রা হয়েছে তাঁর হাত ধরে—এসব নানা বিষয়। একসময় নীনা জানতে চাইলেন, ছবিতে তাঁর চরিত্রটি কী হবে?
উত্তরে সেই প্রযোজক বলেন, ‘নায়িকার বান্ধবী।’ শুনে ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামার ডিগ্রিধারী নীনা গুপ্তা বেশ বিরক্ত হয়েছিলেন। আর অপেক্ষা করতে চাইছিলেন না। সরাসরি বলে দেন, ‘আমাকে যেতে হবে।’ এমন সময় প্রযোজক অন্য রকম আচরণ করতে থাকেন। ইনিয়ে-বিনিয়ে নীনাকে সেখানেই এক রাত কাটানোর জন্য বলেন। এই অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে নীনা বলেন, ওই সময় আমার শরীর ঠান্ডা হয়ে আসছিল। মনে হয়েছিল, কেউ এক বালতি বরফ এনে আমার মাথায় ঢেলে দিয়েছে।
প্রথম বিয়েটা টিকল না
কৈশোর একবার বিয়ে হয়েছিল নীনার। ভদ্রলোকের নাম অম্লান কুসুম ঘোষ। পড়তেন মুম্বাই ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে (আইআইটি)। নীনা জানিয়েছেন ক্যাম্পাসে তিনি আর অম্লান লুকিয়ে দেখা করতেন। নীনাদের বাসার কাছেই ছিল ক্যাম্পাস। একদিন ঘটনা জানাজানি হয়ে যায়। তাতে অবশ্য কোনো সমস্যা হয়নি। বরং বিষয়টি সবাই স্বাভাবিকভাবেই মেনে নিয়েছিল। শুধু তা–ই নয়, একসময় অম্লানের সঙ্গে কাশ্মীরে যেতে চাইলে সবাই বিয়ের পরামর্শ দেন। একসময় তাঁরা বিয়ে করেন। কাশ্মীরে বেড়াতে যান।
অপরিণত বয়সের এই বিয়ে সুখের হয়নি। বিয়ের পর নিজেরাও বুঝতে পারেন, দুজনের মধ্যে বেশ অমিল। নীনা ছিলেন উচ্চাকাঙ্ক্ষী।
আটপৌরে চিন্তা–চেতনার অম্লান হয়তো চেয়েছিলেন তাঁর স্ত্রী গৃহিণী হয়ে থাকবে। একসময় নীনা-অম্লান আলাদা হয়ে যান। সম্পর্কের টানাপোড়েন বারবার নীনাকে আহত করেছে। এমনও একবার হয়েছিল, বিয়ে চূড়ান্ত। সব ঠিকঠাক। একদিন বিয়ের শাড়ি কিনতে যাচ্ছিলেন। পাত্র তাঁকে ফোন করে জানিয়ে দেন, তাঁর পক্ষে বিয়ে করা সম্ভব নয়। আত্মজীবনীতে আক্ষেপ করে নীনা লিখেছেন, কেন ওই মানুষটি তাঁকে বিয়ে করতে চাননি, আজও তা স্পষ্ট নয় তাঁর কাছে।
নীনার বাবা–মায়ের সম্পর্কও খুব একটা সুখের ছিল না। তাঁর শৈশব কেটেছে বাবা-মায়ের সম্পর্কের টানাপোড়েন দেখে। তাঁর মায়ের সঙ্গে বিয়ে হওয়া সত্ত্বেও দ্বিতীয় বিয়ে করেছিলেন নীনার বাবা। রাগে–শোকে আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলেন নীনার মা।
ভিভ রিচার্ডসের সন্তানের মা
‘সাচ কাহু তো’র অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এবং বড় একটা অংশজুড়ে আছে নীনার কন্যা মাসাবা গুপ্তা। এ কথা নিশ্চয় অনেকেরই জানা, মাসাবা কিংবদন্তি ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটার ভিভ রিচার্ডস এবং নীনা গুপ্তার সন্তান। মাসাবা এখন অনেক বড়, পেশায় ডিজাইনার। মাসাবার অধ্যায়টা যেকোনো পাঠকের মনে নাড়া দেবে।
মাসাবার জন্মের সময় নীনার আর্থিক দুরবস্থার কথা জেনে মন খারাপ হতে পারে পাঠকের। এ ক্ষেত্রে বলে নেওয়া ভালো, বিবাহবহির্ভূত সন্তানের ধারণাটা ভারতীয় সমাজে তখনো ট্যাবু। তা তিনি যতই তারকা হোন না কেন, নীনাকেও এ নিয়ে ভাবতে হয়েছিল। অন্তঃসত্ত্বা নীনাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন অনেকেই।
নীনা জানিয়েছেন মাসাবার জন্মের সময় যারপরনাই অর্থকষ্টে ছিলেন তিনি। তাঁর ব্যাংক অ্যাকাউন্টে মাত্র ২ হাজার রুপি ছিল। অথচ মুম্বাইয়ের মতো ব্যয়বহুল শহরে সে সময় একটি মাঝারি মানের হাসপাতালে ১০ হাজার রুপির মতো খরচ হতো। একসময় কিছু টাকা হাতে আসে। সব মিলে জমা করতে পেরেছিলেন ১২ হাজার টাকা। শুধু অর্থকষ্ট না, সন্তানের পিতার অনুপস্থিতিতে অন্তঃসত্ত্বা থাকার সময়টায় নানা সমস্যায় পড়তে হয়েছে। মনে আছে, বন্ধু অভিনেতা সতীশ কৌশিক সে সময় সন্তানসম্ভবা নীনাকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। ভদ্রলোক এমনও বলেছিলেন, যদি নীনার সন্তানের গায়ের রং শ্যামলা হয়, তাহলে যেন সন্তানের বাবা হিসেবে সতীশের নাম উল্লেখ করেন। কেননা সতীশও ছিলেন শ্যামলা।
সে সময় নীনাকে বিয়ে দেওয়ার জন্য কাছের বন্ধুরা খুব তৎপর হয়ে ওঠে। নীনার প্রতি সহানুভূতি দেখিয়েই এমনটা করেছিলেন তাঁরা। নীনা যেন মানুষের সমালোচনার মুখোমুখি না হন, এমনটাই ছিল তাঁদের ভাবনা। একপর্যায়ে একজন সমকামী ব্যাংক কর্মকর্তার সঙ্গে বিয়ে পাকাপাকিও করেছিলেন বন্ধুরা। ওই ব্যাংক কর্মকর্তা নীনার গর্ভের সন্তান নিয়েও কোনো প্রশ্ন তুলবেন না। বরং নিজের সন্তান হিসেবে পরিচয় দেবেন। এসবে মোটেও স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেননি নীনা। তিনি জানিয়ে দেন, কোনোরকম ‘বিতর্ক’ এড়াতে তিনি বিয়ের পিঁড়িতে বসতে রাজি নন। নিজের সন্তানের জন্য একজন মা যতটা করতে পারের, তিনি ততটাই করবেন।
‘সাচ কাহু তো’ বইয়ের প্রচ্ছদে উজ্জ্বল নীনার হাসিমুখ। ইনস্টাগ্রামে বইয়ের প্রচ্ছদ দিয়ে নীনা লিখলেন, ‘আমার বই, আমার প্রচ্ছদ, আমার কাহিনি’। যে বইয়ে তাঁর ব্যক্তিজীবনে নানান গল্পের পাশাপাশি উঠে এসেছে বলিউডের রাজনীতি, কাস্টিং কাউচের মতো অন্ধকার দিকগুলোও। ’৮০-এর দশকের মুম্বাইয়ের একটা ছোট্ট চিত্র মিলবে এতে। আছে নীনার ‘ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামা’-তে পড়াকালীন বিভিন্ন অভিজ্ঞতার কথাও। নীনা মনে করেন, এই অতিমারিকালে তাঁর আত্মজীবনী পড়ে ভালো সময় কাটবে পাঠকের।
সূত্র: হিন্দুস্তান টাইমস, ইনস্টাগ্রাম