দাপটের সঙ্গে লড়ে যাচ্ছেন সৌমিত্র
ঢাকার মতো কলকাতায়ও ‘নতুন স্বাভাবিক’ জীবন। কলকাতায় নতুন স্বাভাবিকেই হচ্ছে শারদীয় দুর্গোৎসব। তবে সেখানকার স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলোর সূত্র বলছে, এমন পরিস্থিতিতেও কলকাতা শহরে উৎসবের আমেজ একেবারে থেমে নেই। বিশেষ করে যাঁরা সারা বছর শিল্প–সংস্কৃতির জগতে রসদ জোগান, মানুষের বিনোদনে ভূমিকা রাখেন, তাঁদের অনেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সক্রিয়। তবে বর্ষীয়ান অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের শারীরিক পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ ও আশঙ্কা এখনো আছে। তিনি শুয়ে আছেন কলকাতা শহরের অন্যতম ব্যস্ত এলাকায় মিন্টো পার্ক লাগোয়া বেসরকারি হাসপাতালের বিছানায়। তিনি ভালো নেই। করোনা যুদ্ধে জয়ী হলেও অভিনেতার স্নায়ুজনিত সমস্যা ভাবাচ্ছে চিকিৎসকদের।
৬ অক্টোবর থেকে বেলভিউ হাসপাতালে ভর্তি এই অভিনেতা। বেশ কয়েক দিন ধরে শারীরিক পরিস্থিতি ভালোর দিকে থাকলেও গত মঙ্গলবার রাতে আবার খারাপের দিকে যায়। হাসপাতাল সূত্র জানিয়েছে, স্টেরয়েডের ডোজ কমানোর পরই নাকি বেড়ে গেছে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের অস্বাভাবিকতা।
তাই বলে এখনই আশাহত হওয়ার কিছু দেখছেন না চিকিৎসকেরা। দাপটের সঙ্গে রোগের বিরুদ্ধে লড়ে যাচ্ছেন সত্যজিতের ‘অপু’। তাঁর শরীরে নতুন করে কোনো সংক্রমণ নেই।
হৃদযন্ত্র, কিডনি, লিভার—সবই কাজ করছে ঠিকঠাক। মঙ্গলবার থেকে স্টেরয়েডের ডোজ বাড়ানো হয়েছে। নতুন নিয়মেই চলছে। বৃহস্পতিবার হাসপাতাল থেকে অভিনেতার স্বাস্থ্য নিয়ে যে বুলেটিন প্রকাশ করা হয়েছে, তাতে বলা হয়, ওই দিন সকালে রক্তচাপ বেড়েছিল সৌমিত্রের। অক্সিজেনেরও প্রয়োজন পড়েছিল। তবে চিকিৎসার মাধ্যমে তা নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছে।
কলকাতা থেকে প্রকাশিত স্থানীয় গণমাধ্যমগুলো হাসপাতালের বরাত দিয়ে জানিয়েছে, সৌমিত্রের এনসেফালোপ্যাথির সমস্যা নিয়ে দেশ-বিদেশের নামি নিউরো সার্জনের পরামর্শ নেওয়া হচ্ছে। চিকিৎসক অরিন্দম কর জানিয়েছেন, সৌমিত্র মোটের ওপর স্থিতিশীল আছেন।
বৃহস্পতিবার সকালে হিমোগ্লোবিন কিছুটা কমে যায়। রক্তচাপ ও অক্সিজেনজনিত সমস্যা হয়েছিল। সেটাও দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছে।
তবে সৌমিত্রের স্নায়ুজনিত সমস্যা চিকিৎসকদের কাছে একটা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সবার আশা, ইমিউনোগ্লোবিন ও স্টেরয়েডের মাধ্যমে তিনি আবারও স্বাভাবিকের দিকে ফিরে যাবেন।
এদিকে স্থানীয় গণমাধ্যমসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চিকিৎসারত সৌমিত্রের বেশ কিছু ছবি ফাঁস হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন পরিবারের সদস্যরা। কন্যা পৌলোমী বলেন, ‘একজন প্রবীণ শিল্পী প্রাইভেসি রক্ষা করার মতো সম্মান প্রাপ্য। দয়া করে এটুকু সুযোগ দিন।’
প্রসঙ্গত, চলতি মাসের শুরু থেকেই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের শরীরটা ভালো যাচ্ছিল না। শুরুতে শরীরে জ্বর ছিল। তবে করোনার কোনো উপসর্গ দেখা যায়নি। এরপরই চিকিৎসকের পরামর্শে তাঁর করোনার নমুনা পরীক্ষা করা হলে ৫ অক্টোবর তাঁর কোভিড-১৯ পজিটিভ রিপোর্ট আসে। ৬ অক্টোবর তাঁকে ভর্তি করা হয় বেলভিউতে। সেখানে সর্বশেষ ১৪ অক্টোবর তাঁর করোনার নমুনা পরীক্ষায় নেগেটিভ রিপোর্ট আসে। এরপরই সৌমিত্র সুস্থ হওয়া শুরু করেন। যদিও তাঁর করোনা ছাড়া অন্যান্য রোগ ছিল। এর মধ্যে রয়েছে প্রোস্টেট ক্যানসার, উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস।
অভিনয়, কবিতাচর্চা, রবীন্দ্রপাঠ, সম্পাদনা, মঞ্চনাটক—সব মিলিয়ে অনন্য সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। এখন বয়স ৮৫ বছর। ১৯৩৫ সালের ১৯ জানুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলায় তাঁর জন্ম। কলকাতা সিটি কলেজে বাংলা সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা শেষ করে সৌমিত্র ভর্তি হন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখান থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর করেন। কলেজের ফাইনাল ইয়ারে হঠাৎ একদিন মঞ্চে শিশির ভাদুড়ীর নাটক দেখার সুযোগ হয় তাঁর। সেদিনই জীবনের মোড় ঘুরে যায়। মঞ্চনাটকে মনোনিবেশ করেন তিনি।
সৌমিত্র অভিনীত উল্লেখযোগ্য ছবির মধ্যে রয়েছে ‘অশনিসংকেত’, ‘সোনার কেল্লা’, ‘দেবদাস’, ‘নৌকাডুবি’, ‘গণদেবতা’, ‘হীরক রাজার দেশে’, ‘আতঙ্ক’, ‘গণশত্রু’, ‘সাত পাকে বাঁধা’, ‘ক্ষুধিত পাষাণ’, ‘তিন কন্যা’, ‘আগুন’, ‘শাস্তি’, ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ ইত্যাদি। অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন সৌমিত্র। ২০০৪ সালে তাঁকে পদ্মভূষণে সম্মানিত করা হয়। এ ছাড়া জাতীয় পুরস্কার, দাদাসাহেব ফালকেসহ অনেক পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। অভিনয়ের পাশাপাশি আবৃত্তি, রবীন্দ্রপাঠ, সম্পাদনা, নাট্যসংগঠন করেছেন তিনি। ১৯৬০ সালে সৌমিত্র বিয়ে করেন দীপা চট্টোপাধ্যায়কে। তাঁদের এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে। মেয়ে পৌলমী চট্টোপাধ্যায় প্রতিষ্ঠিত নাট্যব্যক্তিত্ব।