‘ডার্লিং’ দিলীপ সাহেব
দিলীপ কুমার ছিলেন তাঁর বড় ভাইয়ের মতো। তাঁকে নিয়ে কত স্মৃতি। প্রথম আলোর মুম্বাই প্রতিনিধি দেবারতি ভট্টাচার্যকে তারই কয়েকটা শোনালেন অভিনেতা ধর্মেন্দ্র
নোকরি করতা, সাইকেল পে আতা যাতা।
ফিল্মি পোস্টার পে আপনা ঝলক দেখতা।
রাতো কো জাগতা, আনহোনি খোয়াব দেখতা।
সুভা উঠকর আয়নে সে পুছতা—
ম্যায় দিলীপ কুমার বন সকতা হু ক্যায়া?
দিলীপ সাহেবের উদ্দেশে লেখা এটা আমার শায়েরি। না, দিলীপ সাহেব একজনই হয়। ওনার মতো দ্বিতীয় কেউ কখনো হতে পারবে না। দিলীপ সাহেবের আলোয় আমরা সবাই আলোকিত। দিলীপ সাহেবের বিষয়ে কিছু বলতে গেলে আমার হৃদয় চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায়। উনি নেই। ওনার স্মৃতি থেকে প্রেরণা নিয়ে আগামী দিনগুলো বেঁচে থাকব।
সেই সোয়েটার
আমি ওনার কত বড় ভক্ত কারোর অজানা নয়। আমি জীবনে প্রথম সিনেমা দেখি, সেটা ছিল দিলীপ সাহেবের ‘শহীদ’। আমার বাড়িতে খুব কড়া শাসন ছিল। মা–বাবা অত্যন্ত কঠোর ছিলেন। সিনেমা দেখার কথা ভাবতেই পারতাম না। তখন আমি নবম অথবা দশম শ্রেণির ছাত্র। প্রথম সিনেমা দেখা শুরু দিলীপ সাহেবের ছবি দিয়ে। পর্দায় ওনাকে দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। মনে হচ্ছিল নিজের ভাইকে পর্দায় দেখছি। ওনাকে দেখেই সিনেমায় অভিনয় করার ইচ্ছা জাগে। দিলীপ সাহেবকে সবাই ভালোবাসতেন। আমিও চেয়েছিলাম সবাই যেন আমাকেও ওনার মতো ভালোবাসে। আমি জীবনে অর্থ বা খ্যাতি চাইনি। শুধু চেয়েছিলাম সবার ভালোবাসা। আর দিলীপ সাহেব দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে একদিন মুম্বাইতে পাড়ি দিয়েছিলাম। ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ পাওয়া মোটেও সহজ ছিল না। শুধু একজনের টানে এই শহরে আসা। এরপর আমি এক কনটেস্টের মাধ্যমে সিনেমায় কাজ করার সুযোগ পাই।
মনে মনে ইচ্ছা ছিল দিলীপ সাহেবের সঙ্গে একবার দেখা করার। সেই সুযোগ একদিন এসে যায়। এক প্রযোজনা সংস্থার অফিসে আমার দিলীপ সাহেবের বোন ফরিদার সঙ্গে আলাপ হয়। ব্যস, আমি তখন ফরিদাকে আবদার করে বসি যে দিলীপ সাহেবের সঙ্গে একবার সাক্ষাৎ করিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে। সানন্দে রাজি হয় ফরিদা। রাত সাড়ে আটটা নাগাদ আমাকে সাহেবের পালি হিলের বাংলোতে যেতে বলে। মনে হচ্ছিল এই সময়টা অতিক্রম করতে আমি আট শ বছর পার করে ফেলব। আমার আর তর সইছিল না। উত্তেজনায় বুক দুরুদুরু করছিল। সময়মতো পালি হিলের বাংলোতে আমি হাজির।
প্রথম দর্শনেই উনি আমাকে আপন করে নিয়েছিলেন, দিলীপ সাহেব বুঝেছিলেন যে আমিও ওনার মতো চিন্তাধারায় বিশ্বাসী। আমরা সমমনস্ক মানুষ। আমি তখন পাঞ্জাবের এক গ্রাম থেকে আসা গেঁয়ো ছেলে। আমার ভদ্রতা, বিনয়ী স্বভাব ওনার কোথাও ভালো লেগেছিল। কারণ উনিও একই রকমের মানুষ। উনি ওনার ছায়া আমার মধ্যে দেখতে পেয়েছিলেন। আমি শুধু ওনাকে দুচোখ ভরে দেখছিলাম। দিলীপ সাহেব ওনার জীবনের অনেক কথা আমাকে বলেছিলেন। এমনকি উনি পুনের রাস্তায় স্যান্ডউইচ বিক্রি করে পেট চালাতেন, তা–ও আমাকে বলেছিলেন। মনে হচ্ছিল বড় ভাই ছোট ভাইয়ের সঙ্গে ছোটবেলার নানান স্মৃতি ভাগ করে নিচ্ছেন। উনি কীভাবে বসেন, হাঁটেন, কথা বলেন এসব কিছু আমি অনুধাবন করছিলাম। প্রথম আলাপেই উনি আমাকে একদম আপন করে নেন। আমাকে ‘ধরম’ বলে ডাকতে শুরু করেন। ষাটের দশকে তখন পালি হিলে ঠান্ডা পড়ত। বেশ রাত হয়ে গেছে। দিলীপ সাহেব নিজের জন্য একটা শাল নিয়ে এলেন। আর আমাকে একটা সোয়েটার পরতে দিলেন। বললেন, ‘ধরম, এই সোয়েটারটা পরে নাও। কুয়াশা পড়ছে। ঠান্ডা লেগে যাবে।’ প্রথম আলাপেই একটা মানুষ আর একটা মানুষের জন্য এতটা ভাবতে পারে, তা ভাবাই যায় না। আমি সোয়েটারটা খুশি খুশি পরে নিই। আর দিলীপ সাহেবকে বলি যে এই সোয়েটারটা আমি আর ওনাকে ফেরত দেব না। এটা আমার কাছেই রেখে দেব। আজও আমি পরম যত্নে সোয়েটারটা আগলে রেখেছি। সোয়েটারের সেই উষ্ণতা আমাদের সম্পর্ককে আরও উষ্ণ করে তোলে।
দিলীপ সাহেবের বাড়ির দরজা আমার জন্য খুলে যায়। নানান ছুতোয় আমি ওনার বাড়িতে হাজির হতাম। একজন পাঠানের সঙ্গে একজন জাঠের মধ্যে এক অদ্ভুত ভালোবাসার সম্পর্ক তৈরি হয়। যার কোনো নাম ছিল না। আমাদের সম্পর্ক ক্রমেই গাঢ় হতে লাগল। আমরা একটা পরিবারের মতো হয়ে যাই। কারণে–অকারণে সময়ে–অসময়ে ওনার বাড়িতে চলে যেতাম।
ভোজনরসিক
দিলীপ সাহেব কথায় কথায় বলতেন, ‘ধরম, চলে আয়।’ ওনার বাড়িতে গিয়ে জমিয়ে খাওয়াদাওয়া করতাম। সায়রা (বানু) ফোন করে বলত, ‘ধরম, চলে আয়। আজ বিরিয়ানি বানিয়েছি।’ সায়রার আড়ালে দিলীপ সাহেব আমার পাতে দুচামচ বিরিয়ানি দিতেন। আর নিজে চার চামচ নিতেন। সায়রা দেখতে পেলে রেগে গিয়ে বলত, ‘ধরম, ওকে (দিলীপ সাহেব) আটকাও। খাওয়ায় ওর নিয়ন্ত্রণ নেই।’ সায়রার ভয়ে আমরা প্রায়ই বাইরে রেস্তোরাঁয় গিয়ে খাওয়াদাওয়া করতাম। সিসিআই ক্লাবে গিয়ে আমরা দুজনে প্রাণভরে স্যান্ডউইচ, ডিম খেতাম। আসলে দিলীপ সাহেব পেশোয়ারের লোক। ওখানকার মানুষেরা একটু বেশি ভোজনরসিক হয়। দিলীপ সাহেব তার ব্যতিক্রম ছিলেন না। আমার মনে হতো উনি অন্য সবার চেয়ে আমাকে একটু বেশি ভালোবাসতেন। দিলীপ সাহেব ভালো রান্না করতে পারতেন। রাজা–মহারাজাদের রেসিপি উনি বানাতেন। সায়রার থেকে রেসিপি নিয়ে স্যুপ বানাতেন। মুড ভালো থাকলে উনি রান্নাঘরে ঢুকে পড়তেন।
প্রথম পর্দায়
আমরা প্রথম একসঙ্গে বাংলা ছবি ‘পাড়ি’তে কাজ করেছিলাম। ওনার সঙ্গে পর্দায় আসতে পেরে দারুণ লেগেছিল। বুঝতে পারিনি কখন ছবির শুটিং শেষ করে ফেলেছি। এই সিনেমার অপর অভিনেতা অভি ভট্টাচার্য আমার আর দিলীপ সাহেবের ভালো বন্ধু ছিল। বাংলা মুলকের ‘ইছামতী নদীর তীরে’ শুটিং হয়েছিল। আমি, দিলীপ সাহেব ইছামতীর পারে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের বাংলা গান গাইতাম। আমরা তখন একটু–আধটু বাংলা শিখে ফেলেছিলাম। কলকাতার প্রেমে পড়ে যাই। কলকাতা আমার দারুণ লেগেছিল। নিউ থিয়েটার্সে বসে আমরা সবাই আড্ডা দিতাম। সুচিত্রা আমার ভালো বন্ধু ছিল। খুবই ভালো ছিলেন উনি। কলকাতায় শুটিং আমরা সবাই উপভোগ করেছিলাম।
দিলীপ সাহেব ভালো গান গাইতেন। মাঝে মাঝে গুনগুন করতেন। আমরা না শোনার ভান করে ওনার গান শুনতাম। আসলে দিলীপ সাহেব মানুষ হিসেবে ছিলেন দুর্দান্ত। অত্যন্ত মানবিক। সবার প্রতি যত্নশীল ছিলেন। স্পটবয় থেকে শুরু করে সবার কথা ভাবতেন। প্রত্যেককে সমান সম্মান দিয়ে কথা বলতেন। ওনার অন্তরটা অত্যন্ত সুন্দর ছিল। উনি আমাদের সবার ‘ডার্লিং’।
দিলীপ সাহেব সেটে কাজের মধ্যে ডুবে থাকতেন। অন্য কোনো দিকে তাকাতেন না। ‘ক্রান্তি’ ছবিতে ওনার ল্যাংড়ানোর দৃশ্য ছিল। দৃশ্যগুলো বাস্তবিক করার জন্য উনি জুতার মধ্যে পাথর ভরে দিয়েছিলেন। শুনেছি শুটিংয়ের সময় উনি খুব কষ্ট পেয়েছিলেন। শুরুর দিকে ক্রমাগত ট্র্যাজিক চরিত্র করতে করতে উনি অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন। ওনার মনের ওপর চাপ পড়েছিল। দিলীপ সাহেব বলতেন, ‘ধরম, দুই মাসের মধ্যে দশ দিনের জন্য কোথাও ঘুরে আয়। মুম্বাই থেকে দূরে চলে যা। দেখবি হালকা লাগবে।’
যাওয়ার বেলা
বিগত কয়েক বছর দিলীপ সাহেব কাউকে চিনতে পারতেন না। ওনার এক বই মুক্তির অনুষ্ঠানে আমায় শেষ চিনতে পেরেছিলেন। মঞ্চে ওঠার পর আমায় দেখে থমকে দাঁড়ান। তারপর আলতো হেসে আমার পিঠ চাপড়ান। তবে অনেককেই তখন উনি চিনতে পারেননি। সেই অনুষ্ঠানে দিলীপ সাহেব নিজের ছবির গান ‘মধুবন মে রাধিকা নাচে’ শুনে তালে তাল মেলাচ্ছিলেন। আমি সায়রাকে বলি, ‘দেখো, ওনার এই গানটা বেশ মনে আছে।’ প্রায়ই আমি দিলীপ সাহেবের বাড়িতে চলে যেতাম। উনি আমায় চিনতে পারতেন না। সায়রার সঙ্গে গল্পগুজব করে চলে আসতাম। দিলীপ সাহেবকে চোখের দেখা দেখেই খুশি থাকতাম। এখন আর সেই দেখাও দেখতে পাব না।