জন্মদিনে জানা–অজানা দিলীপ কুমার ও সেরা পাঁচ ছবি
ভারতীয় চলচ্চিত্রের ‘কোহিনূর’ দিলীপ কুমার আজ ৯৮-তে পা রাখলেন। কিন্তু জন্মদিনটা তাঁর কাটছে ঘরে, শুয়ে-বসে। কেননা বয়সের ভারে তিনি বড় ক্লান্ত। গত কয়েক বছর বার্ধক্যজনিত নানা সমস্যায় ভুগছেন বর্ষীয়ান এ অভিনেতা। এখন নড়াচড়াও করতে পারেন খুব কম। খাদ্যতালিকা যেমন সংক্ষিপ্ত, তেমনি চিনতেও পারেন কয়েকটি মুখ। করোনাকালে প্রতিদিনই তাঁর শরীর খারাপের দিকে যাচ্ছে। দুর্বল হয়ে পড়ছেন কিংবদন্তিতুল্য এই অভিনেতা। তাঁর স্ত্রী সায়রা বানু সে রকমই জানিয়েছেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।
জন্মদিনের এই বিশেষ দিনে শুভেচ্ছা বার্তায় ভরে গেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। বলিউডের অনেক তারকা ছবি দিয়ে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন বর্ষীয়ান এ অভিনেতাকে। অজয় দেবগন টুইটারে লিখেছেন ‘শুভ জন্মদিন ইউসুফ সাহেব । আপনি নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান। আপনি বছরের পর বছর ধরে আমার অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে আছেন। আপনার প্রতি শ্রদ্ধা আজ এবং সবসময়ের।’ এই বার্তাটির সঙ্গে দিলীপ কুমারের সঙ্গে নিজের একটি পুরোনো ছবি এই দিন শেয়ার করলেন অভিনেতা।
অন্যদিকে উর্মিলা লিখেছেন ‘বিশ্বের সব শব্দ যখন কোনো মানুষের বর্ণনা করতে ব্যর্থ হয়, তিনি দিলীপ কুমার– একজন অভিনেতা, একটি যুগ, এক কিংবদন্তি, একটি প্রতিষ্ঠান। অনেক আনন্দ পেতাম, যখন তিনি পর্দায় আসতেন প্রতিবার যেন জাদু নিয়ে হাজির হতেন তিনি । শুভ জন্মদিন।’
দিলীপ কুমারের নাম যুগের পর যুগ শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত হয়ে আসছে বিনোদন ভুবনে। কেননা বলিউড তো বটেই, ভারতের বাইরেও বিশ্বের অন্যতম উজ্জ্বল এক প্রতিভাবান তারকা তিনি। শুধু অভিনয় প্রতিভার কারণেই নয়, আরও বেশ কিছু দিক থেকে ভারতীয় ছায়াছবির জগতে কিছু মাইলফলক রচনা করেছেন তিনি।
জন্মদিনে আরও একটু জেনে নেওয়া যাক দিলীপ কুমারকে। হয়তো এসবের অনেকটা অনেকেরই অজানাও। ১৯২২ সালের ১১ ডিসেম্বর পাকিস্তানের কিসসা খাওয়ানি বাজারের জমিদার ও ফল ব্যবসায়ী লালা গুলাম সারওয়ার খানের ঘরে জন্ম হয় মহম্মদ ইউসুফ খান ওরফে দিলীপ কুমারের। ঠিক তার দুই বছর পর ১৯২৪ সালের ১৪ ডিসেম্বর তার পাশের কাপুর হাভেলিতে জন্ম হয় রাজ কাপুরের। তাই শৈশব থেকেই দুজন বন্ধু। বাবার সঙ্গে মতদ্বৈততায় বাড়ি ছাড়েন দিলীপ কুমার। পরিচয় গোপন করে ক্যানটিন কন্ট্রাক্টরের কাজ করেছেন। পরে আর্মি ক্লাবে স্যান্ডউইচ বিক্রি করেছেন।
এভাবেই পাঁচ হাজার টাকা জমিয়ে তিনি চলে যান ভারতের মুম্বাই। সেখানেই তাঁর জীবনে লাগে পরিবর্তনের হাওয়া। সেখানে তিনি নাম বদলে হন দিলীপ কুমার।
সিনেমা জগতে দিলীপ কুমারের প্রবেশ দেবিকা রানির বম্বে টকিজ প্রযোজনা সংস্থার কর্মী হিসেবে। মাসিক ১ হাজার ২৫০ টাকার বিনিময়ে কাজ শুরু করেছিলেন তিনি। সেখানেই অশোক কুমার ও শশধর মুখোপাধ্যায়ের সান্নিধ্য পান।
অভিনেতা হিসেবে দিলীপ কুমার বলিউডে প্রবেশ করেন ১৯৪৪ সালে ‘জোয়ার ভাটা’ সিনেমার মাধ্যমে। তবে নায়ক হিসেবে তাঁকে পরিচিতি দেয় ১৯৪৭ সালে মুক্তি পাওয়া ‘জুগনু’ ছবিটি। তারপরই বলিউডে শুরু হয় দিলীপ কুমারের ‘নয়া দওর’। ‘মুঘল-এ-আজম’, ‘মধুমতী’ থেকে ‘ক্রান্তি’, ‘মশাল’, ‘কর্মা’, ‘সওদাগর’, ‘কিলা’। এভাবে প্রায় পাঁচ দশক বলিউডে রাজত্ব করেছেন কিংবদন্তিতুল্য এই অভিনেতা। তিনিই প্রথম অভিনেতা, যিনি প্রতি ছবির জন্য এক লাখ টাকা করে পারিশ্রমিক নিতে শুরু করেন।
সায়রা বানুর সঙ্গে সংসার করলেও শুরুতে, এমনকি এখনো, দিলীপ কুমারের নামের সঙ্গে বিশেষভাবে জড়িয়ে আছে মধুবালার নাম। বলিউড তোলপাড় করা এক প্রেমকাহিনি সেটা। তাঁদের গল্পে প্রেম ছিল, বিরহ ছিল, ছিল অভিমান আর সবশেষে বিচ্ছেদ। ৯ বছর তিনি প্রেম করেন মধুবালার সঙ্গে। সেই সময়ের আলোচিত জুটি ছিলেন দিলীপ-মধুবালা। শেষ পর্যন্ত বিয়েটা করা হয়নি তাঁদের। শুরুতে সবাই রাজি ছিলেন।
মধুবালার বোন মধুর ভূষণ এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘প্রথা অনুযায়ী ওড়না নিয়ে ভাইজানের (দিলীপ কুমার) বোন এসেছিলেন। ভাইজানও পাঠান ছিলেন। আমার বাবা কখনোই আপার (মধুবালার) বিয়েতে অমত করেননি। আমাদের সেই সময় যথেষ্ট অর্থ-সম্পদ ছিল। আপা ও ভাইজানকে দেখে মনে হতো, তাঁরা দুজন দুজনের। ভাইজান প্রায়ই আমাদের বাড়িতে আসতেন। তাঁরা লং ড্রাইভে যেতেন অথবা ঘরে একসঙ্গে গল্প করতেন।’
দিলীপ কুমার ও মধুবালার সম্পর্কের বিচ্ছেদ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি “নয়া দৌড়” সিনেমার সময় একটি মামলা হয়। গোয়ালিয়রে শুটিং চলছিল। ওই জায়গায় “জাবিন জলিল” নামে অন্য এক সিনেমার শুটিং চলছিল। সেখানে কিছু লোক এক নারীর ওপর হামলা করে। এমনকি তার পোশাকও ছিঁড়ে দেয়। আমার বাবা খুবই চিন্তিত হয়ে পড়েন এবং লোকেশন পরিবর্তন করতে বলেন। এমন নয় যে তিনি আপাকে বাইরে শুটিং করতে দিতেন না। এর আগে মহেশ্বর, হায়দরাবাদ এবং অন্যান্য জায়গাতেও তিনি শুটিং করেছেন। ভাইজান আদালতে বাবাকে ডিক্টেটর সম্বোধন করেন এবং পরিচালকের পক্ষ নেন। এরপরই তাদের সম্পর্ক ভেঙে যায়।’
তবে পরবর্তী সময়ে আবারও সম্পর্ক জোড়া লাগানোর চেষ্টা করেছিলেন তাঁরা। মধুর ভূষণ বলেন, আপা ওই সময় অনেক কান্নাকাটি করতেন। তাঁরা বিষয়টি মীমাংসা করার জন্য ফোনে কথাও বলেছেন। ভাইজান বলেছিলেন, ‘তোমার বাবাকে ছেড়ে আসো, আমি তোমাকে বিয়ে করব।’ অন্যদিকে আপা বলেছিলেন, ‘আমি তোমাকে বিয়ে করব, শুধু বাড়িতে এসে বাবাকে জড়িয়ে ধরো এবং মাফ চাও।’ শুধু জেদের কারণে তাঁদের সম্পর্ক ভেঙে যায়। কিন্তু আমার বাবা কখনোই চাননি এই সম্পর্ক ভেঙে যাক। এ ছাড়া ভাইজান এসে তাঁর কাছে ক্ষমা চাইবেন সেটিও চাননি।’
অভিনেত্রী সায়রা বানুকে বিয়ে করেন দিলীপ কুমার। মধুর ভূষণ বলেন, যখন তাঁর বিয়ে হয়, শুনে আপা অনেক কষ্ট পেয়েছিলেন। কারণ আপা তাঁকে ভালোবাসতেন। তিনি বলতেন, ‘তার ভাগ্যে সে (সায়রা বানু) ছিল, আমি না। তিনি একজন সুন্দর মেয়েকে বিয়ে করেছেন। আমি তাঁকে নিয়ে খুশি।’ অবশ্য তাঁদের বিচ্ছেদের গল্পে কিশোর কুমারের নামটিও উচ্চারিত হয়। মধুবালাকে ভালোবাসতেন কিশোর কুমার। তুচ্ছ (পারিবারিক) কারণে সম্পর্ক ভাঙে মধুবালা-দিলীপের। মধুবালা তখন খুব অসুস্থ, ক্যারিয়ারও ম্লান হতে শুরু করেছে ধীরে ধীরে।
সে সময়ই মধুবালাকে প্রেম নিবেদন করেন কিশোর। মধুবালার বুকে বাসা বেঁধেছিল মরণব্যাধি, আর মনে জমা ছিল ক্ষোভ। তবে অসুখের যন্ত্রণার চেয়ে দিলীপ কুমারের ওপর ক্ষোভটাই ছিল বেশি। এ জন্যই কালক্ষেপণ না করে জেদের বশেই নিয়ে নিলেন সিদ্ধান্ত—কিশোর কুমারকেই বিয়ে করবেন তিনি।
মধুবালার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার পর বৈজন্তিমালার সঙ্গে দিলীপ কুমারের সম্পর্ক গড়ে ওঠে বলে জানা যায়। তবে এ বিষয়ে তেমন তথ্য পাওয়া যায়নি। ২২ বছরের ছোট অভিনেত্রী সায়রা বানুকে নিয়ে সংসারজীবন শুরু করেন দিলীপ কুমার। সেই থেকে দুজন একে অপরের সঙ্গী। তাঁর সঙ্গেই ৫৫ বছরের সংসার নায়কের। কারও প্রশংসা পেতে নয়, বরং দিলীপ কুমারের সেবা করার সুযোগ পেয়ে নিজেকে ভাগ্যবতী মনে করেন সায়রা বানু, এমনই জানিয়েছেন তিনি।
শোনা যায় ১৬ বছর বয়সে প্রথমবার ‘মুঘল-এ-আজম’ দেখেছিলেন সায়রা বানু। তৎকালীন অভিনেত্রী নাসিম বানুর মেয়ে সায়রা তখন থেকেই প্রেমে পড়ে যান হিরো দিলীপ কুমারের।
সায়রার মা নাসিম সব সময়ই চাইতেন দিলীপ কুমারের সঙ্গে সায়রার সম্পর্ক হোক। কারণ, তখন তাঁরা দুজন হিন্দি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিকে দিয়ে যাচ্ছিলেন একের পর এক হিট ছবি। এক সময় দিলীপ-সায়রার চার হাত এক হয় ১৯৬৬ সালের ১১ অক্টোবর।
ফিরে দেখা যাক তেমনই ৫ ছবি
দেবদাস (১৯৫৫): বিমল রায়ের পরিচালনা এবং দিলীপ কুমারের অভিনয়, ‘দেবদাস’-এ দুইয়ের যুগলবন্দী তো বটেই, পাশাপাশি ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে ‘দেবদাস’ আরেকটি দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। এই ছবিই শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাসকে ভারতের রুপালি পর্দায় জনপ্রিয় করে তোলে।
মধুমতী (১৯৫৮): শুধু দিলীপ কুমারের ক্যারিয়ারে নয়, ভারতীয় ছবির ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে রেখেছে ‘মধুমতী’। বিমল রায়ের পরিচালনা, সলিল চৌধুরীর সুর, ঋত্বিক ঘটকের চিত্রনাট্য এবং অবশ্যই দিলীপ কুমারের অভিনয় এ ছবির অলংকার। ছবির নাম ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন বৈজয়ন্তীমালা।
মুঘল-এ-আজম (১৯৬০): না বললেই নয় সঞ্জয় লীলা বানসালি যদি সার্থকতার সঙ্গে ভারতীয় ছায়াছবির ধারায় ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট নির্মাণের অন্যতম শিল্পী হন, তাহলে বলতেই হয় তাঁকে সেই প্রেরণা জুগিয়েছে কে আসিফের এই ছবি। মুঘল শাসনের পটভূমিতে রচিত এই অমর প্রেমের ছবিতে শাহজাদা সেলিমের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন দিলীপ কুমার।
আন্দাজ (১৯৪৯): এই ছবিতে অভিনয় করেছিলেন নার্গিস, রাজ কাপুর ও দিলীপ কুমার। ত্রিকোণ প্রেমের গল্পও ভারতীয় ছবিতে এল এই প্রথম, দিলীপ কুমারের অভিনয় সেখানে মনে রাখার মতো।
নয়া দৌড় (১৯৫৭): এই ছবিতে টাঙ্গাওয়ালা শংকরের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন দিলীপ কুমার। তাঁর হাত ধরেই ভারতীয় ছবিতে ধনী এবং নির্ধনের দ্বন্দ্বটি পরিস্ফুট হয়।