যৌন হেনস্তার ঘটনায় আচমকাই উঠে এল ভারতীয় বিনোদন জগতের বেতাব বাদশা অমিতাভ বচ্চনের নাম। তাঁর বিরুদ্ধে নির্দিষ্টভাবে কেউ বিশেষ কোনো অভিযোগ না আনলেও মুম্বাই ফিল্ম জগতের এক নামকরা হেয়ার স্টাইলিস্ট তীক্ষ্ণ আক্রমণ শানিয়েছেন ‘বিগ বি’ বচ্চনকে। আর তাকে কেন্দ্র করেই শুরু হয়েছে জল্পনা ও উঠে গেছে সেই মোক্ষম প্রশ্ন, তা হলে কি কেঁচো খুঁড়তে অজগরের আত্মপ্রকাশ ঘটতে চলেছে?
নিয়মিত ব্লগ লিখলেও সামাজিক কোনো সমস্যা নিয়ে অমিতাভ বচ্চন সচরাচর কোনো অভিমত জানান না। এ নিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে কম অভিযোগ নেই। গোরক্ষার নামে নিরীহ মানুষদের পিটিয়ে হত্যা নিয়ে তিনি মুখ খোলেননি। নোট বাতিল নিয়ে তাঁর কোনো মতামত জানা যায়নি। সালমন খান বা সাইফ আলি খানদের বিরুদ্ধে কৃষ্ণসার হরিণ হত্যার অভিযোগ নিয়ে তিনি রা করেননি। জেলখানা থেকে সঞ্জয় দত্তের মুক্তি নিয়েও নীরব ছিলেন। সাম্প্রদায়িকতার প্রতিবাদে বিদ্বজ্জনদের সরকারি খেতাব প্রত্যাখ্যান নিয়েও মত দেননি। বারবার তাঁকে এ নিয়ে প্রশ্ন করা হলেও কোনো সদুত্তর কেউ পাননি।
এমনকি এবার, অভিনেত্রী তনুশ্রী দত্ত যখন নানা পাটেকরদের বিরুদ্ধে যৌন হেনস্তার মারাত্মক অভিযোগ আনলেন, যা এই দেশের ‘#মি টু’ আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটাল, সেই বিষয়েও অমিতাভ ছিলেন নিরুত্তর। প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেছিলেন, ‘না আমার নাম নানা পাটেকর, না আমি তনুশ্রী দত্ত।’ তাঁর এই পাশ কাটানো মানসিকতার বিরুদ্ধে সামাজিক মাধ্যম সমালোচনায় মুখর হলে ৭৬ তম জন্মদিনের দিন শাহেনশা অমিতাভ বলতে বাধ্য হয়েছিলেন, ‘কোনো নারীই যেন অবাঞ্ছিত আচরণের শিকার না হন।’ সেদিন বোঝা যায়নি, দুদিনের মধ্যেই তাঁর প্রতি সন্দেহ জাগাতে কেউ এগিয়ে আসবেন।
সেই নারীর নাম স্বপ্না ভাবনানি। মুম্বাইয়ের ফিল্মি দুনিয়ার পরিচিত হেয়ার স্টাইলিস্ট। বয়স তাঁর ৪৭। নিজেকে নারীবাদী বলতে পছন্দ করেন। আর পছন্দ করেন ছবি তুলতে ও ব্লগ লিখতে। নিজের একটা প্রযোজনা সংস্থা আছে তাঁর। ‘বিগ বস’এর মতো জনপ্রিয় টিভি রিয়্যালিটি শোতে একবার অংশ নিয়েছিলেন। অভিনয়ও করেছেন ‘পেয়ার কা সাইড ইফেক্টস’, ‘আগলি ঔর পাগলি’র মতো কয়েকটা সিনেমায়। সেই স্বপ্না টুইট করেছেন। লিখেছেন, ‘বচ্চনের যৌন হেনস্তার বহু ঘটনার কথা শুনেছি। আশা করব সেই সব মহিলা এবার অন্তত মুখ খুলবেন। ওঁর ভণ্ডামি দেখতে দেখতে ক্লান্ত।’
‘#মি টু’ নিয়ে অমিতাভ বচ্চনের টুইট জুড়ে দিয়ে তাঁরই অভিনীত ‘পিঙ্ক’ সিনেমার কথা টেনে স্বপ্না লিখেছেন, ‘এটাই সবচেয়ে বড় মিথ্যা। পিঙ্ক সিনেমা মুক্তি পেয়েছে। চলেও গেছে। আপনার আন্দোলনকারীর ভাবমূর্তিও দ্রুত উবে যাবে। আপনার সত্যও খুব শিগগিরই প্রকাশ পাবে। আশা করি দুশ্চিন্তায় আপনি হাত কামড়াচ্ছেন। কারণ আঙুলে কোনো নখই যে আর অবশিষ্ট নেই।’
মুম্বাইয়ের এক চলচ্চিত্র সাংবাদিক, যাঁর টুইটার হ্যান্ডেলের নাম ‘রোজি রোটি’, স্বপ্নার টুইটকে সমর্থন করে বলেছেন, ‘বচ্চনের কাণ্ড-কারখানা নিয়ে সাংবাদিকেরা নিভৃতে কত কথাই না বলেন। তবে সেই সব কাহিনি কখনো প্রকাশ্যে আসে না। কিন্তু আর যাই হোক, দুর্বল মানুষদের নিরাপদ থাকার বিষয়ে ওঁর মতামত নেওয়ার মতো ভণ্ডামিগুলো এবার বন্ধ করা যেতে পারে।’
যৌন হেনস্তার নানা ঘটনার কাহিনি কানাঘুষো শোনা যেত প্রধানত বিনোদন ও গ্ল্যামার জগতে। সেই নব্বইয়ের দশকে মহিলা সংগীত শিল্পী আলিশা চিনাই যৌন হেনস্তার অভিযোগ এনেছিলেন সংগীতকার অনু মালিকের বিরুদ্ধে। ঘটনাটা আদালত পর্যন্তও গড়িয়েছিল। তারও আগে বচ্চনের বিরুদ্ধে অদ্ভুত ধরনের অভিযোগ করেছিলেন নায়িকা পারভীন বাবি। কিন্তু সেই সময় কেউই তাকে গুরুত্ব দেয়নি পারভীনের মানসিক অসুস্থতার দরুন। জনমতও সেই সব দিনে আজকের মতো এমন প্রবলভাবে গড়ে ওঠেনি। কিন্তু দিন যত এগিয়েছে, নারীর ক্ষমতায়ন যত বেড়েছে, যত বেশি অর্থনৈতিক ও সামাজিক স্বাধীনতা তাঁরা পেয়েছেন, চেতনার উন্মেষ যত ঘটেছে, আইনও যত সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে, ততই বেড়েছে অভিযোগের বহর। বিনোদনের জগতের বাইরে ছড়িয়ে পড়েছে নারী-চেতনা। শিক্ষার প্রসার ও প্রযুক্তির বিকাশ নারীকে করে তুলেছে সাহসী। সেই সঙ্গে তাঁরা পেয়ে চলেছেন সামাজিক সমর্থনও। গ্ল্যামার দুনিয়ার বাইরের নারীও আজ তাই সাহসে ভর দিয়ে এগিয়ে আসছেন। শিল্প, সাহিত্য, সংগীত, রাজনীতি, ধর্ম কোনো পেশাই আজ আর বাদ যাচ্ছে না।
যৌন হেনস্তার অভিযোগে আজ তাই কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছে একদা ডাকসাইটে সাংবাদিক ও বর্তমানে ভারতের কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী এম জে আকবরকে। অভিযোগ শোনা গেছে জম্মু-কাশ্মীর পুলিশের সদ্য অবসর নেওয়া এক অতিরিক্ত মহাপরিচালকের বিরুদ্ধে। অভিযোগকারী তাঁরই অধীনস্থ এক নারী ডেপুটি সুপার। করপোরেট দুনিয়াও বাদ যাচ্ছে না। টাটা মোটর্স তার করপোরেট কমিউনিকেশনের প্রধান সুরেশ রঙ্গরাজনকে ছুটিতে যেতে বাধ্য করেছে। কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চেয়ে নিয়েছেন লেখক চেতন ভগত, অভিনেতা রজত কাপুর। একের পর এক অভিযোগ উঠছে বিজ্ঞাপন জগতের দিকপাল সুহেল শেঠের বিরুদ্ধে। প্রতিদিন একের পর নারী সাহসে ভর দিয়ে এগিয়ে আসছেন। শোনাচ্ছেন তাঁদের অপমানের কাহিনি। চাইছেন প্রতিকার। আকবরের ভাগ্য এখনো অজানা। অন্যদেরও। তবে নড়েচড়ে বসেছে কেন্দ্রীয় সরকার। আন্দোলনের চাপে বাধ্য হয়েছে সাবেক বিচারপতিদের দিয়ে কমিটি গঠন করতে।
ভারতে অবশ্যই এ এক নব জাগরণ। পরবর্তী অধ্যায় ক্রমশ প্রকাশ্য।