আসরের ‘মধ্যমণি’ শর্মিলা ঠাকুর, রবীন্দ্রসংগীতে গলা মেলালেন তিনি
রবীন্দ্রসংগীত ‘আগুনের পরশমণি’র সঙ্গে মঙ্গলপ্রদীপ প্রজ্বালনের মাধ্যমে কনফারেন্স উদ্বোধন করেন ঠাকুর বংশের মেয়ে শর্মিলা; এই গানে গলাও মেলালেন তিনি।
রোববার সকাল ১০টা। ঢাকা ক্লাবের স্যামসন এইচ লাউঞ্জ। স্মিত হাসি ছড়িয়ে মিলনায়তনে এলেন শর্মিলা ঠাকুর; তাঁকে ঘিরে আবর্তন করছে ক্যামেরার লেন্স। বরাবরের মতো সমূহ আলো কাড়লেন তিনি।
শীতসকালে ফুলেল নকশা ছাপা জর্জেট শাড়ির ওপর কালো রঙের কার্ডিগান জড়িয়ে এসেছেন এই বাঙালি অভিনেত্রী। ধূসর চুল, হাতঘড়ি আর আংটিতে আভিজাত্য ফুটে উঠেছে।
আগে বার তিনেক ঢাকা সফরে এলেও ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে এবারই প্রথম। উৎসবের এশিয়ান চলচ্চিত্র প্রতিযোগিতা বিভাগের জুরির দায়িত্ব সামলাচ্ছেন তিনি। চলচ্চিত্র উৎসবের অংশ হিসেবে ঢাকা ক্লাবে ‘দশম আন্তর্জাতিক উইমেন ফিল্মমেকারস কনফারেন্স’–এর উদ্বোধনী আয়োজনের ‘মধ্যমণি’ হয়ে ওঠেন শর্মিলা ঠাকুর।
রবীন্দ্রসংগীত ‘আগুনের পরশমণি’র সঙ্গে মঙ্গলপ্রদীপ প্রজ্বালনের মাধ্যমে কনফারেন্স উদ্বোধন করেন ঠাকুর বংশের মেয়ে শর্মিলা; এই গানে গলাও মেলালেন তিনি। জোড়াসাঁকোর বিখ্যাত ঠাকুর পরিবারের সঙ্গে যোগ রয়েছে শর্মিলার। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড় ভাই দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাতনি ছিলেন লতিকা ঠাকুর। এই লতিকা ঠাকুরের নাতনি শর্মিলা।
উদ্বোধনের পর মঞ্চের সামনের নির্ধারিত আসনে বসলেন ‘দেবী’। কফি দিই—উৎসবের এক স্বেচ্ছাসেবকের প্রস্তাবে ‘না’ করলেন শর্মিলা। সদ্য ক্যানসার থেকে সেরে ওঠার পর বাইরের খাবারদাবারে সংযম টেনেছেন ৭৯ বছর বয়সী এই অভিনেত্রী।
চা পানের বিরতিতে শর্মিলা ঠাকুরের সঙ্গে আড্ডা জমিয়ে তুলেছেন নির্মাতারা। শর্মিলা ঠাকুর বলছেন, বাকিরা শুনছেন। শর্মিলার চোখও কথা বলে। শর্মিলার টানা টানা চোখের মায়াজালে কে জড়ায়নি? জাদুকরি চোখের জন্যই নাকি শর্মিলাকে ফেরাতে পারেননি সত্যজিৎ রায়। মাত্র ১৩ বছর বয়সে সত্যজিৎ রায়ের ‘অপুর সংসার’ সিনেমায় অপর্ণা চরিত্রে রুপালি পর্দায় নাম লেখান কলকাতার স্কুলপড়ুয়া কিশোরী শর্মিলা।
কুড়ি বছর বয়সে কলকাতার ছেড়ে মুম্বাইয়ে পাড়ি জমান। ছয় দশকের ক্যারিয়ারে ‘কাশ্মীর কী কলি’ ‘অনুপমা’, ‘অ্যান ইভনিং ইন প্যারিস’, ‘আরাধনা’, ‘দাগ’, ‘চুপকে চুপকে’র মত সুপারহিট সিনেমায় অভিনয় করে তারকাখ্যাতি পেয়েছেন। হালের ওয়েব সিনেমা ‘গুলমোহর’–এও পাওয়া গেছে তাঁকে।
শর্মিলা ঠাকুরের সঙ্গে আড্ডায় বেলজিয়ামের প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা ফিলিপা কারদোসোকেও দেখা গেল। ফিলিপা কারদোসোর হাতে কয়েকটি সাদাকালো ফটোগ্রাফ। ভারতীয় চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়কে নিয়ে প্রামাণ্যচিত্র ‘মানিকদা: মাই লাইফ উইথ রে’ নির্মাণ করেছেন ফিলিপা কারদোসো ও তাঁর স্বামী নির্মাতা বো ভ্যান দে ওয়ের্ফ।
২৫ বছর আগে দিল্লির পতৌদি হাউজে সেই প্রামাণ্যচিত্রের দৃশ্যধারণের সময় তোলা ছবিগুলো আগলে রেখেছিলেন ফিলিপা কারদোসো। ঢাকা চলচ্চিত্র উৎসবে অতিথি হিসেবে যোগ দিয়েছেন এই নির্মাতা। শর্মিলা ঠাকুর এই উৎসবে থাকবেন শুনে ছবিগুলো নিয়ে এসেছেন। একের পর এক ছবি দেখতে দেখতে স্মৃতিকাতর হয়ে উঠেন শর্মিলা।
‘অপুর সংসার’, ‘পথের পাঁচালী’ থেকে ‘দেবী’-সত্যজিৎ রায়ের সব সিনেমায় দেখেছেন এই বেলজিয়ামের নির্মাতা। এই নির্মাতার প্রতি মুগ্ধতা থেকেই তাঁকে নিয়ে প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণে দুই যুগ আগে ভারতে ছুটে এসেছিলেন তাঁরা। এই প্রামাণ্যচিত্রে শর্মিলা, আলোকচিত্রী নিমাই ঘোষসহ বেশ কয়েকজনের বক্তব্য নেওয়া হয়।
ফিলিপা কারদোসো প্রথম আলোকে জানান, প্রায় দেড় মাসের মতো ভারতের প্রামাণ্যচিত্রটির দৃশ্যধারণ করেছেন। দিল্লিতে শর্মিলা ঠাকুরদের পাতৌদি হাউসে দুই সপ্তাহের মতো ছিলেন তাঁরা। মাঝে ২৫ বছর আর শর্মিলার সঙ্গে দেখা হয়নি।
২৫ বছর পর শর্মিলা ঠাকুরের সঙ্গে দেখা আপ্লুত ফিলিপা কারদোসো প্রথম আলোকে বলেন, ‘২৫ বছর আগে তাঁকে যেমন দেখেছিলাম, এখনো তেমনই আছেন। তিনি দুর্দান্ত একজন মানুষ, ভীষণ মিশুক। তাঁর সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতা দারুণ ছিল। ’
শর্মিলা ঠাকুর এখনও দিল্লির পাতৌদি হাউসে থাকেন। নিজের মতো করে বাঁচতে ভালোবাসেন শর্মিলা। জীবনকে কখনোই তথাকথিত ছকে বাঁধতে চাননি। ভারতীয় ক্রিকেটার মনসুর আলী খান পতৌদিকে বিয়ে ও ষাটের দশকে বিকিনি পরে ফিল্মফেয়ারের ফটোশুট করে হইচই ফেলে দিয়েছিলেন তিনি।
মনসুর আলী খান পতৌদি ও শর্মিলা দম্পতির তিন সন্তান—সাইফ আলী খান, সোহা আলী খান ও সাবা আলী খান মুম্বাইয়ে থাকেন। সন্তান ও নাতি–নাতনিদের সঙ্গে সময় কাটাতে মাঝে মাঝেই মুম্বাইয়ে যান শর্মিলা ঠাকুর।
এবার ১০ দিনের সফরে ঢাকায় এসেছেন তিনি। শহরের এক পাঁচ তারকা হোটেলের প্রেসিডেনশিয়াল স্যুটে উঠেছেন তিনি। আগামী ২৬ জানুয়ারি সংবাদিকদের সামনে আসবেন তিনি। গতকাল শনিবার ঢাকার জাতীয় জাদুঘরে উদ্বোধনী আয়োজনে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন এই অভিনেত্রী। ২৮ জানুয়ারি এই উৎসবের সমাপনী আয়োজনেও থাকবেন তিনি। ২৯ জানুয়ারি তাঁর দিল্লি ফেরার কথা রয়েছে।