রাস্তার পাশের ছোট্ট দোকান থেকে ‘ভারতের সেরা’ ইন্ডাস্ট্রি
সম্প্রতি ঘোষণা করা হয়েছে ভারতের ৭০তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। সেখানে দেখা গেছে দক্ষিণি সিনেমার জয়জয়কার। সেরা ছবি হয়েছে মালয়ালম সিনেমা ‘আত্তাম’। এ ছাড়া সেরা মালয়ালম সিনেমা হয়েছে ‘সৌদি ভেলাক্কা’। বলা যায়, ভারতের সিনেমায় মালয়ালম সিনেমার রাজত্ব যেন বেড়েই চলেছে। হয়ে উঠছে অনন্য। কিন্তু কীভাবে?
অবজ্ঞা পেরিয়ে
মলিউড ইন্ডাস্ট্রির শুরু থেকে একে ছোট করে দেখা এবং অবজ্ঞা করার প্রবণতা খেয়াল করা গেছে। মলিউডকে অবজ্ঞা করে ‘পেট্টিক্কাড়াউড’ বলা হতো। এর অর্থ হলো রাস্তার পাশের ছোট্ট দোকান, যেখানে সস্তা জিনিস বিক্রি হয়। অথচ রাস্তার পাশের সেই ছোট্ট দোকানের সিনেমাই যে সাফল্য লাভ করছে, তাতে করে মালয়ালম সিনেমা ভারতের সেরা কি না, সেই প্রশ্ন উঠেছে। শৈল্পিক ও বাণিজ্যিক দিকগুলো মিলিয়ে মালয়ালম সিনেমা যেভাবে ব্লকবাস্টার হচ্ছে, তাতে পুরো ভারত ছাপিয়ে বিশ্বের দর্শকের আগ্রহবিন্দুতে পৌঁছে গেছে। কেউ কেউ আবার মালয়ালম সিনেমাকে ভারতের সেরা বলছেন। কিন্তু কেন?
অনেক ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে মালয়ালম সিনেমা যে আজকের অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে, এর জন্য আনন্দিত পরিচালক জিও বেবি। ‘কাঁঠাল: দ্য কোর’(২০২৩) সিনেমার পরিচালক বলেন, ‘কয়েক বছর আগে পর্যন্ত আমরা সিনেমার মাধ্যমে সমস্যার কথা বলতাম। কিন্তু এখন উল্টোটা ঘটছে। মেইনস্ট্রিম সিনেমার ক্ষেত্রেও। কোনো সিনেমার মাধ্যমে রাজনৈতিক কোনো বার্তা ভুলভাবে দেওয়া হলে দর্শক প্রশ্ন তুলছেন। সেটা কোনো সুপারস্টার অভিনীত সিনেমা হলেও। এ ধরনের পরিবর্তন শুধু নির্মাতা বা শিল্পীদের কারণেই হয়নি। দর্শকেরাও এর অংশীদার।’
জিও বেবির ঝুলিতে ‘ফ্রিডম ফাইট’ (২০২২), ‘দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান কিচেন’(২০২১), ‘কিলোমিটারস অ্যান্ড কিলোমিটারস’-এর (২০২০) মতো জনপ্রিয় সিনেমা রয়েছে।
গল্পটা শিকড়ের
মালয়ালম সিনেমার মূল শক্তি কোনটা, সেই প্রশ্ন আমাদের সবার মনেই রয়েছে। কী কারণে এই সিনেমা এত জনপ্রিয়? এমন প্রশ্নের জবাবে চলচ্চিত্র সমালোচক নীলিমা মেনন সম্প্রতি ভারতের গণমাধ্যম ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে বলেন, ‘এর মূল শক্তি হচ্ছে নিজস্ব সংস্কৃতিতে নিহিত বিষয়কে উপজীব্য করে বাস্তবধর্মী সিনেমা তৈরি, যা এই সিনেমাকে অনন্য করে তোলে। “মঞ্জুমেল বয়েজ”-এর কথা যদি বলি, শিকড়ের কথা বলার কারণেই এটি অনেক দর্শকের মধ্যে অনুরণন তুলতে পেরেছে।’
‘বর্তমানে মালয়ালম সিনেমা জনপ্রিয় হয়ে ওঠার যে প্রবণতা আমরা খেয়াল করছি, তার জন্য আমার বেশ গর্ব হয়। কিছুদিন আগে আমি একটি ওটিটি প্ল্যাটফর্মের একজন প্রধানের সঙ্গে মিটিং করেছিলাম। তিনি আমাকে তথ্য-উপাত্ত দেখিয়ে বলেছিলেন, মালয়ালম সিনেমার দর্শক পাওয়া কঠিন। তিনি আমাকে মালয়ালম ভাষায় সিনেমা বানানোর ব্যাপারে তাঁর দ্বিধার কথা জানিয়েছিলেন। আমার মনে হয়, এখন আমরা এর সঠিক জবাবটা দিতে পেরেছি।’ নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিয়ে মালয়ালম সিনেমার ব্যাপারে এভাবেই মত দেন শ্রুতি শরণ্যম। তিনি ‘বি ৩২ মুঠাল ৪৪ ভারে’ (২০২৩), ‘চারুলতা’ (২০১৮) ও ‘মানুমালয়ালম’(২০১৭) সিনেমার নির্মাতা। শ্রুতি এগুলো মালয়ালম ভাষায় নির্মাণ করেছেন এবং সব কটি জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।
শ্রুতিও শিকড়কে বিষয়বস্তু করা এবং বিবেকবোধহীন ব্যাপারগুলো এড়িয়ে চলার ওপর জোর দিয়েছেন। কারণ হিসেবে তিনি দর্শকের আঞ্চলিক বিষয়বস্তুনির্ভর সিনেমা দেখার প্রবণতার দিকে আলোকপাত করেছেন।
ইকোসিস্টেম কিংবা বিশেষ কিছু নয়
মালয়ালম সিনেমা জনসাধারণের কাছে পৌঁছে যাওয়া কিংবা দর্শকপ্রিয়তা পাওয়ার ক্ষেত্রে কোন ব্যাপারটি ভূমিকা রাখছে? চিত্রনাট্যকার ও পরিচালক আনন্দ একার্ষি এমন একটি প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘আমি ব্যক্তিগতভাবে মালয়ালম সিনেমাকে বিশেষ বা দুর্দান্ত কিছু বলতে রাজি নই। তবে কিছু কারণ তো আছেই। এর মধ্যে তারকা অভিনয়শিল্পীদের স্ক্রিপ্ট নির্বাচনের ব্যাপারটা রয়েছে। এখানে আমি মামুত্তির কথা বলব। তিনি “কাঁঠাল: দ্য কোর” সিনেমাটি করেছেন। তাঁর তো বড় একটা দর্শকশ্রেণি রয়েছে। এটাও সিনেমা হিট হওয়ার ক্ষেত্রে প্রভাবক বলে মনে হয়।’ আনন্দ একার্ষি এবারের জাতীয় পুরস্কার পাওয়া সিনেমা ‘আত্তাম’-এর পরিচালক।
এ ক্ষেত্রে কেরালার ইকোসিস্টেমের একটি ভূমিকা রয়েছে বলে মনে করেন শ্রুতি শরণ্যম।
তিনি বলেন, ‘কেরালার ১০০ শতাংশ সাক্ষরতার হার, মানব উন্নয়ন সূচকে অবস্থান এবং কয়েক বছর ধরে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন আন্দোলনের কারণে সবার ভেতরে একধরনের সংবেদনশীলতা তৈরি হয়েছে। সাংস্কৃতিক বুনন আর শিকড়ের কাছে যাওয়ার যে টান, সেই ইকোসিস্টেমই কনটেন্টনির্ভর সিনেমা দেখতে আমাদের আগ্রহী করে তুলছে।’
এ ক্ষেত্রে নীলিমা সেন অন্য একটি বিষয় তুলে ধরেছেন। আমরা হয়তো মনে করি, মালয়ালম সিনেমা মানেই দুর্দান্ত কিছু। নীলিমা এই ধারণা থেকে বের হয়ে আসার কথা বলেছেন। তিনি মালয়ালম সিনেমাকে অন্যান্য ইন্ডাস্ট্রির মতোই মনে করেন। সেখানে ভালো সিনেমার পাশাপাশি খারাপ সিনেমাও তৈরি হয়।
তথ্যসূত্র: ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, দ্য ইকোনমিস্ট