তিনি ভারতে কোটি টাকা পারিশ্রমিক নেওয়া প্রথম অভিনেতা
তখন বলিউডে দেব আনন্দ, রাজেশ খান্না, অমিতাভ বচ্চনদের তুমুল দাপট। পাশাপাশি অন্য ভারতীয় ইন্ড্রাস্টিগুলোও মাথা তুলে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। এর মধ্যেই হঠাৎ করে দক্ষিণের এক জনপ্রিয় অভিনেতার নাম আলোচনায় আসে। ১৯৯৪ সালের কথা। এই আলোচনার অন্যতম কারণ হলো পারিশ্রমিক। এই অভিনেতা সিনেমাপ্রতি পারিশ্রমিক নিচ্ছেন এক কোটি টাকা। খরবটি পত্রপ্রত্রিকাসহ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। দাপুটে সেই অভিনেতা এখনো ভারতের চলচ্চিত্র অঙ্গনে দাপট দেখিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর সিনেমা এলে তরুণ অভিনয়শিল্পীদের সরে দাঁড়াতে হয়। ৬৯ বছর বয়সী এই অভিনেতার সিনেমা মানেই আয়–ব্যয়ে এগিয়ে থাকা, দর্শকদের হলে ফেরানো। তিনি কমল হাসান। এই অভিনেতা, প্রযোজক, পরিচালক ও গায়ক আজ পা দিচ্ছেন ৭০-এ।
ভারতের চলচ্চিত্র ইন্ড্রাস্টিতে আয় করা সিনেমার তালিকায় এখন কমল হাসানের সিনেমার নাম প্রথম দিকে থাকে। ‘বাহুবলী: দ্য বিগিনিং’, ‘পনিয়িন সেলভান’, ‘ব্রহ্মাস্ত্র’, ‘থ্রি ইডিয়টস’, ‘কানতারা’র মতো সিনেমাকে পেছনে ফেলে এগিয়ে থাকে কমল হাসানের ‘বিক্রম’ এবং গত মাসে মুক্তি পাওয়া ‘লিও’। বলা যায় এই সাফল্যের শুরুটা শৈশব থেকেই।
তখন কমলের কিশোর বয়স। সে সময় তাঁর মায়ের এক বন্ধুর মাধ্যমে সুযোগ হয় কিশোর চরিত্রে অভিনয়ের। মূলত কমলকে দেখেই তাঁরা পছন্দ করেন। ‘কালাথার কান্নাম্মা’ নামের একটি সিনেমায় অভিনয় করেন কমল। সেই অভিনয় দিয়েই তিনি প্রথমবার রাষ্ট্রপতির স্বর্ণপদক পেয়ে যান। তখন তাঁর বয়স ছিল ছয় বছর। আরও বেশ কিছু সিনেমায় অভিনয়ের সুযোগ হয়। পড়াশোনার জন্য বাসা থেকে চাপ ছিল। স্কুলে নিয়মিত যেতে হতো। মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে তিনি বুঝতে পারেন যে মেকআপে তাঁর আগ্রহ। কিন্তু সে পথে আর হাঁটা হলো না।
ক্যারিয়ার নিয়ে তখনো দোটানায় ছিলেন। শৈশবেই অভিনয় থেকে ৭ বছর বিরতি নেন। পরে ইন্ড্রাস্টিতে সহকারী ড্যান্সার হিসেবে নাম লেখান। শিক্ষানবিশ কোরিওগ্রাফার হিসেবেও কাজ করতে থাকেন। তখন কিছু সিনেমায় কাজ করলেও সেগুলোয় তাঁর নাম থাকত না। ক্যারিয়ার নিয়ে দোটানার ভেতরই একসময় তিনি খলচরিত্রেও অভিনয়ের প্রস্তাব পান। গল্প ও চরিত্র তাঁর মনে দাগ কাটে। শুরু করেন অভিনয়। ১৯ বছর বয়সে তিনি বিভিন্ন সিনেমায় পার্শ্বচরিত্রে অভিনয় শুরু করেন। সুযোগ তখনো হাতে ধরা দেয়নি। ঘুরতে থাকেন ভালো চরিত্রের নেশায়। এবার সুযোগ ধরা দেয়। ২০ বছর বয়সে তিনি প্রথমবার প্রধান চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ পান। সিনেমার নাম ‘কর্ণকুমারী’। প্রথম সিনেমা দিয়েই তিনি পেয়ে যান প্রথম ফিল্মফেয়ার পুরস্কার।
অল্প বয়সেই একের পর এক ব্যবসাসফল সিনেমা উপহার দিতে থাকেন কমল। পরে তাঁকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। একের পর এক নিজেকে এগিয়ে নিয়েছেন। মাত্র ২৪ বছর বয়সের এই তারকা ‘মারো চারিত্রা’ নামের সিনেমা দিয়ে তুমুল খ্যাতি পান। তাঁর নাম ভারতের বিভিন্ন ইন্ড্রাস্টিতে ছড়িয়ে যেতে থাকে। এই সিনেমা অন্ধ্র প্রদেশের ১৮টি সিনেমা হলে একটানা ২০০ দিন চলে। বেঙ্গালুরু, চেন্নাইয়ের কিছু সিনেমা হলে দুই বছর ধরে চলেছিল, যা ছিল রেকর্ড।
১৯৮৩ সালে ‘সাগরা সানগামাম’ সিনেমা দিয়ে অন্যরকম রেকর্ড গড়েন। এটাই প্রথম কোনো সিনেমা দক্ষিণের অন্ধ, কর্ণাটক, তামিলনাড়ু ও কেরালায় ১০০ দিন সফলভাবে চলে। সেই থেকে ভারতের সিনেমা অঙ্গনে সমানতালে অভিনয় আর রেকর্ড গড়ে যাচ্ছেন কমল হাসান। সে সময় এমনও হয়েছে, এক বছরে যে পাঁচ সিনেমা সবচেয়ে বেশি আয় করেছে, সেগুলো সবই কমল হাসান অভিনীত। তিনিই সর্বকনিষ্ঠ অভিনেতা হিসেবে মাত্র ২৭ বছর বয়সে ১০০টি সিনেমায় অভিনয় করেছেন।
ক্যারিয়ার যত এগিয়ে যেতে থাকে, কাজগুলো তত পরিপক্ব হতে থাকে। বাড়তে থাকে প্রতিযোগিতা। কিন্তু কখনোই দমে যাননি কমল হাসান। নিজের মতোই করেই ক্যারিয়ারকে এগিয়ে নিয়েছেন। এ জন্য তাঁকে ৮টি ভাষা পর্যন্ত শিখতে হয়েছে। বাংলা সিনেমায়ও তিনি অভিনয় করেছেন। শুধু অভিনেতা হিসেবে নয়, টিকে থাকার জন্য একসময় নিজস্ব প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানও গড়ে তুলেছেন কমল। তাঁর সাফল্য ঈর্ষা করার মতো। ভারতের একমাত্র অভিনেতা হিসেবে তাঁর সাতটি সিনেমা অস্কারে পাঠানো হয়েছে। সর্বাধিকবার তিনি ফিল্মফেয়ার পুরস্কার জিতেছেন।
কমল হাসান ভারতের সিনেমায় হিরো হিসেবে শেষ পর্যন্ত টিকে থাকতে ক্ল্যাসিক্যাল নাচ, ফাইট, পড়াশোনা আর নতুন গল্প ও প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়েছেন। তিনি সব সময় নিজেকে হিরো হিসেবে দেখতে চান। টাইমস অব ইন্ডিয়াকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আমি পড়াশোনা করেছি। ডিগ্রি নিয়েছি। কিন্তু জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে কখনোই শেখা থামাইনি। তুমি পড়াশোনা শিখে মাথায় গোল একটা হ্যাট দিয়ে নিজেকে জাহির করে ভাবলে সব শিখেছি, তখন তোমার পেছনে ফিরে দেখা উচিত। শেষ বলে কিছু নেই। টিকে থাকতে হলে আপডেট হতে হবে। শেষ মানেই তোমাকে অনিশ্চয়তা গ্রাস করবে।’
দীর্ঘ ৪ দশকের ক্যারিয়ারে প্রায় ২২৬টি সিনেমায় অভিনয় করেছেন কমল হাসান। বর্তমানে তিনি খুবই কম সিনেমায় অভিনয় করেন। পরিবার ও নিজেকে সময় দেন। চেন্নাইয়ের পাশাপাশি তাঁর লন্ডনেও বাড়ি আছে। দুই জায়গায় থাকেন। সিনেমাপ্রতি তিনি ১৩০ কোটি রুপি পারিশ্রমিক নেন। অনেকটা সাদামাটাভাবেই তিনি জীবন কাটাতে চান। তাঁর ব্যবহার করার জন্য ৮টি দামি ব্যান্ডের গাড়ি রয়েছে। এগুলোর মূল্য প্রায় ১০ কোটি টাকা।
এবার ৭০ বছরে পা দিলেন কমল হাসান। তাঁর অভিনয় এখনো দর্শকদের বিনোদন দেয়। এখনো যেন তরুণ অভিনয়শিল্পীদের কাছে কমল হাসান মানেই এক আতঙ্কের নাম। কারণ, তাঁর সিনেমাই বছরজুড়ে আলোচনায় থাকবে। সাম্প্রতিক বছরগুলোর মধ্যে ‘বিক্রম’ থেকে ‘লিও’ পর্যন্ত চারটি সিনেমাই বক্স অফিসে তুমুল আলোচনায় ছিল। বর্তমানে তিনি ‘থাগ লাইফ’ নিয়ে আলোচনায় আছেন। সিনেমাটি মুক্তি পাবে।
এই অভিনেতা জীবনবোধ নিয়ে বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমে জানান, জীবনকে সাধারণ হিসেবে দেখেন। অর্থ–বিত্তের ভেতরও গরিবদের পাশে থাকার চেষ্টা করেন। বইকে তিনি বলেন শিক্ষক। কারণ, এটা জীবনবোধ শেখাতে সাহায্য করে। আর তিনি কখনোই একই কাজ বারবার করতে পছন্দ করেন না। সব সময় তিনি নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। এটা জীবনকে অনেক সুন্দর করে। তিনি বলেন, ‘আমি একজন অভিনেতা, সুচিন্তিতভাবে নিজেকে উন্নত করাই আমার কাজ ও উদ্দেশ্য। এ জন্য আমি প্রচুর ভ্রমণ করতে পছন্দ করি।’ কমল হাসানের জন্ম ১৯৫৪ সালের ৭ নভেম্বর।
সূত্র: আইএমডিবি, দ্য ইকোনমিক টাইমস, ইন্ডিয়া টুডে