প্রযোজকের স্ত্রীকে নিয়ে পালিয়েছেন নায়ক, শুটিংয়ে তার ডাক পড়ে
রাজ কাপুরের বিয়ের আয়োজন চলছে। বিয়ের মণ্ডপে রাজের নতুন বউকে দেখতে গিয়েছেন অশোক কুমার। সেদিন নাকি নতুন বউ ঘোমটা সরিয়ে তাঁকে দেখেই বলে উঠেছিলেন, ‘অশোক কুমার আপনি! আপনি আসবেন ভাবতেই পারিনি।’ বিয়ের আসরে নববধূর এমন কাণ্ডে বিচলিত হয়েছিলেন রাজ কাপুর।
কিশোর কুমারকে তো চেনেনই। আর অশোক কুমার? হুট করে হয়তো এ প্রজন্মের দর্শকদের অনেকেরই চিনতে কষ্ট হবে। তবে এটা জেনে রাখুন, অশোক কুমার তিনি, যাঁকে বলা হয় প্রথম ভারতীয় সুপারস্টার নায়ক। তাঁর সেই সাদাকালো সময়ে তিনি ছিলেন ছোট-বড় সবার ‘দাদামণি’। সে সময়ের বলিউড ছিল দাদামণির। যে তারকা নাকি পুরোনো মুম্বাই (তৎকালীন বোম্বে) রাস্তায় বের হলে তাঁর ভক্তের ভিড়ে যানজটে লেগে যেত। প্রিয় তারকাকে একঝলক দেখবেন বলে রাস্তাজুড়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন শত শত নারী ভক্ত। গত বৃহস্পতিবার ছিল এই নায়কের জন্মবার্ষিকী। এ সূত্রে তাঁকে আরেকবার স্মরণ করা।
চলচ্চিত্র সমালোচকেরা মনে করেন, অশোক কুমারের তাঁর হাত ধরেই হিন্দি চলচ্চিত্রে গ্ল্যামারের সংযুক্তি। নিজে তো বটেই, ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রতিভা খুঁজে বার করে বড় পর্দায় মেলে ধরেছিলেন তিনি। তাই বলিউড দুনিয়ায় আজও তিনি দাদামণি।
বর্তমানে বলিউড দুনিয়ার শত শত কোটি টাকার ব্যবসা হলেও একটা সময়ে কোটির ঘরে ঢোকা অকল্পনীয় ছিল। কোটি টাকার ক্লাবের কথা কালেভদ্রে শোনা যায়। কোনো ছবির বাণিজ্য এক কোটির ওপরে হলেই নির্দিষ্ট ক্লাবে তার জায়গা হয়। এখানেও পথিকৃৎ অশোক কুমার। তাঁর অভিনীত ‘কিসমত’ প্রথম হিন্দি ছবি, যেটি এক কোটি টাকার ওপরে ব্যবসা করেছিল। ‘কিসমত’ বলিউডের প্রথম ব্লকবাস্টার ছবি। সে ছবি শুধু অশোক কুমারের নামে চলেছে।
আসল নাম কুমুদলাল গঙ্গোপাধ্যায়। ১৯১১ সালের ১৩ অক্টোবর বিহারের ভাগলপুরে জন্ম। বাবা ছিলেন আইনজীবী। চার ভাইবোনের মধ্যে তিনিই ছিলেন বড়। বোন সতীদেবীর বিয়ে হয়েছিল শশধর মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। তারপর ১৬ বছরের ছোট ভাই অনুপ কুমার নামে। সবার ছোট আভাস, সবার চেনা গায়ক নায়ক কিশোর কুমার। কুমুদলাল গঙ্গোপাধ্যায়কে পারিবারিকভাবে আদর করে দাদামণি নামে ডাকা হতো।
ভাইবোনদের মধ্যে সবার বড়, তবে আয়ু ছিল সবার চেয়ে বেশি। চোখের সামনে ভাইবোনেদের চলে যেতে দেখেছিলেন। ১৯৮৭ সালে নিজের জন্মদিনে ছোট ভাই কিশোর মারা যান। সেদিন থেকে আর জন্মদিন পালন করেননি অশোক কুমার।
ছেলে চলচ্চিত্র দুনিয়ায় নাম লেখাবেন, এটা বাবা মোটেও চাননি। বরং চেয়েছিলেন বড় ছেলে তাঁর মতো আইনজীবী হোন। কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি করিয়েছিলেন অশোককে। কিন্তু পরীক্ষায় ফেল করেন অশোক কুমার। বাবার ভয়ে বাড়ি ফেরেননি। পরের পরীক্ষা পর্যন্ত মুম্বাইয়ে বোনের বাড়িতে ছিলেন কয়েক মাস। সেই সময় হাতখরচের টাকা তুলতেই শশধরের বোম্বে টকিজে ল্যাব সহকারীর কাজ জোটে। সে থেকে রুপালি দুনিয়ার প্রেমে পড়ে যান।
বাবা নাখোশ, অশোকের চলচ্চিত্র দুনিয়া কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছিলেন না। কান্ডারি হয়ে আসেন ভগ্নিপতি শশধর। শ্বশুরকে বুঝিয়ে রাজি করান। প্রথম পাঁচ বছর ল্যাব সহকারীর কাজেই খুশি ছিলেন অশোক কুমার। একটি ঘটনা তাঁকে অভিনয়ে নামতে বাধ্য করে। বোম্বে টকিজের ‘জীবন নাইয়া’ ছবির শুটিং চলছিল। এমন সময় নায়ক নাজম-উল-হাসান অভিনেত্রী দেবিকা রানীকে নিয়ে পালিয়ে যান। দেবিকা রানীর স্বামী হিমাংশু রায় ছিলেন বোম্বে টকিজের মালিক। পরে দেবিকা রানী স্বামীর কাছে ফিরে আসেন। কিন্তু হাসানকে আর নায়ক করতে রাজি হননি হিমাংশু। ঘটনাচক্রে ডাক পড়ে অশোকের। তবে ঘটনাটি আরেক সূত্রে ভিন্ন রকমও শোনা যায়। ‘জীবন নাইয়া’ চলচ্চিত্রের নায়ক নাকি অভিনেত্রী দেবিকা রানীর সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন। নায়িকা স্বামী ও স্টুডিও প্রধান হিমাংশু রায়ের কাছে অভিযোগ করেন। এ কারণে নায়ক হাসানকে চলচ্চিত্র থেকে বাদ দিয়ে পরিচালকের আপত্তি থাকা সত্ত্বেও অশোককে স্থলাভিষিক্ত করেন।
হিন্দি চলচ্চিত্র দুনিয়া অশোক কুমারের মতো বহুমুখী প্রতিভা খুব কমই দেখেছে। নায়ক থেকে খলনায়ক অথবা পার্শ্বচরিত্র, সব চরিত্রেই সাবলীল। প্রথম হিট ছবি ‘অচ্ছুত কন্যা’। ভারতীয় চলচিত্রের প্রথম অ্যান্টিহিরো অশোক কুমার। সুদীর্ঘ ক্যারিয়ারে ‘চল চল রে নওজোয়ান’, ‘শিকারি’, ‘সাজন’, ‘মহল’, ‘মশাল’, ‘সংগ্রাম’-এর মতো ছবি উপহার দিয়েছেন। বোম্বে টকিজের প্রযোজকও হন পরে। ‘জিদ্দি’ ছবি বলিউডকে উপহার দেয় দেব আনন্দ, প্রাণের মতো অভিনেতা। ১৯৯৭ তিনি সর্বশেষ চলচ্চিত্র ‘আঁখো মে তুম হোতে’ অভিনয় করেন। ২৭৫টির বেশি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। অভিনয়ের পাশাপাশি ছবিও আঁকতেন তিনি। হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার চর্চা করেছেন। অভিনয় করেছেন মঞ্চেও।
দেশ-বিদেশ থেকে অনেক সম্মান এবং পুরস্কার পেয়েছেন অশোক কুমার। তাঁর ঝুলিতে রয়েছে ভারত সরকারের ‘পদ্মশ্রী’ ও ‘পদ্মভূষণ’ সম্মান। এ ছাড়া দাদাসাহেব ফালকেসহ ভারতের বেশ কিছু জাতীয় পুরস্কারও রয়েছে ঝুলিতে। ২০০১ সালের ১০ ডিসেম্বর হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান তিনি।