অমিতাভের বাঙালিযোগ
ফ্ল্যাশব্যাকে ষাটের দশকের শেষের দিকে কলকাতায় ফিরে গেলে দেখা যাবে, সন্ধ্যায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন ঠ্যাঙা এক যুবক। ৪৮০ রুপি মাইনের চাকরি, কোনো রকমে চলে যেত। পোশাক বলতে ছিল জ্যাকেট-ট্রাউজার আর একটা টাই। বর্ষাকালে জল জমত ধর্মতলায়। প্যান্ট গুটিয়ে হাঁটতেন—একই প্যান্ট পরে পরদিনও অফিস যেতে হবে তো। দুপুরের খাবার অফিসেই মিলত। রাতে বেশির ভাগ দিনই ফুচকা খেয়ে কাটত। যে কোম্পানিতে কাজ করতেন, সেখানে কর্মীদের মধ্যে বাস্কেটবল, স্কোয়াশসহ নানা খেলা লেগেই থাকত, তিনিও নেমে পড়তেন সোৎসাহে। কলকাতার জীবনে করতেন থিয়েটারচর্চাও।
ছিলেন কলকাতার বিভিন্ন এলাকায়। ৩০০ টাকার পেয়িং গেস্ট হিসেবে চৌরঙ্গী, টালিগঞ্জ, বালিগঞ্জ, আলিপুর, রাসেল স্ট্রিট—কোথায় থাকেননি! তবে ছোট ভাই বারবার তাগাদা দিচ্ছিলেন—একবার সিনেমায় চেষ্টা করে দেখবি নাকি? যাকে বলা হলো, তিনি তো একপায়ে খাড়া। অনেক দিন তো চাকরি করা হলো, নতুন কিছু করা যাক। বাক্সপেটরা গুছিয়ে সেই তরুণ হাজির হলেন মুম্বাইতে।
তিনি অমিতাভ বচ্চন। ছিলেন প্রথাগত হিন্দি নায়কের চেয়ে ঢের লম্বা, গলার স্বরটাও ভারিক্কি। কাজ সহজে মিলছিল না। চাকরিবাকরি নেই, পয়সার অভাবে মেরিন ড্রাইভের বেঞ্চিতে রাত কেটেছে। তবে এত দিন কলকাতায় থেকেছেন, নিয়তি বোধ হয় এক বাঙালির হাত ধরেই তাঁর চলচ্চিত্রযোগ লিখে রেখেছিল। মৃণাল সেনের ‘ভুবন সোম’-এ ধারাবর্ণনা দিয়ে শুরু হলো সিনেমা ক্যারিয়ার। প্রথম হিট, পুরস্কার—সে–ও এক বাঙালির হাত ধরেই। ১৯৭১ সালে হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায়ের আনন্দ করেন। ছবি হিট, সেরা পার্শ্ব অভিনেতা হিসেবে পান ফিল্মফেয়ার। তখন কে জানত এর বছর দুই পরেই সারা জীবনের জন্য জড়িয়ে যাবেন। ১৯৭৩ সালে বিয়ে করেন জয়া ভাদুড়িকে। কলকাতায় থাকা ও বাংলা সিনেমা করার সুবাদে যিনি নিজেকে ‘আধা বাঙালি’ বলে দাবি করেন, সেই থেকে অমিতাভ কলকাতার ‘জামাই বাবু’। আনন্দ-এর পর হৃষিকেশের সঙ্গে ‘অভিমান, ‘নমক হারাম’, ‘চুপকে চুপকে’র মতো ছবি করেন।
অমিতাভের অন্যতম প্রিয় শহর কলকাতা। সুপারহিট ‘দো আনজানে’ ছাড়াও ইয়ারানা’, ‘বারসাত কি এক রাত’, ‘দ্য লাস্ট লিয়ার’, পিকু’, তিন’সহ বেশ কয়েকটি ছবির শুটিং করেন শহরটিতে। কলকাতার বিশ্বখ্যাত নির্মাতা সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গেও ছিল তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। যাঁর সিনেমা দিয়েই অভিনয়জীবন শুরু করেন জয়া। ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ থাকলেও সত্যজিতের ছবিতে কাজ করা হয়নি। দেখা হলেই সত্যজিৎ বলতেন, ‘আমাদের অবশ্যই একসঙ্গে কাজ করা দরকার।’ একবার ভোপাল দুর্ঘটনা নিয়ে ছবি করতে চেয়েছিলেন সত্যজিৎ, নিতে চেয়েছিলেন অমিতাভকে। কিন্তু কোনো কারণে শেষ পর্যন্ত ছবিটি আর হয়নি।
সত্যজিতের বাড়িতে অনেকবারই গেছেন অমিতাভ। সেই স্মৃতি মনে করে তিনি একবার বলেছিলেন, ‘উনি যখন “প্রতিদ্বন্দ্বী”র সম্পাদনা করতেন, তখন তাঁর বাড়িতে গিয়েছিলাম। সারা ঘরে অসংখ্য বই, ম্যাগাজিন ছড়ানো—মাঝে একটা পিয়ানো। তবে দরকারমতো ঠিকই তিনি মুহূর্তেই প্রয়োজনীয় বই কীভাবে খুঁজে বের করতেন ঈশ্বর মালুম।’ সত্যজিতের এই অগোছালো ঘর নিয়ে প্রায়ই স্ত্রীকে খেপান অমিতাভ, ‘জয়া যখন আমার অগোছালো জিনিসপত্র গোছাতে থাকে, আমি বলি একবার মানিকদার কথা ভাবো।’
পশ্চিমবঙ্গের আরেক প্রখ্যাত নির্মাতা ঋতুপর্ণ ঘোষের সঙ্গেও ছিল তাঁর বন্ধুত্ব। ঋতুকে তিনি মনে করতেন ভারতের অন্যতম প্রতিভাধর নির্মাতাদের একজন। পরিচালকের ‘দ্য লাস্ট লিয়ার’ ছবিতে অভিনয় করেন অমিতাভ। কেবল কি তিনি, ঋতুর ছবিতে আলাদাভাবে কাজ করেছেন অমিতাভ পরিবারের প্রায় সব সদস্যই।
২০১০ সালের পর থেকে খুব বেশি বৈচিত্র্যময় চরিত্রে অমিতাভকে পাওয়া যাচ্ছিল না। সেখানে পরপর দুই বছর অভিনেতার ক্যারিয়ারের উল্লেখযোগ্য দুই চরিত্র করেন বাঙালি পরিচালকের সঙ্গেই। ২০১৫ সালে সুজিত সরকারের পিকুতে কোষ্ঠকাঠিন্যতায় ভোগা ভাস্কর ব্যানার্জি বা ২০১৬ সালে মুক্তি পাওয়া অনিরুদ্ধ রায়চৌধুরীর ‘পিংক’-এর দুঁদে আইনজীবী দীপক সেগালের কথা কে ভুলতে পারে।
বলিউডে অনেক বাঁকবদলের সাক্ষী অমিতাভের ওটিটি অভিষেকও হয়ে গেছে। সেটাও এক বাঙালির হাত ধরেই—সুজিত সরকারের ‘গুলাবো সিতাবো’ দিয়ে। চলতি বছর এই বলিউডের একের পর এক ছবি ফ্লপ, সেখানে আরেক বাঙালি অয়ন মুখার্জির ছবি ‘ব্রহ্মাস্ত্র’ হিট। ছবিটিতে যে অমিতাভ আছেন, সেটা কি আর বলে দিতে হবে?
অমিতাভ আজ আশিতে পা দিচ্ছেন, নিশ্চিতভাবেই তাঁর বাঙালিযোগের আরও বাকি আছে।