দক্ষিণ ভারতের যে সিনেমায় মজেছে বাংলাদেশি দর্শকও
গত আগস্ট ছিল হিন্দি সিনেমার জন্য সবচেয়ে বাজে মাসগুলোর একটি। আগস্টে মুক্তি পাওয়া ‘লাল সিং চাড্ডা’, ‘রক্ষা বন্ধন’-এর মতো ছবি চলেনি। কিন্তু বছরের অন্যান্য মাসের মতো গত মাসেও মাত করেছে দক্ষিণ ভারতের একটি ছবি—‘সীতা রামম’। ৫ আগস্ট মুক্তির পর তেলেগু ছবিটি বক্স অফিসে ঝড় তোলে। প্রথম দিনেই আয় করে ৫ কোটি ২৫ লাখ রুপি। ১০ দিনেই পূর্ণ করে ৫০ কোটির মাইলফলক। তেলেগু ছাড়াও তামিল ও মালয়ালম ডাবেও মুক্তি পায় ছবিটি।
ব্যাপক ব্যবসাসফল হওয়ায় উত্তর ভারতের বাজার ধরতে চলতি মাসের ২ তারিখ মুক্তি দেওয়া হয় হিন্দি সংস্করণও। এর মধ্যেই ৯ সেপ্টেম্বর অ্যামাজন প্রাইম ভিডিওতে মুক্তি পায় ‘হানু রঘুবাপুদির’ ছবিটি। ওটিটি প্ল্যাটফর্মের কল্যাণে ছবিটি সাড়া ফেলেছে বাংলাদেশেও। মুক্তির পরপরই চলে আসে বাংলা সাবটাইটেল। এর পর থেকেই নেট দুনিয়ায় ছবিটির প্রশংসায় মজেছেন বাংলাদেশি দর্শকেরা। অনেকের মতে, এটি সাম্প্রতিক সময়ের অন্যতম সেরা রোমান্টিক ছবি।
পুরো সিনেমা নিয়ে তো বটেই, ‘সীতা রামম’-এর বিভিন্ন সংলাপ, দৃশ্য, গান নিয়েও আলাদাভাবে লিখছেন দর্শকেরা। সালমা সারাহা নামের এক দর্শক লিখেছেন, ‘দেখার পর এখনো ঘোর কাটেনি।’ জাওয়াদ আফনান নামের আরেক দর্শক লিখেছেন, ‘শেষ করার পর মনে হলো, শেষ হয়েও যেন হইলো না শেষ। একটা ভিন্ন ধাঁচের প্রেমের গল্পের মুভি সীতা রামম।’ শঙ্খনীল দেব লিখেছেন, ‘একটি চিঠি, পেছনে থাকা ২০টি বছর, অজানা সত্য, দুটি দেশের শত্রুতার মধ্যে মানবতার এক মেলবন্ধন, সবকিছু মিলিয়ে সীতা রামম এ বছরের অন্যতম সেরা একটি মুভি হিসেবেই উজ্জ্বল হয়ে থাকবে।’
১৬৩ মিনিটের রোমান্টিক সিনেমাটি ১৯৬৪ সালের প্রেক্ষাপটে নির্মিত। ছবিটি শুরু হয় লেফটেন্যান্ট রামের গল্প দিয়ে, কাশ্মীরে ভারতীয় সেনাবাহিনীর চৌকস অফিসার সে। অনাথ রামের দুঃখ—সহকর্মীদের সবার পরিবার আছে, কিন্তু তাঁর কেউ নেই। ছুটিতে যাওয়ার জায়গা নেই, কাউকে চিঠি লেখারও নেই। এক সাংবাদিকের মাধ্যমে রামের এই দুঃখের কথা চাউর হয়। ব্যস, আর যায় কোথায়। প্রতিদিন রামকে চিঠি লেখা শুরু করে হাজারো মানুষ। যার মধ্যে একজন সীতা মহালক্ষ্মী। নিজেকে রামের ‘স্ত্রী’ দাবি করে আবেগঘন প্রেমপত্র পাঠাতে থাকে সে। চিঠিতে নিজের পরিচয় নিয়ে কিছু ক্লু দিলেও রাম বুঝতে পারে না। শুধু বুঝতে পারে, সে সীতার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। বন্ধুকে নিয়ে সীতার খোঁজে বেরিয়ে পড়ে সে। তাদের দেখাও হয়, কিন্তু তারপর আবার বিচ্ছেদ। কেন আলাদা হয়ে যায় রাম ও সীতা? পরের গল্প বিশ বছর পরের। পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তার নাতনি আফরিন হাজির হয় ভারতে। উদ্দেশ্য ভারতীয় সেনা কর্মকর্তা রামের চিঠি সীতাকে পৌঁছে দিতে হবে। কিন্তু বিশ বছর পর সীতাকে আর পাবে কোথায়? ভারতীয় সেনাসদস্য রামের চিঠি পাকিস্তান গেল কীভাবে? আর কেনই–বা সে চিঠি বিশ বছর আগলে রেখেছিলেন পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তা?
শুনতে থ্রিলার মনে হলেও ‘সীতা রামম’ আদ্যোপান্ত প্রেমের গল্প। প্রথমে ভারত, পরে বাংলাদেশের দর্শকের ছবিটি এত পছন্দ করার সম্ভবত মানুষের নস্টালজিয়া প্রীতি। ষাটের দশক, চেহারা না দেখে চিঠি লিখে প্রেম, দারুণ সব রোমান্টিক মুহূর্ত, গান আর সিনেমাটোগ্রাফি মিলিয়ে দর্শককে বুঁদ করে রেখেছে ছবিটি।
আর অতি অবশ্যই রাম চরিত্রে দুলকার সালমানের অভিনয়। হালে এই মালয়লাম অভিনেতা নানা ঘরানার সিনেমা করলেও রোমান্টিক সিনেমায় যে বলে কয়ে ছক্কা হাঁকাতে পারেন, সেটা আরেকবার প্রমাণ হলো। ছবিতে সীতা চরিত্রের ম্রুনাল ঠাকুর ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হচ্ছেন। আগে ‘সুপার থার্টি’, ‘জার্সি’র মতো হিন্দি সিনেমা করা এ অভিনেত্রীকে ‘সীতা রামম’-এ নতুনভাবে আবিষ্কার করেছেন দর্শক। এই মারাঠি অভিনেত্রীর এটাই প্রথম তেলেগু সিনেমা। ছবিটিতে আছেন এই সময়ে ভারতের অন্যতম জনপ্রিয় অভিনেত্রী রাশমিকা মান্দানাও। তবে পর্দায় সাধারণ গ্লামারাস অবতারে হাজির হলেও এই ছবিতে তাঁর ভিন্ন রূপ—পাকিস্তানি মুসলিম তরুণী আফরিনের চরিত্রে তিনিও ঠিকঠাক।
ছবির দৈর্ঘ্য একটু বেশি, চিত্রনাট্য আরও টানটান হতে পারত, বেশির ভাগ কমেডিও ততটা কাজের নয়—অনেক সমালোচকের এমন মন্তব্য থাকলেও ছবিতে মজে থাকা সাধারণ দর্শকের এসব নিয়ে মাথাব্যথা নেই। ছবির গান, দৃশ্যায়ন আর রোমান্টিক সব মুহূর্ত নিয়ে উচ্ছ্বসিত তাঁরা। ‘সীতা রামম’ দেখতে গিয়ে অনেকের মনে পড়ছে প্রখ্যাত তামিল পরিচালক মণি রত্মমের কথা। ছবিতে বিভিন্ন রোমান্টিক দৃশ্য, বৃষ্টির দৃশ্য, গান যেভাবে চিত্রায়ণ করা হয়েছে, তাতে মণি রত্মমের প্রভাব স্পষ্ট। পরিচালক হানু রঘুবাপুতি হয়তো তাঁর অগ্রজকে ট্রিবিউট দিয়েছেন কি না।
‘সীতা রামম’ দেখে অনেকের মনে পড়ছে শাহরুখ খানের জনিপ্রিয় হিন্দি সিনেমা ‘বীর জারা’র কথাও। তবে দু-একটি বিষয় ছাড়া সে অর্থে এই ছবির সঙ্গে ‘বীর জারা’র মিল নেই।
ছবির নায়ক দুলকার এখন তাঁর নতুন হিন্দি ছবি ‘চুপ’-এর প্রচারে মুম্বাইতে আছেন। ‘ব্রহ্মাস্ত্র’-এর দুর্দান্ত ব্যবসা ও ওটিটিতে মুক্তির পরও দুই সপ্তাহে হিন্দি সিনেমার বলয় থেকে পাঁচ কোটি রুপি আয় করেছে ‘সীতা রামম’-এর হিন্দি সংস্করণ।
সম্প্রতি ‘সীতা রামম’ নিয়ে মুম্বাইতে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়েছিলেন দুলকার। ছবির সাফল্য নিয়ে অভিনেতা বলেন, ‘হিন্দি সংস্করণ মুক্তির পর দর্শকেরা যেভাবে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন, সেটা অসাধারণ। এটা এমন একটা ছবি, যার সঙ্গে সবাই নিজেকে মেলাতে পারবেন। তবে এমন চরিত্র, সিনেমা সব সময় পাওয়া যায় না।’
‘সীতা রামম’-এর সঙ্গে শাহরুখ খানের সিনেমার মিল প্রসঙ্গে অভিনেতা আরও বলেন, ‘তিনি তো আমার প্রেরণা। তিনি এমন একজন রোল মডেল, যাঁকে অনুসরণ করা যায়—পর্দা ও পর্দার বাইরেও। আমি তাঁর সিনেমা দেখে বড় হয়েছি।’ ‘সীতা রামম’-এর সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ম্রুণালও সহ-অভিনেতা দুলকারকে প্রশংসায় ভাসান।