প্রথম আলো :
সিনেমা মুক্তির পরে এখন সময় কাটছে কীভাবে?
সিনেমা মুক্তির পরে যা হয়, দৌড়ঝাঁপ থাকে অনেক। ‘কড়ক সিং’-এর ক্ষেত্রেও আরও বেশি সময় দিতে হয়েছে। অসংখ্য ভক্তদের প্রতিক্রিয়ায় মুগ্ধ হচ্ছি। এদিকে নতুন সিনেমার কাজ এগিয়ে নিচ্ছি। সব মিলিয়েই চলে যাচ্ছে।
প্রথম আলো :
সিনেমাটি নিয়ে ভক্তরা কেমন প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন?
সিনেমাটি এখনো দর্শক দেখছেন। ভালো চলছে। প্রচুর এসএমএস পাচ্ছি। খুবই প্রশংসা করছেন সবাই। আর আপনাদের জয়াকে সবাই দারুণ পছন্দ করেছেন। জয়ার কিছু সিনস (দৃশ্য) নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। বিশেষ করে রেস্টুরেন্টের একটি দৃশ্য নিয়ে সাংবাদিকেরা কথা বলছেন। কথা না বলে এমন প্রেম খুব একটা দেখা যায় না। দৃশ্যটিতে চোখে–মুখে ভালোবাসা প্রকাশ পায়। আবার হাসপাতালে সে ‘কড়ক সিং’কে দেখতে এল। চিনতে পারল না। এমন কিছু দৃশ্য দেখে দর্শকেরা ইমোশনাল হয়ে কাঁদছেন। দর্শকদের অভিমত উপভোগ করছি। গল্পটা তো জীবনের। সেই জীবনকে তো ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। সেটা চরিত্র হলেও।
প্রথম আলো :
পঙ্কজ ত্রিপাঠি ও জয়া আহসান প্রথমবার একসঙ্গে অভিনয় করলেন। তাঁদের সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতা কেমন?
পঙ্কজ ত্রিপাঠি আর জয়ার অভিনয় শুটিংয়ের সময় দেখেই মুগ্ধ হয়েছিলাম। এত সুন্দর ওদের টোনালিটি। তাদের ভালোবাসার দৃশ্যগুলো পিংপং খেলার মতো মনে হচ্ছিল। ও ছুড়ে দিচ্ছে তো, ও গ্রহণ করছে। পঙ্কজের সঙ্গে জয়ার বিছানার দৃশ্যটি অসাধারণ হয়েছে। জয়া অসাধারণ কাজ করেছে। এই দৃশ্য, সম্পর্কটাকে তারা দর্শনের জায়গায় নিয়ে গেছে। অবাক করা বিষয় জয়া অন্য একটা দেশ থেকে, অন্য একটা ভাষায় কাজ করে যে দক্ষতা ও আন্তরিকতার প্রমাণ দিল, এতে আমি খুব খুশি। যেখানেই যাচ্ছি জয়াকে নিয়ে বেশি কথা হচ্ছে।
প্রথম আলো :
ট্রেলার প্রকাশের পর শয্যার দৃশ্যটি নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য শোনা যাচ্ছিল?
আমরা যখন কোনো কিছু ওপর ওপর দেখি, তখন এক রকম মনে হয়। আবার গভীরভাবে দেখলে চিত্রটা ভিন্ন হয়। তখন একটা মানুষকে চেনা যায়। আমাদের জীবনেও এমনটাই হয়। আমি দর্শকদের কিছু বলব না। আপনারা দেখুন সিনেমাটি। শুধু একটা কথাই বলব, দেখে আপনি বুঝতে পারবেন কত গভীরের এ কাহিনিটি। চরিত্রের গভীরতা, একাগ্রতা, নিবেদন পুরো সিনেমা দেখলেই বোঝা যায়। তখন চরিত্রকে ভালোবেসে ফেলবেন। আমি কিন্তু পঙ্কজ-জয়ার বেডসিনটা নিয়ে ভালো কথা শুনছি। জয়া-পঙ্কজের বিশেষ দৃশ্যটি আমার জীবনের সেরা দৃশ্যের একটি। আমার জীবনে যদি চারটি সিন ভালো লেগে থাকে, তার মধ্যে এই দৃশ্যটা অন্যতম। কারণ, এটা জীবনের কথা বলে, এটা আদর্শের কথা বলে। এটা একটা দর্শনের কথা বলে, দায়িত্বের কথা বলে।
প্রথম আলো :
সিনেমাকে অনেক রিয়েলিস্টিক মনে হচ্ছিল...
সবাই বলছে এত রিয়েলিস্টিক ছবি দেখিনি। কোনো মেকআপ নেই, কেউ ‘অভিনয়’ করছে না। মেলোড্রামা নেই। মনে হচ্ছে একটি ডকুমেন্টারি দেখছি। তার মধ্যে একটা রিয়ালিজম ভালোবাসা। এর মধ্যে একটি দর্শন আছে। এখন তো মানুষের মধ্যে দায়িত্ব নিতে দেখা যায় না। এগুলো দর্শক গল্পতে কানেক্ট করতে পেরেছে। কখনো জয়ার সঙ্গে মিশে যাচ্ছিল, কখনো পাবর্তীর সঙ্গে।
প্রথম আলো :
‘অন্তহীন’ এর ‘বৃন্দা’, ‘বুনোহাঁস’-এর ‘অমল’ বা ‘পিংক’-এর মৃণাল—আপনার সিনেমার চরিত্রগুলো বরাবরই দর্শকদের হৃদয় ছুঁয়ে যায়...
আমি যে চরিত্রগুলো চিনি না, সেগুলোকে কখনোই টানি না। মনগড়া চরিত্র আমি টানি না। যে কারণে আমি যে চরিত্রগুলোতে ভালোবেসে জড়াই, সেগুলো দর্শকদের অনেক চেনা। তাদের হৃদয় ছুঁয়ে যায়।
প্রথম আলো :
অনেক মানুষের সঙ্গেই তো আপনার দেখা হয়, এর মধ্যে কোনটা চরিত্র হয়ে উঠবে, এটা কীভাবে গল্পে আসে?
এটা অর্গানিক প্রসেস। আমাদের ফ্ল্যাটে একটা মেয়ে একা থাকত। যেহেতু সে ছেলেদের সঙ্গে মিশত, তার অন্য রকম লাইফস্টাইল ছিল। যে কারণে লোকে ভাবত মেয়েটি ‘খারাপ’। পরে আমি সে মেয়েটির বাড়িতে যাই। কথা বলার পরে আমার কাছে মনে হতো, মেয়েটি ফুলের মতো। অথচ তাকে লোকেরা খারাপ চোখে দেখছে। এটা থেকেই কিন্তু ‘পিংক’ সিনেমার তাপসী পান্নুর চরিত্রটি তৈরি হয়েছে। আবার ‘অনুরণন’ সিনেমায় দেখিয়েছিলাম এমন একটি বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক, যেখানে যৌনতা নেই। এটাও ছিল আমার চেনা ঘটনা। আবার ‘অন্তহীন’ সিনেমায় অন্তর্জালে চ্যাট নিয়ে। ভার্চ্যুয়াল সম্পর্কও যে কতটা গভীর হতে পারে দেখিয়েছিলাম। এটা আমার জীবনেই ঘটেছিল।
প্রথম আলো :
‘কড়ক সিং’ চরিত্রটি কীভাবে এল?
গল্পটা যখন বোনা শুরু হয়, তখন একটা কাঠামো দাঁড়িয়ে যায়। পরে সাজগোজ করতে গিয়ে চরিত্রগুলো চলে আসে। তখন চেনা চরিত্রের নানা ঘটনা গল্পে ঢুকে যায়। তখন আমি চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ি। সে সময় দেখেছিলাম আমার এক বন্ধুর বাবা বাড়িতে খুবই কঠোর ছিলেন। সেখানে থেকেই ‘কড়ক সিং’–এর চরিত্রটি আমি নিয়েছি। এই যে নায়না, বাস্তবে তাকে আমি ভীষণভাবে চিনি। বাস্তব চরিত্রের নাম আমি বলতে পারব না। তার অসাধারণ ব্যক্তিত্ব। এগুলো অবচেতন মনে গল্পে চলে আসে। এগুলো গল্পে জলজ্যান্ত মনে হয়। এ জন্য আমি মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করি, তাদের নিয়ে গভীরভাবে ভাবলে মনে রেখাপাত তৈরি হয়।
প্রথম আলো :
জয়া আহসান এ সিনেমাটির সঙ্গে কীভাবে যুক্ত হলেন?
ওর অনেক সিনেমা দেখেছি আমি। কথা হয়েছে। দেখাও হয়েছে। ‘দেবী’, ‘বিসর্জন’, ‘বিউটি সার্কাস’ দেখেছি। আমার কাছে মনে হচ্ছিল, ওকে আরেকটু চ্যালেঞ্জিং চরিত্রে দেওয়া দরকার। আজকের আধুনিক, সচেতন ও শক্তিশালী নারী চরিত্রটি লেখার সময় থেকেই আমি জয়ার কথা ভেবেছি। জয়ার চোখে–মুখে একটি দৃঢ়তা আছে, স্থিরতা আছে। সে কথা না বলেও অনেক কথা বলতে পারে। তার আলাদা একটা আভিজাত্য আছে, যেটা সত্যিকারের নায়নার মধ্যেও রয়েছে।
প্রথম আলো :
সিনেমাতে পঙ্কজ ত্রিপাঠি বলিউডের, পাবর্তী দক্ষিণের তারকা, জয়া বাংলাদেশের; সবাইকে নিয়ে এই মেলবন্ধটা কি ইচ্ছা করে?
আজকের জীবনটা তো বিশ্বজনীন। এখন আর ভৌগোলিক বাধা বলে কিছু থাকে না। আমার ঢাকা, চট্টগ্রাম, ওডিশা, কানাডা, আমেরিকাসহ অনেক জায়গায় বন্ধু আছে। আমি নিজেকে তো গুটিয়ে রাখব না। বাঙালি বলে কলকাতায় বসে থাকব না। এ সম্পর্কটা আমার কাছে দারুণ লাগে। কারণ, আমাদের সবার ভাষা হলো মানবতার ভাষা।
প্রথম আলো :
আপনার হাত ধরে কলকাতায় যে ছবিগুলো তৈরি হয়েছে, পরে হিন্দিতে ‘পিংক’, ‘লস্ট’ করতে গিয়ে কী পার্থক্য খুঁজে পেলেন?
আমার কাছে বাংলা, হিন্দি ও মালয়ালম এই ব্যাপারগুলো ম্যাটার করে না। কারণ, সিনেমার আলাদা ভাষা রয়েছে। সেটা যে ভাষার ছবিই হোক না কেন, ভাষা একটা কথাই বলে। দিন শেষে আমি যে গল্পটা বলতে চাই, সেটা বলতে পারছি। ভাষা আমার জন্য বাধা না। অনেক দিন বাংলায় সিনেমা করিনি। আগামী চার থেকে পাঁচ মাসের মধ্যে আবার বাংলায় একটি সিনেমা তৈরি করব। সিনেমাটির নাম ‘ডিয়ার মা’। এখানে শাশ্বত (চট্টোপাধ্যায়) ও জয়া অভিনয় করবেন। এখানে জয়াকে মজার চরিত্রে দেখা যাবে। এটা নিয়ে আপাতত কিছুই বলতে পারব না।
প্রথম আলো :
নির্মাতা হিসেবে আপনার কি কোনো অপ্রাপ্তি রয়েছে?
কোনো আর্টিস্ট কি খুশি হতে পারে? আমি এখনো সিনেমার ছাত্র। চেষ্টা করে যাচ্ছি। মনপ্রাণ দিয়ে নিজের মতো করে কাজটায় আত্মস্থ থাকতে পারলেই ঐশ্বরিক আনন্দ হয়। শিল্পে কোনো লক্ষ্য নেই। এখানে লক্ষ্যে পৌঁছানো না, জার্নিটাই আনন্দ। সিনেমা নিয়ে এই জার্নি আমাকে তৃপ্ত করে। কিছু কাজ ভালো হয়, কিছু খারাপ হয়; রোনালদো তো প্রতিটি খেলায় গোল দিতে পারে না। উত্থান-পতন নিয়েই জীবন। সফল-অসফল আপেক্ষিক ব্যাপার। আমি খেলতে চাই, খেলায় গোল করতে চাই না। খেলছি, গুঁতা খেয়ে পড়ে যাচ্ছি, কোনো দিন হারছি, কোনো দিন গোল দিলাম—এসব মিলিয়েই আমার কাছে আনন্দ; ক্রিয়েটিভ ফর্মটাই এমন। একেকটা সিনেমা মানে একেকটা জীবন।
প্রথম আলো :
পশ্চিমবঙ্গের সিনেমায় আপনি নিজস্ব একটা ধারা তৈরি করেছিলেন, আপনি বাংলা সিনেমা না করায় সেসব দর্শকদের কাছ থেকে একটু সরে গেছেন কি না?
সব সময় কিন্তু আকাশে মেঘ থাকে না, মেঘ কেটে গেলে আকাশ ঝলমলে হয়। সবকিছুর পরিবর্তন তো হবেই। এটাই তো জীবন। তবে হ্যাঁ, এ মুহূর্তে কোনো সিনেমা (বাংলা) চোখে আরাম দিচ্ছে না। আবার এক–দুইটা ছবি দারুণভাবে সামনে আসে। এভাবে করতে করতে আবার একটা সময় আসবে ভালো ছবি হবে। হয়তো কিছুটা দর্শক আনন্দ পাচ্ছে না। আবার দর্শকের তো আবেদন থাকতে হবে। শুধু নির্মাতাদের দোষ দেব, তা কিন্তু নয়। দর্শকদের ভালো ছবি দেখতে হবে। এটা ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে।
প্রথম আলো :
এখন সিনেমাগুলোর মধ্যে একধরনের প্রতিযোগিতা দেখা যায়...
যদি ‘অনুরণন’-এর সময়ের কথাই বলি, তখন দর্শক ‘অনুরণন’ দেখে বং কানেকশন দেখছে। একটা ছবি কখনোই আরেকটা ছবির সঙ্গে প্রতিযোগিতা করবে না। একটা ভালো ছবি আরেকটা ভালো ছবিকে আকৃষ্ট করে। একইভাবে সমাজও বেড়ে ওঠে। আমি ভালো কাজ করব, সেটা আরেকজনকে ইনস্পায়ার করবে। সেটা দেখে একজন লেখক ভালো একটি গল্প লিখবে। সেই লেখা পড়ে একজন মিউজিশিয়ান এতটাই উত্তেজিত হয়ে যাবে যে সে দারুণ একটা বাজনা বাজাবে। সেটা শুনে একজন আর্টিস্ট দারুণ পেইন্ট করল। ভালো কাজগুলো কিন্তু এভাবে সমাজে প্রভাব ফেলে। একে অপরকে প্রেরণা জোগানো সমাজের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
প্রথম আলো :
বাংলাদেশের সিনেমা কতটা দেখা হয়?
বাংলাদেশের সিনেমা তো এখন দারুণ লাগে। ‘হাওয়া’ ভালো লেগেছে, ‘দেবী’ ভালো লেগেছিল। নানা রকম ভালো ছবি হচ্ছে। এ মুহূর্তে বাঁধন আমাকে একটি সিনেমা পাঠিয়েছে। ওর সিনেমাটি কান উৎসবে গিয়েছিল ‘রেহানা মরিয়ম নূর’। এটা এখনো দেখা হয়নি। দুই মাস ‘কড়ক সিং’ নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। বাংলাদেশ ভালো ভালো ছবি করছে, বিশ্বমানের সিনেমা হচ্ছে। ‘টেলিভিশন’ বলে ফারুকীর একটা ছবি ভালো লেগেছিল। ওর ‘থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার’ও দেখেছি। আপনাদের সিরিজগুলো ভালো হচ্ছে।
প্রথম আলো :
আপনার পূর্বপুরুষ তো বাংলাদেশের ছিলেন?
আমরা বাংলাদেশের ছিলাম। আমার মা-বাবা ওপার বাংলার। বাবা ফরিদপুরের, মা বরিশালের। আমাদের রুট বাংলাদেশের। আপনাদের গানও ভালো হচ্ছে, উন্নত মানের মিউজিক হচ্ছে। অসম্ভব ভালো লাগে। আমি বাংলাদেশে খুব ভালোবাসা পেয়েছি। একসময় তো নিয়মিত যেতাম ঢাকাতে। অনেক বন্ধু রয়েছে। আমার ‘বুনোহাঁস’ সিনেমার কিছুটা শুটিং বাংলাদেশে করেছিলাম। আমার গোপন একটা ইচ্ছা আছে, সেটি হলো সুযোগ পেলে ওপার বাংলায় ছবি করব।