অবাধ্য চরিত্রের একটা আলাদা আবেদন আছে: ইমরান হাশমি

তিনিও তারকাসন্তান। বেড়ে উঠেছেন বলিউডের আঙিনায়। তাই ইন্ডাস্ট্রির আদ্যোপান্ত তাঁর নখদর্পণে। তারপরও নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার সংগ্রাম করতে হয়েছে তাঁকে। ‘সিরিয়াল কিসার’ তকমা লেগে আছে তাঁর সঙ্গে। সেসব মাড়িয়ে সালমান খানের সঙ্গে ‘টাইগার ৩’ সিনেমায় খলচরিত্রে অভিনয় করে নিজেকে নতুন করে চিনিয়েছেন। চেনাচ্ছেন ডিজনি প্লাস হটস্টারে প্রচারিত ‘শোটাইম’ সিরিজে ধূসর (একই সঙ্গে ভালো ও মন্দ চরিত্র) চরিত্রে অভিনয় করে। তিনি ইমরান হাশমি। সম্প্রতি ফিল্মফেয়ার ম্যাগাজিনের কাছে নিজের অভিনয়, সংগ্রাম ও স্বজনপ্রীতি নিয়ে কথা বলেছেন অকপটে। বলেছেন আরও অনেক কথা। লিখেছেন সুমন মাহমুদ

প্রথম আলো:

আপনি ‘শোটাইম’ সিরিজে ধূসর চরিত্রে অভিনয় করেছেন। আজকাল খলনায়কের যেসব চরিত্র পর্দায় দেখা যায়, সেগুলো কতটা যথাযথ হচ্ছে বলে মনে করেন?

ইমরান হাশমি : আপনি যদি খুব ভালোভাবে খেয়াল করেন, তাহলে দেখতে পাবেন যে এই সিরিজে কোনো সাদা-কালো (ভালো ও মন্দ) চরিত্র নেই। সব ধূসর। এমনকি এর প্রথম চারটি পর্বে সব চরিত্রকে সাদা মনে হলেও আপনি মনোযোগ দিয়ে দেখলে অবাক হবেন। এখনকার দিনে দর্শক একমাত্রিক চরিত্রে অভিনয় পছন্দ করেন না। আমরা সবাই ধূসর চরিত্রে অভিনয় করি এবং মাঝেমধ্যে অন্যায় কাজে জড়িয়ে পড়ি। এরপর আমাদের মধ্যে অনুশোচনা হয় এবং মুক্তিলাভের চেষ্টা করি। কারও জীবনই ন্যায়পরায়ণতার একতরফা পথে চলে না। চলচ্চিত্র ও শোতে বাস্তবতারই প্রতিফলন ঘটে।

ইমরান হাশমি। ইনস্টাগ্রাম থেকে
আরও পড়ুন

প্রথম আলো :

‘বার্ড অব ব্লাড’ (২০১৯) সিরিজের পর ওটিটির কোনো প্রজেক্টের জন্য কেন পাঁচ বছর সময় নিলেন?

ইমরান হাশমি : সময় নির্ধারণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমার কাছে স্ক্রিপ্টের গুণমানের চেয়ে আমার সক্ষমতাটা গুরুত্বপূর্ণ। এমন নয় যে আমি প্রস্তাব পাইনি। পেয়েছি, কিন্তু কোনোটাই যথাযথ মনে হয়নি। যখন করণ জোহর আমার কাছে ‘শোটাইম’ সিরিজের অফার নিয়ে আসেন, তখন এটা করার জন্য নিজের ভেতর একধরনের তাগাদা অনুভব করি। ২০-২৫ বছর ইন্ডাস্ট্রিতে থেকে দেখেছি, বলিউডের প্রতি দর্শকের চুম্বকের মতো আকর্ষণ। ক্রিকেটের মতো আমাদের দেশে বলিউডের প্রতিও অসম্ভব ভালোবাসা রয়েছে। ‘শোটাইম’-এ কাজ করার পেছনে একটা চিন্তাই কাজ করেছে, এতে আমার অনেক কিছু দেওয়ার আছে এবং সবটুকু দিয়ে আমি চেষ্টা করেছি।

‘টাইগার ৩–এর পোস্টারে ইমরান হাশমি। ইনস্টাগ্রাম থেকে
প্রথম আলো:

আপনার কি মনে হয়, তারকাসন্তান হিসেবে বলিউডে আপনাকে খুব কম সংগ্রাম করতে হয়েছে?

ইমরান হাশমি : চলচ্চিত্রে পা রাখার ক্ষেত্রে আমার পরিচয় কিছুটা তো সহযোগিতা করেছেই। বলিউড পরিবারে বেড়ে ওঠার কারণে অল্প বয়স থেকেই আমি চলচ্চিত্রের ব্যবসার নানা দিক সম্পর্কে অবগত হতে পেরেছি। তর্কাতীতভাবে এটা আমার অভিনয়ে আসার পথ সহজ করে দিয়েছে। তবে আপনাকে স্বীকার করতেই হবে যে এসব কখনোই আপনাকে সাফল্য এনে দেওয়ার নিশ্চয়তা দেবে না। এখনো দর্শকের মন জয় করতে অভিনয়শিল্পী হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করতে হচ্ছে এবং বলিউডে বিরাজমান সম্পর্ক ও রাজনীতির জটিল পথ অতিক্রম করতে হচ্ছে।

ইমরান হাশমি। ইনস্টাগ্রাম থেকে

প্রথম আলো :

স্বজনপ্রীতি সম্পর্কে আপনার মত কী?

ইমরান হাশমি : প্রযোজকেরা যখন কাউকে কাস্ট করেন, নিজেদের সন্তান কিংবা কোনো তারকার সন্তান সে ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পায় এবং এটাই বাস্তবতা। কিন্তু আপনাকে এটা বুঝতে হবে যে স্বজনপ্রীতি শুধু বলিউডেই নয়, পৃথিবীর সব শিল্পেই রয়েছে। তবে যাঁরা ইন্ডাস্ট্রির বাইরের লোক, তাঁদের ক্ষেত্রে পারিবারিক সংযোগ অনেক সময় প্রতিবন্ধক হয়ে ওঠে। স্বজনপ্রীতির কারণে ঐতিহ্যের প্রতি সম্মান জানানো এবং সব ধরনের প্রতিভাকে মূল্যায়নের ক্ষেত্রে সামঞ্জস্য রক্ষা করাটাই ইন্ডাস্ট্রির জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। ভুলে গেলে চলবে না যে চরিত্রাভিনেতা হিসেবে ‘ফুটপাত’ (২০০৩) সিনেমা দিয়ে আমার অভিষেক হয়েছে। এরপর যখন সবাই আমার ভেতর সম্ভাবনা খুঁজে পেলেন, তখন আমি প্রধান চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ পেতে থাকি। সুতরাং প্রত্যেকেরই নিজস্ব একটা সংগ্রাম আছে।

ইমরান হাশমি। ইনস্টাগ্রাম থেকে
প্রথম আলো:

ইন্ডাস্ট্রি ব্যাকগ্রাউন্ডের কারণে অভিনেতা হিসেবে নিজেকে সম্পূর্ণ নিরাপদ মনে হয়?

ইমরান হাশমি : সাফল্যের স্তর কিংবা ব্যাকগ্রাউন্ড—কোনো কিছুই অভিনেতা হওয়ার ক্ষেত্রে আপনাকে পূর্ণ নিরাপত্তা দিতে পারবে না। নিরাপত্তাহীনতা একটা অপরিহার্য ব্যাপার। বাইরে থেকে এসে যাঁরা এখানে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন, তাঁরা সহজেই আমাদের মতো ইন্ডাস্ট্রির ভেতরের মানুষের অবস্থা অনুধাবন করতে পারবেন। তাই তাঁদের আর আমাদের মধ্যে খুব একটা পার্থক্য নেই। পারফর্ম করার চাপ; দর্শক আর সমালোচকের কাছে নিজেকে ক্রমাগত প্রমাণ করে যাওয়া, পরবর্তী সুযোগ কবে আসবে, সেই অপেক্ষায় থাকা—এই সবকিছুই নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করে। যখন এসব অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়, তখন বোঝা যায় যে এই পথ কতটা কঠিন! দিন শেষে আমার কাছে, এমনকি সব অভিনয়শিল্পীর জন্যই দর্শকের কাছে নিজেকে পৌঁছে দিতে পারা এবং তাঁদের গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করাটাই গুরুত্বপূর্ণ। এটা একটা ধারাবাহিক প্রক্রিয়া এবং কোনো একদিকে গুরুত্ব কমে গেলে ভারসাম্য হারিয়ে ফেলতে হয়।

প্রথম আলো :

আপনার দৃষ্টিতে ইন্ডাস্ট্রির ভালো ও মন্দ দিক কোনগুলো?

ইমরান হাশমি : ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির সবচেয়ে ভালো একটা দিক হলো, এখানে ধর্মনিরপেক্ষতা রয়েছে। বিভিন্ন সংস্কৃতি, ধর্ম ও মতাদর্শের মানুষ এখানে দর্শককে বিনোদিত করার জন্য জড়ো হন। অন্যান্য ইন্ডাস্ট্রির মতোই এখানে সবাইকে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়। ইন্ডাস্ট্রি সম্পর্কে মানুষের মধ্যে কিছু ভুল ধারণা কাজ করে। কিন্তু কিছু খারাপ আপেলের কারণে সব আপেল খারাপ, এটা তো আমি বলতে পারি না। এ ধরনের সমস্যা প্রতিটি সেক্টরে রয়েছে। বলিউডে এখন যেসব বাণিজ্যিক সিনেমা তৈরি হচ্ছে, সেগুলোয় গল্প বলা ও চরিত্রচিত্রণের ক্ষেত্রে নতুনত্বের অভাব রয়েছে। ঝুঁকি নেওয়ার ক্ষেত্রে নির্মাতারা দ্বিধান্বিত থাকেন। তাঁরা এখনো প্রচলিত গল্পের কাঠামোতেই আটকে আছেন। পুরোনো দৃষ্টিভঙ্গি ঝেড়ে ফেলে নতুন কিছু করতে তাঁরা ব্যর্থ। দক্ষিণি ইন্ডাস্ট্রি কিংবা ওটিটি প্ল্যাটফর্মের দিকে খেয়াল করলেই বুঝতে পারবেন ব্যাপারটা। তারা যখন বুঝতে পেরেছে যে তাদের ঝুঁকি নিতে হবে এবং সেই সঙ্গে ভিন্ন রকম কিছু করতে হবে, তখনই তারা উন্নতি করতে শুরু করেছে।

ইমরান হাশমি। এএনআই
প্রথম আলো:

সমালোচনা কীভাবে সামলান?

ইমরান হাশমি : যখন আমি ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করা শুরু করি, বিশেষ করে প্রথম পাঁচ বছর, তখন আমাকে অনেক সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয়েছে। কখনো কখনো সমালোচকদের পর্যালোচনা ভীষণভাবে ব্যক্তিগত মনে হয়েছে। তাঁরা কাজের প্রতি আলোকপাত না করে আমাকে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করেছেন। যেটা করা উচিত হয়নি বলে আমার মনে হয়েছে। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমি এসব মোকাবিলা করতে শিখে গেছি। আমি বুঝতে পেরেছি যে প্রত্যেকেরই নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। বুঝে গেছি যে সবাই আমার প্রশংসা করবেন না, আবার আমি যা করছি, তা ঠিকই কারও না কারও ভেতর অনুরণন তৈরি করবে।

প্রথম আলো:

সমালোচকদের মতে, ইন্ডাস্ট্রিতে একজন অভিনয়শিল্পীর দীর্ঘদিন টিকে থাকার চাবিকাঠি হচ্ছে নিজেকে ক্রমাগত উতরে যাওয়া...

ইমরান হাশমি : অভিনয়শিল্পীর যখন নিজেকে ক্রমাগত উতরে যাওয়ার কথা আসে, তখন স্ক্রিপ্টের দিকেও তাকাতে হবে। দেখতে হবে যে স্ক্রিপ্ট এখানে কতটা ভূমিকা রাখতে পেরেছে! অভিনয়শিল্পী হিসেবে আমি নিজেকে কল্পনার টেবিলে বসাই। প্রতিটি নতুন চরিত্রের মাধ্যমে আমি নতুন নতুন জীবনে পা রাখি এবং গল্প ও শৈলীর মেলবন্ধনে অসাধারণ কিছুর দিকে নিজেকে ধাবিত করার চেষ্টা করি। প্রতিবারই আমি এটা মনে করি যে নিজেকে নতুনভাবে দর্শকের সামনে উপস্থাপন করতে চলেছি। পর্দায় নিজেকে নতুনভাবে তুলে ধরার ক্ষেত্রে এটি দক্ষতায় শাণ দেওয়ার একটি প্রক্রিয়া বলতে পারেন।

প্রথম আলো :

২০ বছর পার করে এসে এখনো কীভাবে নিজেকে অনুপ্রাণিত করেন?

ইমরান হাশমি : আমার প্রেরণা আসে দর্শকদের সামনে নিজেকে নতুনভাবে মেলে ধরার এবং তাঁদের জন্য অভাবনীয় কিছু করার তাগাদা থেকে। এটা ভিন্ন ঘরানার গল্প কিংবা অসাধারণ শৈলীর মাধ্যমে হতে পারে, যার প্রতি দর্শকের তুমুল আগ্রহ কাজ করবে। আমি জানি, দুর্বিনীত ও অবাধ্য চরিত্রের একটা আলাদা আবেদন আছে। অভিনয় দিয়ে সেই আবেদন আমি ফুটিয়ে তুলতে চাই।