‘দৃশ্যম’-এর সঙ্গে তুলনা! এই সিনেমার শেষটা বুঝতে পারেনি দর্শক

‘কিসিন্ধা কানদাম’–এর দৃশ্য। আইএমডিবি

জঙ্গলের প্রেক্ষাপটে জমজমাট এক রহস্য দেখতে চান? এমন থ্রিলার দেখতে চান, যার শেষটা আপনি অনুমান করতে পারবেন না? সেই কবে ‘দৃশ্যম’দেখেছিলেন, ভাবছেন এমন সিনেমার আর কেন হয় না! আবার থ্রিলার মানেই গতির ঝড়, একের পর এক ঘটনা; এসবও ভালো লাগে না। চান, ধীরলয়ের কোনো সিনেমা, যা দেখে আপনার থ্রিলারপ্রেমী মন ভরে যাবে। আবার থ্রিলারের উপাদান বাদ দিয়েও সিনেমা হিসেবে শিল্পমানে উতরে যাবে। তাহলে মালয়ালম সিনেমা ‘কিসিন্ধা কানদাম’ আপনারই জন্য।

এক নজরে
‘কিসিন্ধা কানদাম’
পরিচালক: দিনজিথ আয়াথান
অভিনয়: আসিফ আলী, অপর্ণা বালামুর্তি, বিজয় বর্ধন
দৈর্ঘ্য: ১ ঘণ্টা ২৫ মিনিট
ভাষা: মালয়ালম
স্ট্রিমিং: ডিজনি প্লাস হটস্টার

গত ১২ সেপ্টেম্বর মুক্তির পর ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয় সিনেমাটি। মাত্র ৭ কোটি রুপি বাজেটের সিনেমাটি বক্স অফিসে ৭৫ কোটি ২৫ লাখ রুপি ব্যবসা করে। তবে ‘কিসিন্ধা কানদাম’ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়েছে সম্প্রতি। ১৯ নভেম্বর ওটিটি প্ল্যাটফর্ম ডিজনি প্লাস হটস্টারে আসার পর থেকেই সিনেমাটি নিয়ে অন্তর্জালে চর্চা চলছে। অনেক বাংলাদেশি দর্শকও ফেসবুকে সিনেমাটির প্রশংসা করেছেন।

‘কিসিন্ধা কানদাম’ নিয়ে কেন এত আলোচনা সে প্রশ্নের উত্তরে যাওয়ার আগে ছবির গল্পটা সংক্ষেপে বলে নেওয়া যাক। যদিও স্পয়লার হতে পারে, তাই গল্প নিয়ে বিশদে বলার সুযোগ নেই।

‘কিসিন্ধা কানদাম’–এর দৃশ্য। আইএমডিবি

‘কিসিন্ধা কানদাম’ মোটাদাগে এক পরিবারের গল্প। জঙ্গলের মধ্য একটা বাড়ি। কর্তা আপ্পু পিল্লাই সাবেক সেনা কর্মকর্তা। তাঁর যে তিরিক্ষি মিলিটারি মেজাজ, তাতে তাঁর অতীত পেশা সম্পর্কে না বললেও চলে। আপ্পুর বড় ছেলে প্রবাসী। ছোট ছেলে অজয় ফরেস্ট অফিসার। এই পরিবারের এক বিয়োগান্ত অতীত আছে। অজয়ের স্ত্রী কয়েক বছর আগে মারা গেছেন। একমাত্র শিশুসন্তান চাচ্চু তিন বছর হলো নিখোঁজ। সিনেমা শুরু হয় অজয়ের দ্বিতীয় বিয়ে দিয়ে। তিনি বিয়ে করে ঘরে আনেন আপর্ণাকে। সেদিন ঘটে আরেক ঘটনা। স্থানীয় নির্বাচন উপলক্ষে লাইসেন্স করা অস্ত্র জমা নিচ্ছে পুলিশ। কিন্তু জানা যায়, অজয়ের বাবা আপ্পু তাঁর রিভলবার খুঁজে পাচ্ছেন না! সত্যি কী অস্ত্র হারিয়েছে? অজয়ের ছেলে চাচ্চু কেন নিখোঁজ হলো? এই দুই প্রশ্ন নিয়েই এগিয়ে চলে সিনেমা।

বহুলচর্চিত অনেক থ্রিলার সিনেমার মতো এই ছবিতে গতি নেই, ধাওয়ার দৃশ্য নেই; পরতে পরতে চমক নেই। তবু ‘কিসিন্ধা কানদাম’ দেখার সময় আপনি পর্দা থেকে চোখ ফেরাতে পারবেন না।
প্রথম কারণ দুর্দান্ত চিত্রনাট্য। বাহুল রমেশ খুবই বুদ্ধিদীপ্তভাবে সিনেমাটি লিখেছেন। ধীরে ধীরে রহস্যের পর্দা খুলতে খুলতে তিনি এগিয়ে গেছেন ধাক্কা খাওয়ার মতো এক পরিণতির দিকে। এই সিনেমা অনেক বিচারেই ধীরগতির। কিন্তু তবু রস আস্বাদনের আনন্দ আপনাকে চোখ ফেরাতে দেয় না।

‘কিসিন্ধা কানদাম’–এর দৃশ্য। আইএমডিবি

এক লোকেশনে চিত্রিত। এমন সিনেমা অনেক ক্ষেত্রেই কিছু বিরক্তিকর হয়ে উঠতে পারে। সেটা হয়নি পাত্র–পাত্রীদের দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের জন্যই। ‘এই চরিত্র তাঁর কথা ভেবেই লেখা হয়েছে’, অনেক শিল্পীর ক্ষেত্রেই বহুলচর্চিত এই বাক্য ব্যবহার করা হয়। তবে ‘কিসিন্ধা কানদাম’ ক্ষেত্রে ক্লিশে হলেও আপনি এটা বলতে বাধ্য হবেন।
অজয় চরিত্রে আসিফ আলী সম্ভবত তাঁর ক্যারিয়ারের সেরা পারফরম্যান্স উপহার দিয়েছেন। সন্তানের শোক, বাবার মর্জি সামলে চলা আর শোকের এক অতীত বয়ে নিয়ের চলা এক চরিত্রে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন তিনি।

বছর কয়েক আগে তামিল সিনেমা ‘সুরারাই পতুরু’র জন্য সেরা অভিনেত্রী হিসেবে ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন অপর্ণা বালামুর্তি। অজয়ের স্ত্রী অপর্ণার চরিত্রে তিনি আবারও বুঝিয়ে দিয়েছেন, অভিনয় কাকে বলে। পুরো সিনেমায় অভিনয় না করেই যেন অভিনয় করেছেন তিনি। অজয়ের বাবা আপ্পু পিল্লাইয়ের চরিত্রে বিজয় বর্ধনও দুর্দান্ত।

‘কিসিন্ধা কানদাম’–এর দৃশ্য। আইএমডিবি

ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় সিনেমা ‘কিসিন্ধা কানদাম’ দিয়ে রাতারাতি সমালোচকদের প্রিয়পাত্র বনে গেছেন নির্মাতা দিনজিথ আয়াথান। পুরো সিনেমাটি প্রায় নিখুঁতভাবে বানিয়েছেন তিনি। এই সিনেমায় আলাদাভাবে প্রশংসার যোগ্য সিনেমাটোগ্রাফি। এই সিনেমায় গল্প, চিত্রনাট্যের সঙ্গে চিত্রগ্রাহকের দায়িত্বও সামলেছেন বাহুল রমেশ। এখানে জঙ্গলকে আলাদা একটা চরিত্র হিসেবে হাজির করা হয়েছে। প্রকৃতি এখানে কথা বলে। সিনেমাটি যে জঙ্গলের প্রেক্ষাপটে, সেখানে প্রচুর হনুমান আছে। এর একটা কারণও আছে। হিন্দুপুরাণ অনুযায়ী কিষ্কিন্ধা, রাজা সুগ্রীবের রাজ্য। এটি সেই রাজ্য, যা সুগ্রীব তার পরামর্শদাতা হনুমানের সহায়তায় শাসন করতেন। এখন জঙ্গল, হনুমান আর পুরাণের সঙ্গে এই সিনেমার কী যোগ, সেটা ‘কিসিন্ধা কানদাম’ দেখলেই বুঝে যাবেন।

পুরো সিনেমায় অনেক দৃশ্যই আছে সংলাপহীন। কিন্তু কিছু না বলেও যেন অনেক কিছু বলে দিয়েছেন শিল্পীরা। মুক্তির পর থেকে অনেক দর্শক ‘কিসিন্ধা কানদাম’কে আরেক আলোচিত মালয়ালম থ্রিলার ‘দৃশ্যম’-এর সঙ্গে তুলনা করেছেন। কেউ বলেছেন ‘দৃশ্যম’-এর চেয়েও ভালো। কিছু জায়গায় ‘কিসিন্ধা কানদাম’-এর সঙ্গে ‘দৃশ্যম’-এর সঙ্গে মিলও আছে। শেষটা তো আপনাকে মোহনলালের সিনেমার মতোই ধাক্কা দেবে। কোনটা ভালো এই তুলনায় না গিয়েও বলে দেওয়া যায়, ‘কিসিন্ধা কানদাম’-এর মানের থ্রিলার আপনি মালয়ালম ইন্ডাস্ট্রি থেকে চলতি বছর অন্তত পাননি।

‘কিসিন্ধা কানদাম’–এর পোস্টার। আইএমডিবি

কেবল থ্রিলার মূল্যই নয়, ড্রামা সিনেমা হিসেবেও ‘কিসিন্ধা কানদাম’ মনে রাখার মতো। এই শীত শীত আবহাওয়ায় জঙ্গলের পটভূমিতে নির্মিত রোমাঞ্চকর সিনেমাটি দেখবেন নাকি!