ক্যামেরা আসক্তি নিয়ে প্রাপ্তবয়স্কদের সিনেমা
যাপিত জীবনের কিছুই আজকাল আর গোপন থাকে না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম যেন মানুষের ভার্চ্যুয়াল দিনলিপি; যেখানে আড়াল বলতে কিছু নেই। বাড়িতে, অফিসে এমনকি ঘুরতে গিয়েও কে কী করছে, তার বিস্তারিত প্রদর্শনীর মঞ্চ যেন ফেসবুক বা ইনস্টা ফিড। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই আসক্তি আর ক্যামেরার প্রতি দাসত্ব নিয়ে দিবাকর ব্যানার্জির নতুন ছবি ‘লাভ সেক্স অউর ধোঁকা ২’ বা ‘এলএসডি ২’। এ সময়ের আলোচিত এই হিন্দি ছবি আজ মুক্তি পেয়েছে ভারতের প্রেক্ষাগৃহে। মুক্তির পর থেকে সমালোচকদের ভূয়সী প্রশংসা পাচ্ছে ‘এলএসডি ২’।
দিবাকর ব্যানার্জি হিন্দি সিনেমার নির্মাতাদের মধ্যে সমীহজাগানিয়া এক নাম। অনেকে তাঁকে এ সময় ভারতের অন্যতম সেরা পরিচালক মনে করেন। দুই দশকের ক্যারিয়ারে মাত্র সাতটি সিনেমা বানিয়েছেন দিবাকার, তবে তাঁর প্রতিটি সিনেমাই দর্শক-সমালোচকদের জন্য উসকে দিয়েছে নতুন চিন্তার খোরাক। কখনো তৈরি করেছে প্রবল বিতর্ক।
গতকাল মুক্তি পাওয়া ‘এলএসডি ২’ ২০১০ সালে মুক্তি পাওয়া পরিচালকের তৃতীয় সিনেমা ‘লাভ সেক্স অউর ধোঁকা’র সিকুয়েল। তবে সিকুয়েল হলেও আগেরটির সঙ্গে এবারের কিস্তির গল্পের তেমন মিল নেই। প্রথম কিস্তিটি ছিল তিনটি ছোট গল্পের সমন্বয়, সিনেমাটিতে পুঁজিবাদ, ভোগবাদ, জাত-বৈষম্য, অনার কিলিং, এমএমএস স্ক্যান্ডাল, স্ট্রিং অপারেশনসহ নানা বিষয় তুলে এনেছিলেন দিবাকর। তাঁর সিনেমার দর্শকমাত্রই জানেন, প্রতিটি সিনেমাতেই রাজনৈতিক বক্তব্য থাকে, তিনি কথা বলেন সমাজের নানা অন্যায় নিয়ে। আজ মুক্তি পাওয়া ‘এলএসডি ২’ও এর ব্যতিক্রম নয়। এবারও তিনি তিনটি আলাদা গল্প বলেছেন। এসব গল্পে তিনি মূলত তুলে ধরেছেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আসক্ত মানুষের গল্প। সে জন্যই পরিচালক ছবির ট্যাগলাইন দিয়েছেন—লাভ ইন দ্য টাইমস অব ইন্টারনেট।
‘এলএসডি ২’-এ রয়েছে তিনটি গল্প—‘লাইক’, ‘শেয়ার’ ও ‘ডাউনলোড’। সিনেমাটিতে অভিনয় করেছেন নবাগত অভিনয়শিল্পীরা, যাঁদের অডিশনের পর কর্মশালার মাধ্যমে বেছে নেওয়া হয়েছে। পরিচিত মুখের মধ্যে আছেন স্বস্তিকা মুখার্জি। আগে দিবাকরের ‘ব্যোমকেশ’-এ কাজ করেছেন এই বাঙালি অভিনেত্রী। পরিচালকের ছবিতে দ্বিতীয়বারের মতো দেখা গেল তাঁকে। এ ছাড়া ছবিতে আছেন পরিতোষ তিওয়ারি, বনিতা রাজপুরহিত, অভিনব সিং, স্বরূপ ঘোষ প্রমুখ। একটি বিশেষ চরিত্রে দেখা যাবে আলোচিত-সমালোচিত তারকা উরফি জাবেদকে। ‘এলএসডি ২’ দিয়েই হিন্দি সিনেমায় অভিষেক হলো তাঁর।
সিনেমাটি নির্মাণের আগে দীর্ঘ সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিয়ে গবেষণা করেছেন দিবাকর। ছবিতে উরফিকে নেওয়া প্রসঙ্গে হিন্দুস্তান টাইমসকে দিবাকর বলেন, ‘উরফির দিকে তাকালেই যে কেউ বুঝতে পারবেন, যে সে জানে, সে কী করছে। সে জানে তার টার্গেট অডিয়েন্স কারা। আর উরফি এটা উপভোগ করে। সিনেমা বানানোর আগে অনেক দিন তাঁর ভিডিও দেখেছি। আমার সিনেমার বিষয়বস্তু এমন যে তাঁকে নিলে বিষয়টা জমে যায়; এ কারণেই উরফিকে নেওয়া হয়েছে।’
পরিচালক জানান, বর্তমান সময়ে মানুষ যে কার্যত ক্যামেরা বা ইন্টারনেটের দাসত্ব বরণ করেছে, সেটাই তিনি সিনেমায় তুলে ধরেছেন। পশ্চিমবঙ্গের দৈনিক সংবাদ প্রতিদিনকে দিবাকর বলেন, ‘আমি আর একতা (প্রযোজক একতা কাপুর) যখন “এলএসডি” তৈরি করি, তখন একটা বিষয় বুঝতে পারি যে ছবিটি একটি নির্দিষ্ট সময়ে ভারতের সাংস্কৃতিক ও সামাজিক ইতিহাসকে তুলে ধরেছিল। ২০১৯-২০ সালের দিকে একতা বলে ছবিটির সিকুয়েল করতে। তত দিনে এক দশকের বেশি সময় কেটে গেছে। নতুন ভারত গড়ে উঠেছে। নতুন এই সময়ে আমরা নেট-নির্ভর হয়ে উঠেছি, যা আমাদের জীবনকে ভয়ংকরভাবে প্রভাবিত করছে।’
একই সাক্ষাৎকারে এ প্রসঙ্গে নির্মাতা আরও বলেন, ‘এখন কেবল সিনেমায় অভিনয় হয় না। এখন আমরা নিজেদের জীবন অভিনয় করে দেখাই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। সবাই দেখছে জেনেই জীবনের সবচেয়ে ব্যক্তিগত মুহূর্তগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তুলে ধরছি। জামাকাপড় পরে রেডি হওয়ার ভিডিও, শেভ করার ভিডিও সবই খুব সযত্ন ক্যামেরার সামনে তুলে ধরছি এটা জেনেই যে গোটা বিশ্ব দেখছে। গোটা পৃথিবীও জানে যে আমরা জানি, তারা দেখছে। এটা একটা খেলা।’
সিনেমা হিসেবে নির্মাণের দিক থেকেও আলাদা ছিল ‘এলএসডি’। সে সময় ছবিতে হ্যান্ডিক্যাম, সিসিটিভি ফুটেজের ব্যবহার হইচই ফেলে দিয়েছিল। এবারও নিরীক্ষা করেছেন পরিচালক। দিবাকর জানান, সিনেমাটি এমনভাবে তৈরি হয়েছে যে দেখার সময় দর্শকের মনে হবে, তিনি ইনস্টা-ফিডে ছবিটি দেখছেন।
‘এলএসডি ২’-এর টিজার ও ট্রেলার মুক্তির সময় জানানো হয়েছে যে এটা প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য নির্মিত সিনেমা। কারণ, সিনেমাটিতে এমন সব ‘অস্বস্তিকর’ বিষয় দেখানো হয়েছে যা সব দর্শকের জন্য নয়।