শ্যাম বেনেগালকে কেন মনে রাখতেই হবে
ভারতীয় চলচ্চিত্রে সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেন, আদুর গোপালকৃষ্ণাণরা তখন পূর্ণ তেজে দেদীপ্যমান। এত তারার ভিড়েও ঠিকই চলচ্চিত্রে নিজের ছাপ রাখতে পেরেছিলেন শ্যাম বেনেগাল। ১৯৭৪ সালে মুক্তি পাওয়া তাঁর প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনিচিত্র অনেক বিচারেই হিন্দি সিনেমায় নতুন ভাষা যোগ করে।
বলিউডের বাণিজ্যিক সিনেমার রমরমার মধ্যেও পরের দুই দশক ধরে শ্যাম বেনেগাল হয়ে ওঠেন ভারতের সেরা নির্মাতাদের একজন। সমান্তরাল ধারার সিনেমায় ভারতীয় সমাজ, প্রান্তিক মানুষদের নিয়ে বার্তা দিতে চেয়েছেন তিনি। সেই ‘অঙ্কুর’ মুক্তির ৫০তম বছরেই চলে গেলেন শ্যাম।
শ্রমজীবী মানুষের জন্য সিনেমা তৈরি হবে তাঁদের পয়সায়—আপাতবিচারে কেতাবি কথা শোনালেও এটা সত্যি করেছিলেন শ্যাম। ১৯৭৬ সালে গণ–অর্থায়নে তৈরি করেন ‘মন্থন’। গণ–অর্থায়নে ভারতের প্রথম সিনেমা। আক্ষরিক অর্থেই খামারিদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে এক-দুই রুপি করে নিয়ে তহবিল সংগ্রহ করেছিলেন তিনি!
শিল্পী চিনতেও শ্যাম বেনেগালের জুড়ি মেলা ছিল ভার। শ্যাম বেনেগালের হাত ধরেই শাবানা আজমি, নাসিরউদ্দিন শাহ, মোহন আগাসের বড় পর্দায় যাত্রা শুরু হয়েছিল। স্মিতা পাতিল, অমরেশ পুরিকেও নতুন করে চিনিয়েছেন তিনি।
পর্দায় প্রান্তিক মানুষের গল্প তুলে এনেছেন শ্যাম বেনেগাল। তবে শহুরে মানুষের চোখে নয়, তাঁদের সঙ্গে থেকে, তাঁদের ভাষায় গল্প বলেছেন তিনি। দলিতদের গল্প নিয়ে নির্মিত ‘অঙ্কুর’ যাঁর জীবনের পটভূমিতে তৈরি করেছিলেন, তিনি ছিলেন নির্মাতার ছোটবেলার বন্ধু সূর্যম রেড্ডি।
দীর্ঘ ক্যারিয়ারে নানা বিচিত্র বিষয় নিয়ে ছবি করেছেন শ্যাম। তিনি ছিলেন কোঙ্কানি, বড় হয়েছেন হায়দরাবাদে, ছবি করেছেন মুম্বাইতে; বেড়ে ওঠার পথে এই বৈচিত্র্যময় পরিবেশ নিশ্চিতভাবেই তাঁর সিনেমায় প্রভাব ফেলেছে। শ্যাম বেনেগাল বহু তথ্যচিত্র করেছেন, সিনেমা বাস্তবঘেঁষা হওয়ার এটাও একটা কারণ। মহাত্মা গান্ধী, সুভাষচন্দ্র বসু, সত্যজিৎ রায় থেকে শেখ মুজিবুর রহমান—এক জীবনে এমন সব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বকে নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতাও খুব বেশি নির্মাতার নেই।
পাঁচ দশকের ক্যারিয়ারে নিজেকে বারবার পাল্টে নিয়েছেন, নানা ধরনের কাহিনি, নানা সময়ের ও গোত্রের ছবি করেছেন তিনি। হিন্দি ছবিতে নারী চরিত্র তাঁর হাত ধরেই ভিন্ন মাত্রা পায়।
গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক দায়িত্বও পালন করেছেন শ্যাম বেনেগাল। ২০১৬ সালে ভারতে ফিল্ম সার্টিফিকেশন–সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞ কমিটি তৈরি হয়, তারও নেতৃত্বে ছিলেন তিনি। ছবির ক্যাটাগরি বাড়িয়ে, কাঁচির প্রকোপ কমানোর সুপারিশ করেছিলেন শ্যাম। ২০২১ সালে যখন সরকারের তরফে সিনেমাটোগ্রাফ আইন সংশোধনের প্রস্তাব এল, বিরোধিতা করতে এতটুকু পিছপা হননি তিনি।
১৪ ডিসেম্বরই ৯০তম জন্মদিন উদ্যাপন করেছেন শ্যাম বেনেগাল। এই বয়সেও কাজ নিয়ে প্রচণ্ড সিরিয়াস ছিলেন। বলেছিলেন, ‘আমরা সবাই বৃদ্ধ হই। এটা এমন বড় কিছু নয়। দুটো-তিনটি বিষয় নিয়ে ভাবছি। কোনটা করব জানি না।’ নতুন আর করার সুযোগ পেলেন না, তবে যা করেছেন, তা–ই বা কম কী!