লাপাতা লেডিস: গ্রাম্য সরলতা আর মিষ্টি প্রেমের গল্প

‘লাপাতা লেডিস’–এর দৃশ্য। আইএমডিবি

এখন আলোচিত হিন্দি ছবি মানেই যেন সহিংসতা, যৌনতা। এসবের মধ্যে একমুঠো তাজা বাতাস নিয়ে এসেছে কিরণ রাও পরিচালিত ছবি ‘লাপাতা লেডিস’। প্রায় ১২ বছর পর পরিচালনায় ফিরলেন কিরণ। আর ফিল্মি ময়দানে নেমেই ছক্কা হাঁকালেন আমির খানের সাবেক স্ত্রী। বড় পর্দার পর এবার নেটফ্লিক্সে মুক্তি পেয়েছে ‘লাপাতা লেডিস’।

আরও পড়ুন

ছবিটি প্রযোজনা করেছেন আমির খান। নিজের প্রযোজিত ছবির ব্যাপারে তিনি কতটা খুঁতখুঁতে, তা কারও অজানা নেই। তাঁর সব ছবির সঙ্গে আবেগ, ভালোবাসা আর পরিশ্রম যে মিশে থাকে, তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ ‘লাপাতা লেডিস’। এই ছবির আদ্যোপান্তজুড়ে আছে গ্রাম্য সরলতা। অনেক দিন পর এক নিটোল মিষ্টি প্রেমের গল্পের সাক্ষী হলেন দর্শক। তবে এই ছবির পরতে পরতে লুকিয়ে আছে সামাজিক বার্তা, নারীশিক্ষা, পুরুষের একাধিপত্য, নারীর অসহায়ত্ব, যন্ত্রণা ও অসম্মানের কথা। তবে পরিচালক আড়ম্বরহীন, মোলায়েমভাবে ও হাস্যরসের ছোঁয়ায় সেসব কথা ছবিতে অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে তুলে ধরেছেন। তাই এই ছবি কোথাও কাঁদাবে, কোথাও হাসাবে, আবার কোথাও ভাবাবে। আর মন ছুঁয়ে যাবে আনকোরা একঝাঁক তরুণ-তরুণীর সরল–সাদাসিধে অভিনয়।

ছবির গল্প
ছবির সবচেয়ে বড় সম্পদ এর গল্প। বিপ্লব গোস্বামীর গল্প দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে কিরণ ছবিটি নির্মাণ করেছেন। কিরণ ও তাঁর দুই সহযোগী স্নেহা দেশাই এবং দিব্যানিধি শর্মা মিলে এই গল্পকে এক সরল মোড়কে পরিবেশন করেছেন। ছবির চরিত্রগুলো কাল্পনিক হলেও ছবির গল্প আর তার আবেগ কোথাও চেনা।

সিনেমার পোস্টার। আইএমডিবি

গ্রামগঞ্জে বউবদলের ঘটনা নতুন কিছু নয়। আর এর পেছনে আছে নানান সামাজিক কুসংস্কার, রীতিনীতি আর নিয়মের বেড়াজাল। বাড়ির বউ মানেই একগলা ঘোমটা দিয়ে তাকে মুখ আড়াল করে থাকতে হবে। কিরণ রাও প্রথম আলোর মুম্বাই প্রতিনিধিকে বলেছিলেন, এ ধরনের ঘটনা গ্রামগঞ্জে প্রায় ঘটে থাকে। তাই সাধারণ মানুষের বাস্তব অভিজ্ঞতা নিয়ে ছবির কাহিনি বোনা হয়েছে।

এবার আসা যাক গল্পের প্রসঙ্গে। নির্মল প্রদেশ নামের এক প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে কাহিনির শুরু। এক ভিড়ে ঠাসা ট্রেনে কয়েক জোড়া সদ্য বিবাহিত দম্পতি। সব নববধূর পরনে লাল শাড়ি আর অলংকার। এক হাত ঘোমটা টানা এই কনেদের চেনা দায়। এখানকার বধূদের নিজের স্বামী ছাড়া অন্য পুরুষকে মুখ দেখানো মানেই যে চূড়ান্ত সামাজিক অবক্ষয়। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ রে রে করে তেড়ে আসে। তাই ঘোমটা সরানোর আস্পর্ধা কারও নেই। এই ট্রেনেই যাত্রী নবদম্পতি দীপক কুমার আর ফুল কুমারী। মধ্যরাতে ঘুমচোখে দীপক অন্যের বউকে নিজের বউ ভেবে ট্রেন থেকে নেমে নিয়ে যায়। মানে সেই ‘ঘোমটা’র জন্য এই চরম বিভ্রান্তি। বেচারি সরল, ভোলাভালা ফুল কুমারী ট্রেনে পরম নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে থাকে। এদিকে দীপক জয়াকে নিজের বউ ভেবে বাড়িতে নিয়ে যায়। মূল এখান থেকে গল্পটা শুরু।

যেমন হলো সিনেমাটি
‘লাপাতা লেডিস’ কোথাও এতটুকু একঘেয়ে লাগবে না। গল্প, লোকেশন, পরিচালনা, সংগীত, অভিনয়—সবকিছুই হৃদয় ছুঁয়ে যাবে। কোথাও নেই আতিশয্যের চূড়ান্ত। শুধুই আছে নির্মল ভালোবাসা।

কিরণ রাও। এএনআই

পরিচালক বিনোদনের মোড়কে অনেক গভীর বার্তা সমাজের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। খান বা কাপুরদের ছাড়াও যে দর্শককে টান টানভাবে বসিয়ে রাখা যায়, তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ এই ছবি। গ্রামের ক্যানভাসে কিরণের রং-তুলির আঁচড় সত্যিই রঙিন করে তুলেছে এই ছবিকে। কিরণের জন্য কোনো প্রশংসাই যথেষ্ট নয়। বলা যায়, এই ছবির অন্যতম নায়ক তিনিই। রাম সম্পতের সংগীত পরিচালনা একদমই যথাযথ। ছবির গল্পের সঙ্গে তাঁর পরিচালিত গানগুলো মানানসই। রাম সম্পতের আবহ সংগীত ছবির মেজাজ ধরে রেখেছে।

অভিনয়
ছবির গল্প মূলত তিন চরিত্রকে ঘিরে বোনা হয়েছে। আর এই তিন চরিত্রেই তিন প্রায় অচেনা মুখ। স্পর্শ শ্রীবাস্তব (দীপক কুমার), নীতাংশি গোয়েল (ফুল কুমারী) আর প্রতিভা রাংটার (জয়া) অভিনয় মন ছুঁয়ে যাবে। এ ক্ষেত্রে কাস্টিং ডিরেক্টরকে বাহবা দিতে হয়। চরিত্রের সঙ্গে তাঁরা একদম মানানসই। এই তিন অভিনেতার মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় গ্রাম্য সরলতা। এ ছবি থেকে অন্যতম সেরা প্রাপ্তি রবি কিষণের অভিনয়। তাঁকে থানার বড় বাবু শ্যাম মনোহরের চরিত্রে দেখা গেছে। তিনি বোধ হয় জীবনের অন্যতম সেরা কাজটি করেছেন এই ছবিতে। ছায়া কদমের তুখোড় অভিনয় সত্যিই প্রশংসনীয়।