শরণার্থী থেকে ‘ক্যাবারে কুইন’, সালমানের সৎমায়ের গল্পটা জানেন কি
ষাট ও সত্তরের দশকে হিন্দি সিনেমায় ‘ক্যাবারে নাচ’ অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে ওঠে হেলেনের হাত ধরেই। ছিলেন সত্যিকারের স্টাইল আইকন। ব্রিটিশ অধিকৃত বার্মায় জন্মগ্রহণ করা হেলেনের বলিউড–যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৫৮ সালে ‘হাওড়া ব্রিজ’ সিনেমার মাধ্যমে। আজ ২১ নভেম্বর হেলেনের ৮৫তম জন্মদিন। এ উপলক্ষে জেনে নেওয়া যাক হেলেন সম্পর্কে কিছু জানা-অজানা তথ্য।
‘পিয়া তু’ গানে তাঁর রূপ আর নাচে মজেছিলেন দর্শকেরা। তবে তাঁর বলিউড জার্নিটা এত সহজ ছিল না। গ্রামের পর গ্রাম হেঁটে, অভুক্ত অবস্থায় মুম্বাইয়ে শরণার্থী হিসেবে পৌঁছেছিলেন হেলেন। তাঁর জন্ম ১৯৩৮ সালের ২১ নভেম্বর। বাবা জর্জ ডেসমায়ার ছিলেন অ্যাংলো ইন্ডিয়ান, মা বার্মিজ। তাঁরা মেয়ের নাম রাখেন হেলেন অ্যান রিচার্ডসন। তারপর আরও এক ছেলে রজার ও মেয়ে জেনিফার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বাবা মারা যান, তিনজনই শৈশবে পিতৃহীন হলেন। তিন শিশুসন্তানকে নিয়ে রেঙ্গুন ছাড়লেন হেলেনের অন্তঃসত্ত্বা মা।
ব্রিটিশ সেনাবাহিনী ও সাধারণ মানুষের সাহায্যে এক শরণার্থী দলের সঙ্গে তাঁরা এসে পৌঁছান আসামের ডিব্রুগড়ে। পথে অনেকের মৃত্যু হয়। আর গর্ভেই মৃত্যু হয় হেলেনের মায়ের অনাগত সন্তানের। কয়েক মাস আসামের হাসপাতালে থাকেন হেলেন। এরপর তিনি চলে আসেন কলকাতায়। সেই সময় গুটিবসন্তে মৃত্যু হয় ভাই রজারের। এরপরই মুম্বাইয়ে পাড়ি দেন তাঁরা।
১৯৪৩ সালে আরব সাগরের তীরে নতুন করে শুরু করেন জীবনযুদ্ধ। মা হাসপাতালে নার্সের কাজ নিলেও সংসার চলত না সেই টাকায়। সঙ্গে শেষ হলো হেলেনের পড়াশোনাও। মায়ের পাশে দাঁড়াতে স্কুলে যাওয়া ছেড়ে দিলেন তিনি।
এক পারিবারিক বন্ধুর সাহায্যে আসে সিনেমায় কাজের সুযোগ। হেলেন কাজের সুযোগ পেলেন পাঁচের দশকের গোড়ায়। কাজ পেলেন ‘শাবিস্তান’ ও ‘আওয়ারা’ সিনেমায়। কিছুদিনের মধ্যেই একক শিল্পী হিসেবে কাজের সুযোগ পান। ১৯৫৪ সালে ‘আলিফ লায়লা’ এবং পরের বছর ‘হুর-এ-আরব’ সিনেমায়।
১৯৫৮ সালে ‘হাওড়া ব্রিজ’ সিনেমায় হেলেনের নাচ ক্যারিয়ারের মোড় ঘুড়িয়ে দিয়েছিল। সিনেমাটিতে গীতা দত্তের গলায় ‘মেরা নাম চিন চিন চু’–এর সঙ্গে ১৯ বছর বয়সী হেলেনের নাচ আইকনিক হয়ে যায় বলিউডে। এরপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি হেলেনকে। শোনা যায়, তৎকালীন সময়ে একেকটি গানের জন্য ছয় হাজার রুপি পারিশ্রমিক নিতেন তিনি।
মণিপুরি, কত্থক ও ভরতনাট্যমের তালিম নিয়েছিলেন হেলেন। কিন্তু তাঁর আসল মুনশিয়ানা ছিল ক্যাবারে নাচে। বলিউডের কালজয়ী ‘শোলে’ সিনেমার ‘মেহবুবা ও মেহবুবা’, ‘ইন্তেকাম’-এর ‘আ জানে যা’ এবং ‘ক্যারাভান’-এর ‘পিয়া তু আব তো আ জা’ এখনো সতেজ।
ক্যারিয়ারের পুরোটা সময় হেলেন ছিলেন আলোচনায়। বিতর্কও তাঁর পিছু ছাড়েনি। খ্যাতির শীর্ষে থাকা হেলেন সম্পর্কে জড়িয়েছিলেন পরিচালক পি এন অরোরার সঙ্গে। তাঁদের বিয়ের গুঞ্জনও শোনা যায়। হেলেনের চেয়ে ২৭ বছরের বড় ছিলেন অরোরা। প্রায় ১৭ বছর তাঁরা সম্পর্কে ছিলেন। ১৯৭৪ সালে তাঁরা সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসেন।
প্রথম সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার সাত বছর পর নতুন সম্পর্কে বাঁধা পড়েন হেলেন। ১৯৮১ সালে তিনি বিয়ে করেন বলিউডের প্রখ্যাত চিত্রনাট্যকার সেলিম খানকে। তখন সেলিম চার সন্তানের বাবা। সালমা খানের সঙ্গে তাঁর প্রথম দাম্পত্যের বয়স ১৭ বছর।
প্রথমে বিরোধিতা থাকলেও পরে খান পরিবারে গ্রহণযোগ্যতা পান হেলেন। তিনিও আপন করে নেন স্বামীর প্রথম পক্ষের চার সন্তান সালমান, আরবাজ, সোহেল ও আলভিরাকে। পরে হেলেন ও সেলিম খান এক কন্যাকে দত্তক নেন—অর্পিতা। হেলেনের বিভিন্ন পার্টিতে দেখা যায় পুরো খান পরিবারকে।
বলিউডে ছয় শতাধিক ছবিতে আইটেম নাচে পারফর্ম করেছেন হেলেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে রয়েছে ‘গুমনাম’, ‘কাজল’, ‘জুয়েল থিফ’, ‘ইয়াকিন’, ‘দ্য ট্রেন’ ও ‘ক্যারাভান’। ১৯৮৩ সালে অভিনয় ছেড়ে দেন হেলেন। বেশ কয়েক বছর পর বিরতি ভেঙে তিনি অভিনয় করেন ‘খামোশি দ্য মিউজিক্যাল’, ‘হাম দিল দে চুকে সনম’-এর মতো ব্যবসাসফল সিনেমায়। ‘হাম দিল দে চুকে সনম’ সিনেমায় সালমান খানের মায়ের ভূমিকায় দেখা গিয়েছিল হেলেনকে। তিনি ২০০৯ সালে পদ্মশ্রী পুরস্কারে সম্মানিত হন।
সূত্র: হিন্দুস্তান টাইমস, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস