সেই দিনটির কথা...
>দুর্ঘটনা জীবনের গল্পে আনে ট্র্যাজিক বাঁক। সংস্কৃতিজগতেও এ রকম অনেক দুর্ঘটনা ঘটেছে, যেগুলো থমকে দিয়েছে চলার পথ। ২০১১ সালের ১৩ আগস্ট এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিলেন প্রতিভাবান চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদ ও সাংবাদিক–চিত্রগ্রাহক মিশুক মুনীর। পাঁচ বছর আগের সেই দিনটির কথা মনে রেখে আমরা খুঁজেছি এ রকম আরও কিছু মর্মান্তিক দুর্ঘটনার খবর, জানতে চেয়েছি, কেমন আছেন স্বজনেরা তাঁদের প্রিয় মানুষটিকে হারিয়ে।
কবির ভাইকে মিস করি
মোরশেদুল ইসলাম
দিনটি ছিল ২০ জানুয়ারি ১৯৮৯। আগের দিন আমরা বগুড়া গিয়েছিলাম। আলমগীর কবির, টিনা খান (অভিনেত্রী), আমি ও আমার স্ত্রী মুনিরা মোরশেদ মুন্নী (আলোকচিত্রশিল্পী)। গিয়েছিলাম বগুড়ার একটি নতুন চলচ্চিত্র সংসদের উদ্বোধন করতে। সন্ধ্যায় ছিল সে অনুষ্ঠান।
পরদিন আমরা দুপুরে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দিলাম। কবির ভাই গাড়ি চালাচ্ছিলেন। পাশের সিটে টিনা খান। পেছনে আমি ও মুন্নী।
সন্ধ্যা নাগাদ যমুনা নদীর নগরবাড়ী ঘাটে পৌঁছালাম আমরা। ফেরিতে ট্রাক উঠছে। আমরা অপেক্ষা করছি। আমাদের গাড়িটি পন্টুনে রাখা, নদীর কাছেই। ট্রাকগুলো উঠে গেলে আমরা উঠব।
আমি ফেরির টিকিট কাটতে বের হলাম। একটু পর দূর থেকে শব্দ শুনি, চিৎকার! ফিরে দেখি, আমাদের গাড়ি নেই। খুব ভারী মালামাল বোঝাই একটি ট্রাক ডানদিকে ঘোরাতে গিয়ে আমাদের গাড়িটিকে পেছন থেকে ধাক্কা দিয়েছে।
তখন অন্ধকার হয়ে আসছে। এর মধ্যে দেখি একটি হাত উঠছে-নামছে। একজন খালাসি নেমে গাড়ির টায়ারের সাহায্যে তাঁকে উদ্ধার করে আনলেন। তিনি আমার স্ত্রী মুন্নী। বাকি দুজনের খোঁজ নেই।
রাত ১১টার দিকে পাবনা থেকে উদ্ধারকারীরা এলেন। ৪০০ ফুট নিচ থেকে গাড়িটি টেনে তোলা হলো।
আমরা পরে ধারণা করেছি, কবির ভাই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। কারণ, তিনি ও টিনা খান দুজনেই ভালো সাঁতার জানতেন। আর আমি ও মুন্নী সাঁতার জানতাম না। মুন্নী বলেছিল, ট্রাকটি যখন ধাক্কা দিচ্ছিল, তখন শেষ মুহূর্তে কবীর ভাই হাত উঁচু করে চিৎকার করেছিলেন। ট্রাকটিকে সরে যেতে বলছিলেন তিনি। পরে তাঁকে সেভাবেই পাওয়া যায়। টিনা খান তাঁর নিচে চাপা পড়েন। এ জন্য তিনিও আর গাড়ি থেকে বের হতে পারেননি।
আলমগীর কবির ছিলেন আমার শিক্ষক, আপন বড় ভাইয়ের মতো। তিনিই হাতে ধরে আমাদের অনেককে চলচ্চিত্র জগতে এনেছেন। তাঁর অনুপ্রেরণাতেই প্রথম কাজ শুরু করেছিলাম। তরুণদের তিনি উদ্বুদ্ধ করতে পারতেন। এখনো কবির ভাইকে ভীষণ মিস করি।
শক ও শোক থেকে যায়
ঢালী আল মামুন
‘লাট সাহেবের চেয়ার’ নামে একটি শিল্পকর্ম তৈরি করেছিলেন ঢালী আল মামুন। ঢাকায় ‘টাইম, কো-ইনসিডেন্স অ্যান্ড হিস্ট্রি’ নামের এক প্রদর্শনীতে সেই চেয়ার চমকে দিয়েছিল দর্শকদের। যদিও শিল্পকর্মটির প্রেক্ষাপট ছিল ঔপনিবেশিক আগ্রাসন। কিন্তু দর্শকদের চেতনা থেকে ২০১১ সালের সড়ক দুর্ঘটনাটিও মুছে যায়নি।
সেই দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয়েছিলেন শিল্পী ঢালী আল মামুন। আঘাতে প্রায় গুঁড়িয়ে গিয়েছিল তাঁর শরীরের হাড়। ‘লাট সাহেবের চেয়ার’ শিল্পকর্মটিতে তাঁর আহত হাড়ের ছায়া শিল্পবোদ্ধাদের চোখ এড়ানোর কথা নয়। ওই দুর্ঘটনাতেই এই শিল্পী হারিয়েছিলেন তাঁর সৃজনজীবনের দুই আত্মীয়—চলচ্চিত্রনির্মাতা তারেক মাসুদ ও এটিএন নিউজের প্রধান নির্বাহী ও প্রধান সম্পাদক মিশুক মুনীরকে।
সেই অপঘাতের পাঁচ বছর পেরিয়ে গেল। এসব নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে মুঠোফোনে কথা বলতে গিয়ে স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন শিল্পী ঢালী আল মামুন।
শিল্পকর্মে ১৩ আগস্টের দুর্ঘটনার ছায়া পড়েছে কি?
ওই শিল্পকর্মটি তৈরি হয়েছে একটি ভিন্ন বাস্তবতায়। বাংলায় উপনিবেশ স্থাপনের জন্য লর্ড ক্লাইভ যে চেয়ারটিতে বসেছিলেন, সেটাই ‘লাট সাহেবের চেয়ার’। কিন্তু ওই সড়ক দুর্ঘটনার অভিজ্ঞতা পরবর্তী বেশির ভাগ কাজের ওপর ছাপ ফেলেছে। শিল্পীদের ক্ষেত্রে এটা হয়, এড়ানো যায় না।
তারেক মাসুদের শূন্যতা অনেক জায়গায়। তাঁর স্ত্রী, পুত্র নিষাদ, আপনি শূন্যতা অনুভব করছেন। সিনেমা অঙ্গনে আরেক ধরনের শূন্যতা। এসব কীভাবে পূরবে?
এই যে শূন্যতা, তা অভিঘাত তৈরি করে। মানুষ আবার প্রাকৃতিকভাবে এর সঙ্গে মানিয়েও নেয়। কিন্তু ‘শক’ ও ‘শোক’ থেকে যায়। সংবেদনশীল মানুষ একে শিল্পে রূপান্তরের চেষ্টা করেন। জীবনানন্দের কবিতায় যেভাবে তাঁর নিঃসঙ্গতাগুলো ধরা পড়ে, অন্য শিল্পীর ক্ষেত্রেও তা-ই। শোক যখন সংগীতে রূপ নেয়, তখন তা শিল্পের অন্য রকম এক স্তরে উন্নীত হয়। তারেকের শূন্যতা আমরা পূরণ করতে পারব না। তাঁর অভাব পূরণে প্রকৃতি নতুন সম্পর্কের দিকে ধাবিত করবে হয়তো। কিন্তু তাঁর শূন্যতা যাবে না। আমরা শিল্পের যে সংঘবদ্ধ জীবন যাপন করতাম, তাতে খানিকটা ছেদ পড়েছে। এখনকার প্রজন্মের মধ্যে এমনটা দেখা যায় না। তারেক ও মিশুকদের সঙ্গে আমার ছিল সৃজনশীল সম্পর্ক। আমরা প্রত্যেকেই মুক্তিযুদ্ধকে হৃদয়ে লালন করে সম্মিলিতভাবে দেশের জন্য কিছু করতে চেষ্টা করেছি। তারেক বাংলা সিনেমাকে বিশ্বের দরবারে নিয়ে গিয়েছিলেন। এই দেশ ও প্রজন্মের জন্য কাজ করবে বলে মিশুক বিদেশ থেকে চলে এসেছিল। এখন সে ধরনের সম্মেলন নেই বললেই চলে।
বন্ধুদের হারালেন, নিজে নতুন জীবন পেলেন। এ জীবন কীভাবে যাপন করবেন?
এটা বলে ব্যাখ্যা করা কঠিন। এ আমার বাড়তি জীবন। সব সময়ই ভাবি, কীভাবে জীবনটাকে অর্থময় করে কাটানো যায়। শুধু নিজের কর্মকাণ্ড দিয়েই নয়, চারপাশকে বিকশিত করে, চারপাশের মানুষদের নিয়ে। জানি না কতটুকু পারব।
কেমন আছেন ক্যাথরিন? নিষাদ কি তার বাবার গল্প শুনছে? সে কি ফিরবে এ দেশে?
ক্যাথরিন ভালো আছে। যোগাযোগ হয়। ফ্রান্সে ছিল, সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে ফিরেছে। নিষাদ স্কুলে যাচ্ছে। বাবার গল্প সে তাঁর মায়ের কাছে শোনে। সে যে কী করবে, সেটা এই সময়ে এসে বলা মুশকিল। তবে আমার বিশ্বাস, সে তাঁর বাবাকে নিয়ে গর্ব করবে। একসময় এই দেশে হয়তো ফিরবে।
ভাইয়ের পরিচয়ে পরিচিত হতে আমার ভালো লাগত
সাবেরী আলম
একটা মানুষ যদি দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকে, তখন যে কারোরই একরকম মানসিক প্রস্তুতি থাকে। কিন্তু আহীরের চলে যাওয়াটা খুবই ভয়াবহ একটা ঘটনা। এটা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। সে আমার একমাত্র ছোট ভাই। তার সঙ্গে আমার বয়সের পার্থক্য ছিল দেড় বছর। যেদিন আহীর দুর্ঘটনায় মারা যায়, সেদিন আমি চট্টগ্রামে ছিলাম। এটা বিশ্বাস করাটাই আমার জন্য ছিল কষ্টকর। কী করব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। সে রাতেই ঢাকায় রওনা করি। পরদিন সকালে আমি ফিরি। দুপুরে আমি আহীরকে দেখতে পাই।
গাইবান্ধার পলাশবাড়ীতে নকশীপাড়ের মানুষেরা নাটকের লোকেশন দেখতে ও ব্রিফিং করতে গিয়েছিল আহীর। সেদিন আরেকটা গাড়িতে সেলিম আল দীন, নাসির উদ্দীন ইউসুফও ছিলেন। সামনের গাড়িতে ছিল আহীর, সায়মন জাকারিয়া ও মাসুদ রানা নামের একজন নির্মাতা।
আহীর এত ভালো কাজ করত যে মাত্র এক বছরেই তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়ে। এখন যাঁরা প্রতিষ্ঠিত নির্মাতা, তাঁদের অনেকের সঙ্গে কথা বললে জানতে পারি, তাঁদের বেশির ভাগই আহীর দ্বারা অনুপ্রাণিত। এ জন্য অবশ্য একুশে টেলিভিশনেরও বিশাল ভূমিকা আছে। একটি টেলিভিশন চ্যানেলও যে সেলিব্রেটি হতে পারে মিশুক মুনীর ও সায়মন ড্রিংরা তা দেখিয়ে দিয়েছেন।
এই টেলিভিশনের সব অনুষ্ঠানে ছিল একেবারে ভিন্ন মাত্রার। আহীরও খুব অল্প সময়ে নিজেকে সেভাবেই পরিচিত করে তুলতে পেরেছে। ২০০০ সালে তো সময়ের মুহম্মদ জাফর ইকবালের গল্প থেকে বানানো প্রেত নাটকটি ছিল পুরোপুরি আনকনভেনশনাল।
আমি ১৩ বছর কাজ থেকে দূরে ছিলাম। আহীর চাইত আমি যেন আবার কাজ করি। কিন্তু সংসারে নিজেকে এতটা জড়িয়ে ফেলেছিলাম যে আমার আর ফেরা সম্ভব হয়নি। ফিরলাম যখন, তখন সে আমাকে ছেড়ে চলে গেল অনেক দূর! আমার যখন ফেরা হলো, তখন আমাকে মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, অমিতাভ রেজা ও গিয়াসউদ্দীন সেলিম—এঁরা আমাকে আহীরের বোন হিসেবেই চিনত। ভাইয়ের পরিচয়ে পরিচিত হতে আমার খুবই ভালো লাগত।
আমার কাছে সবচেয়ে আশ্চর্য ব্যাপার মনে হয়, মিশুক ভাইও যে এভাবেই দুর্ঘটনায় আমাদের ছেড়ে চলে যাবেন কল্পনাও করতে পারিনি। এ ঘটনা আমাকে খুবই নাড়া দিয়েছিল।
মিশুকের ঘরে মিশুক ঘুমাচ্ছে
মঞ্জুলী কাজী
মিশুকের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয় আজিজ সুপার মার্কেটে। ‘রেখায়ন’ নামে একটা বইয়ের প্রচ্ছদ তৈরির দোকান ছিল, সেখানে কবি, শিল্পী, সাহিত্যিকেরা আড্ডা দিতে যেতেন। সেখানেই ওকে প্রথম দেখেছি। ওর লম্বা লম্বা কোঁকড়ানো চুল, দাড়ি, হাতের ১০ আঙুলে ১০টা আংটি। তেমন বিশেষ কিছু মনে হয়নি সেদিন।
পরদিন সকালবেলা। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে পড়তাম। আর মিশুক গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে। কলাভবনের দোতলায় আমার বিভাগ, আর নিচতলায় ওর। সেদিন সকালে ওপর থেকে আমি দেখলাম, মিশুক যাচ্ছে। ডাক দিলাম, ‘মিশুক!’ শুনে ওপরে উঠে এল ও। দুজনে মিলে অনেক আড্ডা দিয়েছিলাম সেদিন।
পরদিন মিশুক আমার বাসায় টেলিফোন করে বসল। ও আমার নম্বর পেল কোত্থেকে? জিজ্ঞেস করলাম। বলল, পেয়েছি আর কি। সেদিনও ফোনে অনেক কথা বলেছিলাম আমরা। শিল্প-সংস্কৃতি-সাহিত্য নিয়ে কথা। পরে জেনেছিলাম, মিশুক বিভাগের পড়াশোনায় সহায়ক (সাবসিডিয়ারি) বিষয় হিসেবে ‘বাংলা’ নিয়েছিল। আমিও বাংলা সাহিত্য পড়তাম। সে সূত্রে আমাদের সাহিত্য নিয়ে অনেক আলাপ হতো। এভাবেই আমাদের শুরু।
এমনিতে সেভাবে আমরা প্রেম করিনি। ওর বন্ধুরা আমার বন্ধু হয়ে গেল। আমার বন্ধুরা ওর। একদিন রিকশা দিয়ে যেতে যেতে মিশুক বলল, ‘চল, একসঙ্গে বুড়ো হই।’ আমিও রাজি হয়ে গেলাম।
বাগদানের ছয় মাস পর আমাদের বিয়ে হয়। এত আনন্দ আর কোনো বিয়েতে দেখিনি। আমার শিল্পী-বন্ধুরা আমাদের বাসায় এসে আলপনা আঁকছে। আবার মিশুকের বাসায় যাচ্ছে আলপনা আঁকতে। ওর-আমার কাজিনেরা সারা দিন হইহই করছে।
আমাদের বিয়েটা কেমন যেন একটা দোলার মতো, একটা স্বপ্নের মতো। কোনো রাগারাগি নেই। এমন বিয়ে তো নাটক-সিনেমায় হয়।
বিয়ের আট বছর পর আমাদের সন্তান সুহৃদের জন্ম হয়। সুহৃদ আসবে, এই খবর প্রথম জেনে মিশুকের কী যে আনন্দ! নিজে থেকেই নানা বই পড়তে শুরু করে দিল। সন্তান পালন নিয়ে আমাকেও অনেক বই পড়তে দিত।
ছেলের নাম ঠিক করা নিয়েও আছে গল্প। এ সময়টার কয়েক বছর আগে আমি যুক্তরাজ্যের লন্ডনে গিয়েছিলাম। প্রাক-রেনেসাঁ যুগের শিল্পী সিবাস্টিয়ানোর কিছু ছবি সেবার ন্যাশনাল গ্যালারিতে প্রথম দেখিয়েছিল। আমি যখন অন্তঃসত্ত্বা, তখন ওই ছবিগুলো বারবার আমি স্বপ্নে দেখতাম।
সুহৃদ হওয়ার দিন বিকেলবেলা মিশুক তার দাদি আফিয়া খাতুনের কাছে গিয়ে বলল, মঞ্জুলী এমন স্বপ্ন দেখছে। মিশুক চায়, আমাদের ছেলের নামে সিবাস্টিয়ানোর নাম থাকুক। দাদিও রাজি হলেন। মিশুকের বাবা অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর পুরো নাম ছিল আবু নাঈম মো. মুনীর চৌধুরী। দাদি সুহৃদের নাম ঠিক করে দিলেন, নাঈম সিবাস্টিয়ান মুনীর। নাম রেখে দাদি বলেছিলেন, ‘নাম রাখাও হলো, গল্প বলাও হলো।’
মিশুকের ছেলে সুহৃদ এখন কানাডার রায়ারসন বিশ্ববিদ্যালয়ে মিডিয়া ডেভেলপমেন্টের ওপর মাস্টার্স করছে। সুহৃদ নামটাও এসেছে মিশুক থেকে। চলন্তিকায় সুহৃদ অর্থ দেখলাম, প্রিয় সখা বা বন্ধু। সত্যিই বাবা সুহৃদের নিকটতম বন্ধু, বেস্ট ফ্রেন্ড।
যেদিন হলো, সেদিন সুহৃদ মিশুকের বুড়ো আঙুল ধরে ঘুমিয়েছিল। বলতে গেলে ওকে মিশুকই মানুষ করেছে। সুহৃদের গায়ে তেল মালিশ করা, ওকে খাওয়ানো, ওষুধ খাওয়ানো, বুকের ওপর ঘুম পাড়ানো—সবই করেছে মিশুক। বড় হওয়ার পরও একটু অসুস্থ হলে সুহৃদ বাবার কাছে ঘুমোতে চলে যেত।
মিশুককে ঘিরে আমাদের এমন হাজারো স্মৃতি। ও আমাদের দুজনের জন্য এগুলো রেখে গেছে। সুহৃদ আমাকে বলে, ‘কখনো বলবে না, বাবা নেই।’ কেউ যখন বলে, মিশুক নেই, সুহৃদ খুব মন খারাপ করে।
আমরা মাঝে মাঝে ‘মিশুকের ঘর’-এ যাই। সেটাকে আমরা কখনো কবর বলি না। মিশুকের ঘরে মিশুক ঘুমাচ্ছে। আমরা গেলে ওর সঙ্গে অনেক কথা বলি। আর কথা বলার সময় এমন করে বলি, যেন মনে হয়, মিশুক এই তো বেরিয়ে গেল, একটু পর আসবে আবার...।
ও ছিল আমার সত্যিকারের সমালোচক
ইলিয়াস কাঞ্চন
জাহানারা ছিল আমার সব সময়ের বন্ধু। আমি কী খাব, কী করব, আমার চুলের স্টাইল কী হবে—সবকিছু ও খেয়াল করত। এমনকি আমার পায়ের নখটাও ঠিক করে দিত। আমি যেসব ছবিতে অভিনয় করতাম, চেষ্টা করতাম ওকে নিয়ে ছবিগুলো দেখার। কাজের চাপে আমি যে ছবিগুলো দেখতে পারতাম না, সেগুলো ওকে দেখার অনুরোধ করতাম। সে-ও দেখে এসে আমাকে বলত, ওই জায়গাটা খুব সুন্দর হয়েছে, কিন্তু ওইটা ভালো হয়নি। ও ছিল আমার সত্যিকারের সমালোচক। যা বললে আমার জন্য উপকার হতো, তা-ই করত।
একবার আমি মেকআপ ছাড়া টেলিভিশনে একটা সাক্ষাৎকার দিয়েছিলাম। বিষয়টা খেয়াল করার পর সে ওই সাক্ষাৎকার আবার দিতে বাধ্য করেছিল। জাহানারা আমাকে প্রচণ্ড বিশ্বাস করত। তার চোখের আড়াল হতে দিত না। আমি যখন কোনো ছবির শুটিংয়ে ঢাকার বাইরে থাকতাম, সেখানে গিয়ে হাজির হতো। আমিও চেষ্টা করতাম আমার শুটিং শেষ হলে তাকে নিয়ে বাইরে কোথাও ঘুরতে যেতে। শুটিং শেষ হওয়ার আগেই তাকে বলে রাখতাম, তুমি রেডি থেকো। আমাদের মধ্যে এ রকমই সম্পর্ক ছিল। অনেক ভালোবেসে ১৯৭৯ সালের ২২ জুলাই জাহানারাকে আমি বিয়ে করি। আমাদের সংসার ছিল দারুণ সুখের।
আমার জীবনে এমনটা হবে কখনোই ভাবিনি। ১৯৯৩ সালের ২২ অক্টোবর বান্দরবানে আমি দুর্নীতিবাজ সিনেমার শুটিং করছিলাম। এটি ছিল সেখানে আমার দ্বিতীয় ছবির শুটিং। প্রথম ছবির শুটিং করতে গিয়ে বান্দরবানের প্রেমে পড়ে যাই। তাই এই ছবির শুটিংয়ের সময় জাহানারাকে অনুরোধ করি সেখানে যাওয়ার। আমার কথামতো সে-ও দুই বাচ্চা ইমা ও জয়কে একটি ভাড়া করা গাড়িতে করে বান্দরবানের উদ্দেশে রওনা হয়েছিল। পটিয়ার গাছবাড়িয়া এলাকায় যাওয়ার পর দুর্ঘটনা ঘটে। মর্মান্তিক সেই সড়ক দুর্ঘটনায় জাহানারা আমাদের ছেড়ে চলে যায়।
জয়ের বয়স তখন চার বছর আর ইমার ছয়। আসলে আমি বোঝাতে পারব না সে সময়কার পরিস্থিতি। সে সময় আমি শুটিং থেকে বাসায় ফিরেই দেখতাম ইমা ও জয় কেউই ঘুমায়নি। দরজার পাশে দাঁড়িয়ে থাকত। আমাকে দেখে দৌড়ে কোলে আসত। প্রায়ই আমাকে জয় ও ইমা প্রশ্ন করত, ‘আম্মুকে সঙ্গে নিয়ে আসোনি কেন?’ আমি কিছু বলতে পারতাম না। সান্ত্বনা দেওয়ার মতো কোনো ভাষা আমার জানা ছিল না। একদিন বাসায় ফিরে শুনতে পেলাম, জয় খেলতে গিয়ে পড়ে খুব ব্যথা পেয়েছে। তাকে টেনে তোলার কেউ ছিল না। সান্ত্বনা দেওয়ার তো নয়ই। আমি যখন বাসায় ফিরলাম, দুজনেই দরজার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। আবারও বলল, ‘আম্মুকে নিয়ে আসোনি কেন?’
ইমা আমাকে সেদিন বলল, জয় জানালার পাশে দাঁড়িয়ে বলছিল, ‘আল্লাহ, তুমি আমার আম্মুকে ফিরিয়ে দাও। আমাদের তো আদর করার কেউ নাই।’ এ কথা শুনে সান্ত্বনা দিতে পারিনি। আমার মুখে কোনো ভাষা ছিল না। আমি তখন সিদ্ধান্ত নিলাম ইমা ও জয়কে মায়ের আদর-স্নেহ দিয়ে মানুষ করব। সিনেমা থেকে বিদায় নেওয়ার সিদ্ধান্তটাও নিয়ে নিলাম। তখন আমি কিন্তু সুপারস্টার। দিনে আঠারো ঘণ্টা আমাকে কাজ করতে হতো। আমার বাড়িতে প্রযোজক, পরিচালক, শুভানুধ্যায়ীরা এলেন। তাঁরা আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন। অনেকে এ-ও বললেন, আমি কিছুদিনের মধ্যে হিরো থেকে জিরো হয়ে যাব। আমি বলছিলাম, যে মানুষগুলোর জন্য কাজ করতে গিয়ে যদি জিরো হয়ে যাই, তাতে আমার কোনো আফসোস নাই। আমি তাদের জন্যই কাজ করে যাব।
সাংবাদিক শফিক রেহমান আমাকে বললেন, ‘ইলিয়াস সাহেব, আপনি আপনার স্ত্রীকে ভালোবাসেন। তাই চলচ্চিত্র থেকে বিদায় নিতে চাচ্ছেন। কিন্তু আপনি কি জানেন এ দেশের কোটি কোটি মানুষ আপনাকে ভালোবাসে। আপনি যখন সিনেমায় কাঁদেন, এই মানুষগুলোও কাঁদে। আপনি যখন হাসেন, এই মানুষগুলো হাসে। আপনি যখন অন্যায়ের প্রতিবাদ করেন, এই মানুষগুলো হাততালি দেয়। আপনার সমর্থন করে। সে মানুষগুলোকে আপনি ছেড়ে যাবেন? এই মানুষগুলোও তো সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাচ্ছে। আপনি আপনার স্ত্রীকে বাঁচাতে পারেননি, আপনি কি এই মানুষগুলোকে বাঁচাতে পারেন না?’
শফিক রেহমান সাহেবের এই কথাটা আমাকে বেশ নাড়া দেয়। পনেরো দিন ধরে ভাবলাম। সহকর্মীদের বললাম, কেউ সমর্থন দেয়নি। যারা সমর্থন দিয়েছে, তাদের নিয়ে আমি রাস্তায় নেমে এলাম। ‘পথ যেন হয় শান্তির, মৃত্যুর নয়’ স্লোগান নিয়ে নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলন শুরু করলাম। আজ ২৩ বছর ধরে আমি আমার সংগঠনের সবাইকে নিয়ে এই সংগ্রামটা চালিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনাটা যে হারে কমানো উচিত, সে হারে কমেনি।
ছেলে হারানো মা কী করে ভালো থাকবে?
বেগম মমতাজ হোসেন
দোতলা বাড়িটার প্রধান ফটক দিয়ে বসার ঘরে ঢুকতেই চোখ পড়ে দেয়ালে সাজানো ছবি আর বাঁধাই করা সম্মাননাগুলোর দিকে। বেগম মমতাজ হোসেনের অর্জন বোঝানোর জন্য দেয়ালটাকে খুব ক্ষুদ্রই মনে হয়। কারণ তাঁর সৃষ্টি ও কর্ম যে আলো ছড়িয়েছে সবখানে, তা কয়েকটা সনদ আর সেরা মুহূর্তের ছবির মধ্য দিয়ে প্রকাশ করা কঠিন। তাঁর মাত্র একটি সৃষ্টির নাম বললেই স্মৃতিকাতর হয়ে পড়বেন অনেকে। বেগম মমতাজ হোসেন বাংলাদেশ টেলিভিশনের বহুল জনপ্রিয় ধারাবাহিক নাটক সকাল সন্ধ্যার রচয়িতা। বার্ধক্যে উপনীত তিনি, তবে তাঁর লেখনীর ধার এখনো আগের মতোই আছে।
এখনো দিনের একটা সময় নিয়ম করে কাগজ-কলম নিয়ে বসেন তিনি, লেখেন এ সময়, অতীত কিংবা প্রত্যাশার কথা। তবে তাঁর একটা গল্প আছে, যা লিখতে পারছেন না তিনি। বলতে গেলেও চোখ ভিজে আসে তাঁর। সেই গল্পটা এক সন্তান হারানো মায়ের। যে সন্তানকে মা বহু বছর পর ফিরে পেয়ে আবার হারিয়ে ফেলেছেন চিরতরে। ভেজা চোখ নিয়েই তিনি আমাদের শোনালেন সেই গল্প।
বেগম মমতাজ হোসেনের এক ছেলে। মায়ের অমতে বিয়ে করে বাড়ি ছাড়েন। ধারণা ছিল হয়তো সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভাঙবে মায়ের অভিমান। সময় গড়ায়, কিন্তু মা-ছেলের অভিমান ভাঙে না।
বেগম মমতাজ হোসেনের ভাই আলমগীর কবির বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ইতিহাসের এক শক্তিশালী নাম। তাঁর ছেলেও মামার পথের অনুসারী ছিলেন। কিন্তু পরিবার থেকে দূরে দূরে থেকে তিনি চলেছেন শিল্পী ও সংস্কৃতিচর্চার সেই পথে। একসময় কারও কোনো সাহায্য ছাড়া অর্জনও করেছিলেন কাঙ্ক্ষিত সাফল্য। কিন্তু এরপরও অপূর্ণতা পূরণ হচ্ছিল না। কারণ মা যে অভিমান করে আছেন।
অনেক বছর পেরিয়ে যাওয়ার পর গত বছরের শেষ দিকে হঠাৎ করেই একদিন বেগম মমতাজের কাছে একটা ফোন আসে। বেগম মমতাজ এত বছর পর কেন জানি ওই এক ফোনেই সব অভিমান ভুলে যান। দেখা হয় মা-ছেলের। সম্পর্কগুলো জোড়া লাগতে শুরু করে ধীরে ধীরে। ছেলের সঙ্গে সঙ্গে মমতাজ বেগম ফিরে পান তাঁর ছেলের বউ, নাতি ও নাতনিকে।
কিন্তু এর মাস তিনেক পর, ৭ মার্চ দুপুরে একটা কৃষ্ণচূড়াগাছ বেগম মমতাজের হারিয়ে পাওয়া গল্পের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। তাঁর ছেলে খালিদ মাহমুদ মিঠু সে দিন একটি কৃষ্ণচূড়াগাছের নিচে চাপা পড়ে মারা যান।
ছেলের মৃত্যুর পর থেকেই মা বেগম মমতাজ শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন। মাস খানেক আগে তাঁর কিছু স্মৃতি বিস্মৃতিও হয়ে যায়। তিনি ফিরে যান বেশ কয়েক বছর পেছনে। যখন মিঠু ছোট ছিলেন। আবার একটু পরপরই বর্তমানেও ফিরে আসতেন। মনে করতেন ছেলের সঙ্গে দেখা হওয়ার শেষ সময়টা। অনেক বছর পর ছেলেকে ফিরে পাওয়ার মুহূর্তগুলোর স্মৃতি হাতড়ে উঠতেন হঠাৎ হঠাৎ। আমাদের বললেন, ‘এই তো সেদিন এসেছিল ও (মিঠু)।’ সোফার পাশের খালি জায়গাটা দেখিয়ে দিয়ে বললেন, ‘এখানেই বসেছিল।’ ভেজা চোখের হঠাৎ জ্বলে ওঠা দেখে বোঝা গেল, মায়ের চোখে তাঁর ছেলেটা এখনো সেখানেই আছেন। কোত্থাও যাননি। ছেলে যেন পাশেই বসে আছেন, সেই ভঙ্গিতে বললেন, ‘জানো, ওর ছেলেটারও (আর্য শ্রেষ্ঠ) না ছবি বানানোর ঝোঁক অনেক। বাবার মতোই হবে একদিন। তবে আমি এ কমাস যতটুকু বুঝলাম, মেয়েটা (শিরোপা পূর্ণা) সবচেয়ে বেশি মেধাবী। অনেক তেজদীপ্ত সে। ওদের বাবা যেমন আমাদের কারও কোনো সাহায্য ছাড়াই সবকিছু অর্জন করেছে, দেখো ওরাও এমনটাই হবে।’
বিদায় নেওয়ার সময় যখন তাঁকে বলা হলো, ‘ভালো থাকবেন।’ তখন আবারও মায়ের কষ্ট যেন উছলে ওঠে, ‘একটা ছেলে হারানো মা কী করে ভালো থাকবে, বলো?’