যে দশবার 'স্বজনপ্রীতি' জিতেছে ফিল্মফেয়ার
নেপোটিজম, নেপোটিজম, নেপোটিজম! আগে থেকেই বলিউডে শব্দটা জনপ্রিয় ছিল। আর এবার সুশান্ত সিং রাজপুতের ‘আত্মহত্যা’র পর বলিউডের সবচেয়ে জনপ্রিয় শব্দ হয়ে দাঁড়িয়েছে নেপোটিজম বা স্বজনপ্রীতি। বলিউড তারকা হওয়র সবচেয়ে সহজ আর শর্টকাট পদ্ধতি হয়ে দাঁড়িয়েছে বলিউড তারকার সন্তান বা আত্মীয় হওয়া। বলিউডে স্বজনপ্রীতি ছিল, আছে আর থাকবে। এর মধ্যেই বহিরাগতরাও মেধা আর পরিশ্রম দিয়ে স্থান করে নেবে। বলা হচ্ছে, বলিউডের স্বজনপ্রীতিকে শক্তভাবে শিকড় গড়তে ৩০ বছর ধরে ফিল্মফেয়ার সঙ্গ দিয়েছে। অনেকে বলেন, স্বজনপ্রীতির সঙ্গে থাকতে হয় আসলে। দেখে নেওয়া যাক, যে দশবার স্বজনপ্রীতি হাতে তুলল 'সেরা নবাগত বা নবাগতা' (নারী ও পুরুষ) হিসেবে, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের পর বলিউডের অন্যতম 'মর্যাদাপূর্ণ' পুরস্কার, ফিল্মফেয়ার।
টুইঙ্কেল খান্না সেরা নবাগত অভিনেত্রী!
বলিউডে টুইঙ্কেল খান্নার প্রথম পরিচয়, রাজেশ খান্না ও ডিম্পল কাপাডিয়ার কন্যা। ববি দেওলের সঙ্গে 'বারসাত' ছবি দিয়ে তিনিও বাবা–মায়ের দেখানো পথেই হাঁটা শুরু করেন। সিনেমাটা বক্স অফিসে হিট করেছিল। আর ফিল্মফেয়ার সে বছর টুইঙ্কেল খান্না আর ববি দেওল দুজনকেই সেরা নবাগতা ও সেরা নবাগতর পুরস্কার ধরিয়ে দিল। পরবর্তী ৮ বছরে টুইঙ্কেল খান্না মাত্র ১৬টি সিনেমা করেন, যার বেশির ভাগই ফ্লপ। অভিনয় তাঁর কর্ম নয় বলে সালাম ঠুকে বলিউড থেকে বিদায়ও নেন। পরে সফল লেখক হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করেন। ফিল্ম কম্পানিয়নে অনুপমা চোপরার সঙ্গে আলাপে টুইঙ্কেল খান্না নিজেই স্বীকার করেছেন, তিনি অভিনয়শিল্পী হিসেবে খুব খারাপ। অভিনয়ে নিজেকে নিজে দশের ভেতর মাত্র চার নম্বর দিয়েছেন। তাহলে পুরস্কারটা কে পেয়েছে? টুইঙ্কেল না তাঁর সুপারস্টার বাবা–মা?
ফারদিন খান নন, বলুন 'ফিরোজ খান পুত্র'
বিশ্বাস করুন বা না করুন, সেরা নবাগত হিসেবে 'প্রেম আগুন' সিনেমার জন্য ফিল্মফেয়ার হাতে উঠেছে ফারদিন খানের। অথচ এই সিনেমায় ফারদিন খানের অভিনয়কে 'ক্লান্তিকর' বলে রায় দিয়েছেন সমালোচকেরা। সিনেমাটিও বক্স অফিস বা সমালোচক, কোথাও সাড়া ফেলতে পারেনি। পরে ফারদিন খান নিজেকে একজন 'ব্যর্থ অভিনেতা' হিসেবে বারবার প্রমাণ করেছেন। পুরস্কারটি 'ফিরোজ খানের পুত্রে'র হাতে ধরিয়ে দিয়ে ফিল্মফেয়ারের ওজন নষ্ট করার কি খুব দরকার ছিল? যেখানে একাধিক বছরে ফিল্মফেয়ার যোগ্য নতুন মুখের অভাবে এই বিভাগে পুরস্কার দেয়নি।
ফারহান আখতার আর ইমরান খান সমান অভিনেতা
'জানে তু ইয়া জানে না' সিনেমা দিয়ে প্রথম বছরেই সেরা নতুন মুখের ফিল্মফেয়ার ঘরে নিয়ে গেছেন আমির খানের ভাগনে ইমরান খান। তবে বলতেই হবে, তুলনামূলকভাবে ইমরান খান এই ছবিতেই ভালো অভিনয় করেছেন। কারণ, তাঁর অভিব্যক্তি যে কতটা বৈচিত্র্যহীন আর অগভীর তা বলিউড পরবর্তী কয়েক বছরেই টের পেয়েছে। ইমরান খানকে সেরা নবাগত হিসেবে পুরস্কার দেওয়া নিয়ে কোনো অভিযোগ থাকত না, যদি না সেই বছর ফারহান আখতারের 'রক অন' সিনেমাটি মুক্তি না পেত। ওই বছর এই পুরস্কার ইমরান খান আর ফারহান আখতার দুজনকেই দেওয়া হয়। অথচ খালি চোখে এই দুজনের অভিনয়ের বিশাল পার্থক্য স্পষ্ট। 'রক অনে' ফারহান আখতারের একই ছবিতে সম্পূর্ণ বিপরীত দুটো চরিত্রের অভিনয় বলিউডের অন্যতম ভালো অভিনয় হিসেবে স্বীকৃত। তাঁর সঙ্গে ইমরান খানকে এক কাতারে দাঁড় করিয়ে স্বীকৃতি দেওয়ার দরকার ছিল না। ফারহান আখতার যে ইমরান খানের চেয়ে ঢের ভালো অভিনেতা, তা বোঝার জন্য আতশ কাচের দরকার নেই।
মধুবন নয়, তুষার কাপুর ভালো অভিনেতা!
ফারদিন খানের মতোই আরেকজন হলেন তুষার কাপুর। ‘মুঝে কুছ ক্যাহনা হ্যায়’ সিনেমাটি কেউ দেখেছেন? এই সিনেমার জন্য সেরা নবাগত হিসেবে তুষার কাপুরের হাতে পুরস্কার উঠেছে! শুধু তুষার কাপুর নয়, তাঁর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কারিনা কাপুরও এই ছবিতে খারাপ অভিনয় করেছেন। সমালোচকেরা বলেছেন, 'লাইফলেস' অভিনয়ের সেরা উদাহরণ এই ছবি! অথচ সেই বছর 'র্যাহনা হ্যায় তেরে দিল মে' ছবির মধ্য দিয়ে বলিউডে খাতা খোলেন এন আর মধুবন। আর একটা বাচ্চাও বলে দিতে পারবে, তুষার কাপুর আর আর মধুবনের মধ্যে কে বেশি ভালো অভিনেতা। কিন্তু বড় বড় বোদ্ধারা মিলে মধুবন নন, সেরা ফিল্মফেয়ার তুলে দিলেন তুষার কাপুরের হাতে। অবশ্য অনেকেই তুষার কাপুরকে বড় পর্দায় দেখে বিরক্ত হয়ে বোন একতা কাপুরের সঙ্গে প্রযোজনায় নামতে উপদেশ দিয়েছেন। তুষারের একমাত্র জনপ্রিয় ও প্রশংসিত চরিত্র 'গোলমাল' সিনেমার সিক্যুয়েলে। কিন্তু এক বোবা কমিক চরিত্র দিয়ে আর কত দিন!
দ্বিতীয় ছবিতে 'সেরা নবাগত' সাইফ আলী খান
কোনো সন্দেহ নেই, সময়ের সঙ্গে সাইফ আলী খান নিজকে সুঅভিনেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। ধীরে, কিন্তু নিশ্চিতভাবে সাইফ আলী খান নিজের অভিনয়কে উঁচুতে আরও উঁচুতে নিয়ে গেছেন। কিন্তু শুরুতে যে তিনি 'বাজে অভিনয়' করতেন, সম্প্রতি সে কথা নিজেই একটা সাক্ষাৎকারে অকপটে স্বীকার করেছেন। বলেছেন, প্রথম দিকের সিনেমা দেখলে তাঁর নিজেরই অস্বস্তি হয়। কিন্তু শর্মিলা ঠাকুরের ছেলের হাতেই ১৯৯৪ সালে উঠেছিল সেরা নবাগতের ফিল্মফেয়ার, 'আশিক আওয়ারা' সিনেমার জন্য। যদিও ‘আশিক আওয়ারা’ সাইফের প্রথম ছবি নয়। এর দুই সপ্তাহ আগে 'পইরম্পরা' ছবি দিয়ে বলিউডের খাতা খোলেন সাইফ। যেহেতু ওই ছবিতে আমির খানের সঙ্গে পর্দা ভাগ করেছিলেন সাইফ, তাই ফিল্মফেয়ার কমিটি ঠিক করল, যেখানে তিনি একা 'নায়ক' হিসেবে অভিনয় করেছেন, সেই ছবিতেই তাঁকে পুরস্কার দেবেন।
একটি নয়, দুটি নয়, চারটি পুরস্কার এশা দেওলের
হেমা মালিনী আর ধর্মেন্দ্রর কন্যা বলিউডে পা রাখছেন, এটিই ছিল তখনকার সময়ে সাড়াজাগানো আলোচিত ঘটনা। তাই এশা কী ছবি করছেন, কেমন অভিনয় করছেন, এগুলো ঠিক হওয়ার আগেই পুরস্কারটা এশার নামে বরাদ্দ করা ছিল। তা ছাড়া এশার 'বোল্ড লুক' নিয়ে প্রত্যাশার পারদও ছিল উঁচুতে। কিন্তু 'কোয়ি মেরা দিল সে পুছে' মুক্তির পর দর্শক ছবিটা মোটেই গ্রহণ করলেন না। অথচ ছবিতে এশা দেওলের অভিনয় নিয়ে সমালোচনাও কম হয়নি। অথচ ফিল্মফেয়ার ছাড়াও আইফা, স্টার স্ক্রিন অ্যাওয়ার্ডসহ সেরা নতুন মুখ হিসেবে চারটি পুরস্কার ঘরে উঠল এশার।
দুই বছর পর পূজা ভাট হলেন সেরা নবাগতা
‘ড্যাডি’ সিনেমার মাধ্যমে অভিনয়শিল্পী হিসেবে খাতা খোলেন পূজা ভাট। তাঁর বাবা মহেশ ভাটের বানানো। ছবিটি ১৯৮৯ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি মুক্তি পায়। কিন্তু পূজা ভাটকে সেরা নবাগতার পুরস্কার দেওয়া হয় ১৯৯১ সালে। কেন? কারণ, সে বছর ভাগ্যশ্রীর প্রথম ছবি ‘ম্যায়নে প্যায়ার কিয়া’ মুক্তি পায়। আর অবিসংবাদিতভাবে এই পুরস্কারের পরিষ্কার দাবিদার সে বছর ভাগ্যশ্রী। তাই পূজা ভাটকে সে বছর পুরস্কার দিতে না পারায় ফিল্মফেয়ার পরের বছর পুরস্কারটি তাঁর হাতে তুলে দেয়। হাস্যকর হলেও এটিই বাস্তবতা।
বছরের সবচেয়ে 'বাজে' অভিনয় করে অনন্যা পান্ডের ফিল্মফেয়ার
অনন্যা পান্ডে কেবল 'স্টুডেন্ট অব দি ইয়ার টু' নয় বরং সঙ্গে 'পতি পত্নী ঐর ও' এই দুটো ছবির জন্য ফিল্মফেয়ারে সেরা নবাগতার পুরস্কার পেয়েছেন। আচ্ছা, একজন নতুন মুখ দুটো ছবির জন্য কীভাবে প্রথম পুরস্কার পায়? দ্বিতীয় ছবি তো আর প্রথম হিসেবে বিবেচিত হয় না, তা–ই না? অনন্যার প্রথম ছবি 'স্টুডেন্ট অব দি ইয়ার টু'। অনেক ছবি নিয়ে সমালোচকেরা বিভক্ত হয়ে যান। কেউ বলেন ভালো, কেউ বলেন মন্দ, তো কেউ বলেন, মন্দ নয়। অথচ সমালোচকেরা সবাই একযোগে সুর তুলে এই ছবিটাকে বলেছেন, বছরের সবচেয়ে বাজে গল্প, বাজে অভিনয় আর বাজে পরিচালনার সিনেমা। তাই এই ছবিটাকে ধরে সেরা নবাগতার পুরস্কার দিলে একটু বেশিই খারাপ দেখায়। তাই এর সঙ্গে 'পতি পত্নী ঔর ও'কেও যোগ করে দিল ফিল্মফেয়ার। আর কেবল ফিল্মফেয়ারের কথা বলছি কেন, এশা দেওলের মতো অনন্যা পান্ডেও সেরা নবাগতা হিসেবে 'জিতেছেন' চার-চারটি পুরস্কার। অথচ ‘মালাল’ ছবিতে সে বছর শারমিন সেগালের অভিনয় প্রশংসিত হয়। এমনকি 'স্টুডেন্ট অব দি ইয়ার টু' ছবিতে তাঁরা সুতারিয়াও চাঙ্কি পান্ডে কন্যার চেয়ে ঢের ভালো অভিনয় করেছেন। আর এই তিনজনের চেয়েও অধিক ও স্পষ্ট দাবিদার ছিলেন শিবালিকা ওবেরয়। 'ইয়ে সালি আশিকী' ছবিতে তাঁর অভিনয় দারুণ প্রশংসা কুড়ায়।
সুরাজ পাঞ্চোলি ভিকি কৌশলের চেয়ে ভালো অভিনেতা!
আদিত্য পাঞ্চোলির ছেলে সুরাজ পাঞ্চোলি হিরো সিনেমা দিয়ে 'বলিউড তারকা' হওয়ার যাত্রা শুরু করেন। এই ছবিতে আরও অভিনয় করেছেন সুনীল শেঠির মেয়ে আথিয়া শেঠি। আর ছবিটির প্রযোজক, আর কেউ নন, সালমান খান। এই সিনেমা এককথায় নেপোটিজমের দোকান। এই সিনেমা নিয়ে সমালোচকদের বিরক্তির সীমা নেই। অথচ এই ছবিতে অভিনয় করে সুরাজ পাঞ্চোলি সেরা নবাগতর পুরস্কার জিতে নেন। যদিও সে বছর 'মাসান' সিনেমার মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করেন ভিকি কৌশল! আর মাসানে ভিকি কৌশলের অভিনয়কে বছরের অন্যতম সেরা অভিনয় হিসেবে ধরা হয়। তা–ও ভালো, সে বছর ‘দম লাগাকে হাইশা’ ছবির জন্য ভূমি পেড়নেকর সেরা নবাগত পুরস্কার জিতেছিলেন। অন্তত আথিয়া শেঠিকে দেওয়া হয়নি।
রাধিকা মাদান নয়, সারা আলী খান
বলা হয়, 'কেদারনাথ' সিনেমায় সারা আলী খানের অভিনয় বাদে আর সবই ভালো। 'পাটাকা' সিনেমায় সে বছর রাধিকা মাদানের অভিনয় দারুণ প্রশংসিত হয়। ‘অক্টোবর’ সিনেমায় গীতাঞ্জলি রাও–এর অভিনয় ভোলা কঠিন, তা যে কেউ স্বীকার করবেন। এমনকি একই ছবিতে বনিতা সান্ধুর অভিনয়ও সারা আলী খানের চেয়ে ঢের ভালো বলে সবাই অকপটে স্বীকার করবেন। সিনেমার ৯০ ভাগ সময় কেবল বিছানায় শুয়ে থেকেও বনিতা সারার চেয়ে ঢের ভালো অভিনয় করেছেন। সারা আলী খান তাঁর সিনেমা মুক্তির আগেই সাইফ আলী খানের কন্যা হিসেবে অসংখ্য সাক্ষাৎকার দেওয়ার সুযোগ পান। কেবল সাক্ষাৎকার দিয়েই ভালো জনপ্রিয়তা জড়ো করেন সারা। কিন্তু পুরস্কারটি তো জনপ্রিয়তার বিচারে নয়, ভালো অভিনয়ের জন্য।