যেসব সৃষ্টিতে বেঁচে থাকবেন সরোজ খান
সরোজ খানের মৃত্যু যেন এক স্বর্ণযুগের অবসান। মাধুরীর ‘ধক ধক গার্ল’ বা শ্রীদেবীর ‘চাঁদনি’ হয়ে ওঠার নেপথ্যের জাদুকর ছিলেন সরোজ। ৩ জুলাই বলিউডের কিংবদন্তি এই নৃত্যপরিচালক ৭১ বছর বয়সে মুম্বাইয়ে মারা যান। তিনি চলে গেলেও তাঁর অমর সৃষ্টিগুলো রয়ে গেছে। তিনবার ভারতের জাতীয় পুরস্কার পাওয়া এই কোরিওগ্রাফারের সেরা কয়েকটি সৃষ্টি নিয়ে এই প্রতিবেদনে। লিখেছেন দেবারতি ভট্টাচার্য।
মেরে হাতো মে নও নও চুড়িয়াঁ হ্যায়
ছবি: চাঁদনী
হাতে রংবেরঙের কাচের চুড়ি। আবেদনমাখা দিঘল দুটি চোখ। আর লাল ঘাঘরা-চোলিতে শ্রীদেবীর নাচ। যশ চোপড়া প্রযোজিত এবং পরিচালিত চাঁদনি ছবির প্রতিটি গান স্মৃতিতে আজও তাজা। তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে যায় ‘মেরে হাতো মে নও নও চুড়িয়া হ্যায়’ গানে শ্রীদেবীর নাচ। গানটি গেয়েছিলেন লতা মঙ্গেশকর। সুর করেছিলেন শিব-হরি। আর গানটি লিখেছিলেন আনন্দ বক্সি। তবে গানটির পেছনে আরেকজনের অবদান আছে, তিনি হলেন যশ চোপড়ার স্ত্রী, তথা গায়িকা পামেলা চোপড়া। পামেলা গানটি লিখতে আনন্দ বক্সিকে সহযোগিতা করেছিলেন। আর গানটির প্রতিটি অনুভূতি এবং মুহূর্তকে পর্দায় যিনি জীবন্ত করেছিলেন, তিনি হলেন সরোজ খান। তাঁর অসামান্য কোরিওগ্রাফিতে ‘মেরে হাতো মে নও নও চুড়িয়া হ্যায়’ গানটির স্মৃতি আজও উজ্জ্বল।
এক দো তিন
ছবি: তেজাব
এন চন্দ্রা পরিচালিত তেজাব ছবির মোহিনীরূপী মাধুরীকে আজও ভুলতে পারেনি ভারতীয় সিনেমা। এই মোহিনীর নেপথ্য কারিগর সরোজ খান। তেজাব ছবির কালজয়ী গান ‘এক দো তিন’-এর সঙ্গে মাধুরীর মাতাল করা নাচের নেপথ্যে ছিলেন সরোজ। আজও মাধুরীর স্মৃতিতে উজ্জ্বল এই গানের সঙ্গে জড়িয়ে কিছু স্মৃতি। সরোজ খানের এই গান সম্পূর্ণ কোরিওগ্রাফ করতে মাত্র ২০ মিনিট সময় লেগেছিল। তবে শুট করার আগে টানা ১০-১৫ দিন মহড়া দিতে হয়েছিল মাধুরীকে। এক হাজার মানুষের সামনে গানটির দৃশ্য ধারণ করা হয়। ১৯৮৮ সালে ছবিটি মুক্তির পর প্রেক্ষাগৃহে ‘এক দো তিন’ গানটি পুনরায় দেখানোর অনুরোধ হামেশাই দর্শকদের মধ্য থেকে আসত। এমনকি মোহিনী পর্দায় এলে হলজুড়ে নাকি টাকাও উড়ত।
ধক ধক করনে লাগা
ছবি: বেটা
‘ধক ধক করনে লাগা’ গানে মাধুরী-অনিলের রোমান্স আজও অনেকের মনে দাগ কেটে আছে। বেটা ছবির এই রোমান্টি নাচের দৃশ্য আজও অনেকের স্মৃতিতে রঙিন। এই গানের নেপথ্যেও ছিল সরোজের জাদু। তবে ‘ধক ধক করনে লাগা’ গানটির শুটিং ঘিরে আছে কিছু মজার কাহিনি। ৫ মিনিটের এই গানের প্রথম আড়াই মিনিটের শুটিং হয় তিন দিনে। বাকি অংশের শুটিং হয় মাত্র এক রাতে। মাধুরী তখন বলিউডের ব্যস্ত নায়িকা। তাঁর সময়ের সংকটের কারণে এক রাতেই শুটিং করতে বাধ্য হয়েছিলেন পরিচালক ইন্দ্র কুমার। তবে কম সময়ের মধ্যেও কারিশমা দেখাতে পারেন একজনই, তিনি হলেন সরোজ খান। রাত ৯টায় শুটিং শুরু হয়। ভোর ৫টায় হয় প্যাকআপ। গানটির চিত্রগ্রাহক ছিলেন বাবা আজমি। তিনি বলেছিলেন, রিটেক না হলে এক রাতেই শুটিং শেষ করবেন। আর বাবা আজমি তা–ই করেছিলেন। সরোজ এমন জাদুই দেখিয়েছিলেন যে একবার নাচ তোলার পর কোনো দৃশ্যই দ্বিতীয়বার আর ধারণ করতে হয়নি।
ডোলা রে ডোলা রে
ছবি: দেবদাস
‘ডোলা রে ডোলা রে’ গানটি সরোজ খানের আরেক অমর কীর্তি। সঞ্জয়লীলা বানসালি পরিচালিত দেবদাস ছবির এই গান নিয়ে খুবই দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিলেন সরোজ খান। কারণ, এক ফ্রেমে বলিউডের দুই শীর্ষ নায়িকা মাধুরী দীক্ষিত ও ঐশ্বরিয়া রাই বচ্চনকে তুলে ধরতে হবে। তাই দুজনের প্রতি সমান নজর দিতে হবে তাঁকে। ‘ডোলা রে ডোলা রে’ গানের মাধ্যমে সরোজ নাচের এক নতুন দিগন্ত মেলে ধরেন। কত্থক ও ভরতনাট্যম—দুই শাস্ত্রীয় নৃত্য একত্রে এনে তিনি আবিষ্কার করেন ‘নটওয়ারি’ নৃত্যশৈলী। এই গানের কোরিওগ্রাফির জন্য ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেছিলেন।
ইয়ে ঈশক হায়ে
ছবি: জাব উই মেট
‘ইয়ে ইশক হায়ে’ গানটি মানে এক বিরামহীন ফুরফুরে সফর। এই সফরে যে কেউ সঙ্গী হতে চায়। জাব উই মেট ছবির এই গান সরোজ খানের কোরিওগ্রাফিতে জীবন্ত হয়ে উঠেছিল। ছবির নায়িকা কারিনা কাপুর খানকে তাঁর মাস্টারজি (সরোজ খানকে এই নামে ডাকেন বলিউডের অনেক তারকা) ভীষণ বকুনি দিয়েছিলেন নাচ তোলার সময়। ‘এই মেয়ে কোমড় নাড়া’ বলে রাত একটার সময় কারিনার ওপর চিৎকার করেছিলেন সরোজ। ‘পা নাড়াতে পারিস না তো, মুখটাকে কাজে লাগা’, এ কথাও কারিনাকে বলেছিলেন তিনি। সেই শিক্ষা আজও কারিনা নিজের অমূল্য অর্জন হিসেবে আগলে রেখেছেন।
তাবাহ হো গায়ি
ছবি: কলঙ্ক
সরোজ খানের শেষ সৃষ্টি ‘তাবাহ হো গায়ি’। কলঙ্ক ছবির এই গানে বহু বছর পর পর্দায় দেখা যায় সরোজ-মাধুরী অনবদ্য যুগলবন্দী। এই জুটির এক হওয়া মানেই এক কালজয়ী পরিবেশনার জন্ম। মাধুরী এই গানের একেকটা দৃশ্য এক টেকেই শেষ করেছিলেন। গুরুজি সরোজের পছন্দ ভালো করেই জানতেন তিনি। তবে এই গানের মধ্য দিয়ে আলিয়া ভাট প্রথমবারের মতো গুরুজির সান্নিধ্য পেয়েছিলেন। এই ছবির সেটে আলিয়ার নাচের প্রশংসা করেন সরোজ। আলিয়াকে তিনি বলেন, ‘আমার সঙ্গে সময় কাটাও। আমি তোমাকে শেখাব কীভাবে চোখ দিয়ে নাচতে হয়।’