আমাদের একজন এন্ড্রু কিশোর ছিলেন
গত কয়েক দশক দেশের প্লেব্যাক সংগীত আর তাঁর নাম ছিল সমান্তরাল। তাই নামের পাশে 'প্লেব্যাক সম্রাট' উপাধি যুক্ত হয়ে গিয়েছিল অঘোষিতভাবে। সেই এন্ড্রু কিশোর পিঞ্জর ভেঙে ডানা মেলে উড়াল দিলেন ওপারে। গত সোমবারের সন্ধ্যাটি ছিল বাংলা গানের জন্য বিষাদময়। এ বিষাদ শেষ হওয়ার নয়, এ ক্ষতি অপূরণীয়।
নন-হজকিন লিম্ফোমা নামের ব্লাড ক্যানসারে আক্রান্ত ছিলেন এন্ড্রু কিশোর। গত ৯ সেপ্টেম্বর উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরের উদ্দেশে দেশ ছেড়েছিলেন তিনি। সেখানে চিকিৎসাও চলছিল। দীর্ঘ ১০ মাস লড়াই করেছেন এই মারণব্যাধির সঙ্গে। কিন্তু মৃত্যুর কাছে হার মানতে হলো তাঁকে। তবে নিজের ইচ্ছাতেই দেশে ফিরতে চেয়েছেন। বলেছিলেন, 'আমি আমার দেশে গিয়ে মরতে চাই, এখানে নয়।' ১১ জুন সিঙ্গাপুর থেকে দেশে ফেরেন। নিজের শহর রাজশাহীর মহিষবাথান এলাকায় বোনের বাড়িতে শেষ হলো তাঁর জীবনের গল্প, পৃথিবী ছেড়ে বিদায় নিলেন।
উপহার দিয়েছেন অসংখ্য জনপ্রিয় গান। চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় গান বলতেই, এন্ড্রু কিশোর আসবেন সবার আগে। দেশের আনাচকানাচে তরুণ অনেক শিল্পী তাঁর গায়কি অনুকরণ করতেন, তিনি ছিলেন যশপ্রার্থী শিল্পীদের আদর্শ। দেশের গণ্ডি পেরিয়েও কণ্ঠ দিয়েছেন বিদেশি গানে। আর ডি বর্মণ, যাঁকে পঞ্চম বলে জানেন সবাই, উপমহাদেশের বিখ্যাত এই সংগীত পরিচালকের পরিচালনায়ও গেয়েছেন তিনি। চলচ্চিত্রের প্রয়োজনে বিদায়ের গান গেয়েছেন অনেক, 'জীবনের গল্প/ আছে বাকি অল্প', 'হায় রে মানুষ রঙিন ফানুস', কিংবা 'ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে'। গানের মতোই তিনিও জীবনের গল্প চুকিয়ে পাড়ি জমালেন ওপারে। তাঁকে নিয়ে সংগীতাঙ্গনের কয়েকজন বিশিষ্ট শিল্পী স্মৃতিচারণ করলেন।
দ্বিতীয় এন্ড্রু কিশোর আমরা পাব না
খুরশীদ আলম, সংগীতশিল্পী
সংগীতাঙ্গন বা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি যা–ই বলি, এন্ড্রু কিশোর ছিল আমাদের দেশের সম্পদ। বড় মাপের একজন শিল্পীকে হারালাম। এমন মানুষ কিংবা গায়ক যা–ই আমরা বলি না কেন, আসলে আমরা মূল্যবান কিছু হারালাম। এন্ড্রু কিশোরের চেয়ে ভালো শিল্পী আসতে পারে, কিন্তু দ্বিতীয় এন্ড্রু কিশোর আমরা পাব না। আমি ব্যক্তিগতভাবে তাঁর সঙ্গে বহু গান গাওয়ার সুযোগ পেয়েছি। তাঁর সঙ্গে গান গাইতে পেরে আমি নিজেকে ধন্য মনে করি। সবশেষে যা–ই বলি, আমরা একজন গুণী মানুষকে হারালাম।
তাঁর প্রয়াণ আমার অঙ্গহানির মতো
হানিফ সংকেত, উপস্থাপক ও নির্মাতা
এন্ড্রু কিশোর আমার প্রাণের বন্ধু ছিল। তাঁর প্রয়াণ আমার কাছে নিজের অঙ্গহানির মতো। একসঙ্গে দেশ ঘুরেছি। হাজারো স্মৃতি আমাদের। কোথাও অনুষ্ঠান করতে গেলে কখনো শিল্পীর মতো আচরণ করত না। মনে হতো 'ইত্যাদি'র কর্মী। আমি তার দেখভাল কী করব, সে আমার দেখভাল শুরু করে দিত। তার বড় গুণটা হচ্ছে, কারও বদনাম করত না। জুনে দেশে ফিরে প্রথম ফোনটা সে আমাকে করেছিল। বলেছিল, 'দোস্ত, আমার জার্নি শেষ, আই অ্যাম রেডি টু ফ্লাই। আসার দরকার নাই, তাতে কষ্ট কম পাবি।'
আমার বড় ভাইয়ের মতো ছিলেন
কুমার বিশ্বজিৎ, সংগীতশিল্পী
তিনি শুধু সহযাত্রী নন, আমার বড় ভাইয়ের মতো ছিলেন। তিনি আমাকে যেমন আদর করতেন, তেমনি শাসনও করতেন। আমাদের এমন একটা সম্পর্ক ছিল, যেখানে সবকিছুর সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলাম। দাদার বিয়ের গাড়ি সাজানো থেকে শুরু করে সব করেছি। কী বলব, আমাদের দুজনের সম্পর্ক খুবই গভীর ছিল। দুজন গাড়ি কিনেছি একসঙ্গে, আবার আমাদের বাসার ফার্নিচার বানাব—তা–ও একই রকম। অসংখ্য স্মৃতি আমাকে কাঁদাচ্ছে। আমরা একসঙ্গে অনেক গান করেছি। ভালো লাগছে, আমার সুরে কিশোর দাদা একটি গান করেছিলেন।
আমাদের একজন এন্ড্রু কিশোর ছিলেন
কনকচাঁপা, সংগীতশিল্পী
আমার খুব সৌভাগ্য, পেশাদার জীবনে যখনই চলচ্চিত্রের গান গাওয়া শুরু করেছি, এন্ড্রুদাকে পেয়েছি। তাঁকে কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। তাঁর গান গাওয়ার স্টাইল, দক্ষতা, ক্ষমতা আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি। এটা আমার জীবনের অনেক বড় একটা পাওয়া। বাংলাদেশের গর্ব করা উচিত আমাদের একজন এন্ড্রু কিশোর ছিলেন। অনেকে বলতে পারেন, কিশোর কুমারের মতো গলা, আমি বলব এন্ড্রু কিশোর এন্ড্রু কিশোরই, তাঁর কণ্ঠটা আমার কাছে যেন গলিত সোনা। তাঁকে এত দ্রুত হারাব, ভাবতেই সবকিছু এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।