'ডুমুরের ফুল' সিনেমার মাস্টার শাকিল এখন যেমন
গুনে গুনে ১৪টি ছবিতে অভিনয় করেছেন। সিনেমায় প্রথম অভিনয়ের ৪০ বছর পেরিয়ে গেছে। ধুলা জমেছে তাঁর পাওয়া জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের ট্রফিগুলোয়। তবু আজও দর্শকেরা খোঁজ করেন ‘ডুমুরের ফুল’ ছবির ‘আপায় কইছে আমারে বাল্যশিক্ষা কিন্যা দিব’ গানের দৃশ্যের অভিনেতা আজাদ রহমান শাকিলকে। আশির দশকে ‘মাস্টার শাকিল’ নামে তিনি দেশজুড়ে জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন।
১৯৭৮ সালে সুভাষ দত্ত পরিচালিত ‘ডুমুরের ফুল’ ছবিতে প্রথম অভিনয় করেন শাকিল। এ ছবি থেকেই তাঁর দর্শকপ্রিয়তার শুরু। প্রশংসার শুরুও একই ছবি থেকে। এ ছবির জন্য শ্রেষ্ঠ শিশুশিল্পী হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান শাকিল। ‘ডানপিটে ছেলে’ ছবির জন্যও একই পুরস্কার দ্বিতীয়বার ঘরে নেন। আর তৃতীয়বার পুরস্কার পান পার্শ্বচরিত্রে শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হিসেবে। তাঁর দর্শকধন্য ছবি 'পুরস্কার' নিয়ে আসে এই পুরস্কার।
সেই মাস্টার শাকিল আর শিশুশিল্পী নেই। তিনি এখন একজন পরিণত মানুষ। যুবক বয়সে শেষ সিনেমায় অভিনয় করেছেন। ১৯৯৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত খান আতাউর রহমান পরিচালিত শেষ ছবি ‘এখন অনেক রাত’ শাকিলেরও শেষ ছবি। তারপর আর সিনেমায় অভিনয় করেননি। বাংলাদেশ টেলিভিশনেও শেষ অভিনয় করেছেন পাঁচ–ছয় বছর আগে। তাঁকে এখন পর্দায় তেমন দেখা যায় না।
কিন্তু প্রথম আলোকে শাকিল জানান, তিনি কখনোই অভিনয় ছাড়েননি। টুকটাক অভিনয় সব সময়ই করে গেছেন। এমনকি নিজে দুটি নাটকও পরিচালনা করেছেন। সঙ্গে নাটক প্রযোজনাও। গত বছর চ্যানেল আইতে তাঁর অভিনীত একটি একক নাটক এবং একটি ধারাবাহিক নাটক প্রচারিত হয়। সেসব কজন দর্শকইবা দেখেছেন? সব মিলিয়ে লোকচক্ষুর অন্তরালেই আছেন শাকিল।
কথায় কথায় শাকিল এ–ও জানান, তিনি চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সদস্য নন। যে কারণে সমিতির নির্বাচনে তাঁকে দেখা যায় না। তাঁকে দেখা যায় না সমিতির বনভোজনেও। অন্য শিল্পীরা এসব অনুষ্ঠানে দীর্ঘদিন পর নিজেদের মধ্যে দেখা-সাক্ষাতের উপলক্ষ পেলেও শাকিল এসব থেকে বঞ্চিত। তিনি জানান, সিনেমার মানুষদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ সামান্যই।
শাকিলের কাছ থেকে জানা গেল, ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়েই আছেন তিনি। অবসরে গানবাজনা করেন। নিজে লেখেন, নিজেই সুর দেন, নিজেই গান। তাঁর গানের তিনটি অ্যালবাম প্রকাশ পেয়েছে। যদিও সেটা ১০-১২ বছর আগের ঘটনা। পুরান ঢাকার আদি বাসিন্দা তাঁরা। গেন্ডারিয়ায় সপরিবারে থাকেন। স্ত্রী খালেদা রহমান আর পুত্র তাবরেজ রহমান দান্তেকে নিয়ে তাঁর সংসার। ২০১৮ সালে বিয়ের পিঁড়িতে বসেন।
পাঁচ ভাই, এক বোনের মধ্যে শাকিল সবার ছোট। তাঁর বড় ভাই চয়ন রহমান আর তিনি একসঙ্গে অভিনয় করতেন। এলাকায় শিশুসংগঠন করতেন। মঞ্চে অভিনয় করতেন। বিটিভির ‘নতুন কুঁড়ি’ প্রতিযোগিতায় প্রথম হন শাকিল। ‘ডুমুরের ফুল’–এ অডিশন দিয়ে শত শত ছেলের মধ্য থেকে নির্বাচিত হন। এ ছবি মুক্তির পর তাঁর খ্যাতির শুরু। তাঁর বড় ভাই চয়ন রহমানও তিনটি ছবিতে অভিনয় করেছেন। ওই তিনটি ছবিতে শাকিলও অভিনয় করেছেন।
সেই সময়ের কথা স্মরণ করে শাকিল বলেন, ‘কখনো মনে হয়নি অভিনয় করছি। সব সময় মনে হয়েছে, আমি আমার পরিবারের মধ্যেই আছি। সেই সময় কারা কাজ করতেন? সিনেমায় কাজ করেছি সুভাষ দত্ত, চাষী নজরুল ইসলাম, শেখ নজরুল ভাইদের সঙ্গে। আবার টিভিতে আবদুল্লাহ আল–মামুন, বরকতুল্লাহদের সঙ্গে। চিত্রপরিচালক বলুন, টিভি প্রযোজক বলুন, তাঁরা এত গুণী ছিলেন যে তাঁদের কারণেই সেই সময়টা ছিল স্বর্ণ সময়।’
শাকিল বলেন, ‘আমি পরম সৌভাগ্যবান যে গুণী পরিচালকদের সঙ্গে কাজ করতে পেরেছি। এটা সৌভাগ্য ছাড়া আর কিছু নয়। আমি খুব বেশি ছবিতে অভিনয় করিনি। অল্প কিছু ছবিতে কাজ করেছি। যে চরিত্রগুলো করেছি, সেগুলো পরম যত্নে গড়া। চরিত্রগুলোর জন্যই দর্শকেরা আজও আমাকে মনে রেখেছেন। এই কৃতিত্ব গুণী পরিচালকদের। তাঁরা আমাকে হাতে ধরে সবকিছু শিখিয়েছেন।’
‘জানি না এখন সিনেমা জগৎ কেমন হয়েছে বা কীভাবে এখানে কাজ হয়। এখনো হয়তো আগের মতো ভালোবাসা নিয়ে কাজটা হয়। আমরা তো ভালোবেসে কাজটা করেছি। কাজের জন্য কাজ করিনি। সেটা এখন না থাকলে কেন নেই, আমি জানি না। নিশ্চয়ই অনেকে ভালোবেসে কাজ করেন,’ বলেন শাকিল।
সিনেমা ছাড়াও শাকিল শতাধিক নাটকে অভিনয় করেছেন। শিশুশিল্পী হিসেবে তাঁর একচেটিয়া জায়গা ছিল। তাঁর অভিনীত বিখ্যাত নাটকগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘ঢাকায় থাকি’, ‘সংশপ্তক’, ‘মাটির কোলে’ ইত্যাদি। ‘সংশপ্তক’ পুনঃপ্রচারের কথাটিও উল্লেখ করেন শাকিল। তিনি জানান, সেই সময় নাটকগুলো দারুণ জনপ্রিয় হয়েছিল।
শাকিল অভিনীত ছবিগুলো হচ্ছে ‘ডুমুরের ফুল’, ‘ডানপিটে ছেলে’, ‘পুরস্কার’, ‘দেবদাস’, ‘এতিম’, ‘কলমীলতা’, ‘আঘাত’, ‘লাগা’', ‘দিন যায় কথা থাকে’, ‘সৎমা’, ‘ঘর–সংসার’ ইত্যাদি। শাকিল বলেন, ‘আমি তিনবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছি। এটা আমার জন্য সৌভাগ্যের ব্যাপার। এ জন্য আমি কখনো অভিনয় ছাড়িনি। আবার অনেক ওপরে যেতে হবে, এমনটাও কখনো চিন্তা করিনি।’
জীবনের এ পর্যায়ে তাঁর উপলব্ধির কথা জানতে চাইলে শাকিল বলেন, ‘এ জীবনে অনেক মানুষের ভালোবাসা পেয়েছি। মাস্টার শাকিল পরিচয় পেলে এখনো মানুষ আপন ভেবে কাছে টেনে নেন। এখনো আমার খোঁজ করেন দর্শকেরা। সত্যি, আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।’