যে কারণে চলচ্চিত্র জগৎ ছেড়ে দিয়েছেন শাকিল
দশ বছরের কম সময়ের ক্যারিয়ার। এই সময়ে বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছেন এই নায়ক। একসময় চলচ্চিত্র থেকে নীরবেই নিজেকে সরিয়ে নেন। তাঁকে জিজ্ঞাসা করি, জনপ্রিয়তা থাকার পরও হঠাৎ দূরে সরে গেলেন, কী এমন অভিমান ছিল?
উত্তর দিতে দেরি হয় না। ‘কোনো অভিমান থেকে না। আমি যে পরিবেশে কাজ শুরু করেছিলাম, পরে সেই পরিবেশ একসময় ছিল না। একটা সময় আমাদের সিনেমার মান নিচে নামতে শুরু করল। সেই সঙ্গে অসুস্থ ধারার ছবি তৈরি শুরু হতে লাগল। তখন নিজেকে সরিয়ে নেওয়া ছাড়া আর কোনো রাস্তা ছিল না। চাইনি সাংস্কৃতিক মানুষ হয়ে অসুস্থ ধারার ছবিতে নিজেকে জড়াতে। চাইনি রাস্তায় বের হলে মানুষ আমাকে দেখে ধিক্কার দিক। সেই সময়ে অনেক নিম্নমানের অশ্লীল ছবি ব্যাপক হারে হওয়া শুরু হয়। অসুস্থ ধারার ছবিতে জড়াতে চাইনি বলেই সরে এসেছি’—কথাগুলো বলেন নায়ক শাকিল খান।
ঝোঁকের বসেই চলচ্চিত্রে আসেন শাকিল খান। ক্যারিয়ারে প্রথম ‘আমার ঘর আমার বেহেশত’ ছবিতে অভিনয় করেন ১৯৯৪ সালে। সে ছবিটি মুক্তি পায় তিন বছর পর। এরপর যেন এলেন, দেখলেন, জয় করলেন। একে একে উপহার দেন ব্যবসাসফল ‘পাহারাদার’, ‘বিয়ের ফুল’, ‘নারীর মন’, ‘কষ্ট’র মতো অসংখ্য ছবি। অল্প সময়েই বাংলা সিনেমায় নিজের শক্ত অবস্থান তৈরি করেন এই নায়ক। তুমুল ব্যস্ততায় যখন নিজেকে সময় দেওয়ার মতো অবসর মেলে না, শুটিংয়ে ছুটতে হয় দেশ–বিদেশের নানা প্রান্তে, এমন এক সময়ে হঠাৎ করেই চলচ্চিত্রে অভিনয় থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন। এরপর তিনি আর সিনেমায় নিয়মিত হননি।
করোনার এই সময়েও ব্যবসায়িক কাজে বাসায় থেকে বের হতে হয়। এই নায়ক বলেন, ‘যতটুকু বের না হলেই নয়, ঠিক ততটুকু বের হই। বাইরে বের হওয়ার আগে যথেষ্ট নিরাপত্তা নিয়েই বের হই। কোনোভাবেই চাইছি না করোনা কাছে আসুক। এ জন্য বাসায় এবং বাইরে সামাজিক দূরত্ব মেনে চলছি। আমার সন্তানেরাও বুঝতে শিখেছে। তারা বের হওয়ার সময় বলে, বাবা সাবধানে যেয়ো, সব জায়গায় যেয়ো না। বাইরে এলে তাদের জন্যই বেশি কষ্ট হয়। ফেরার সময় বারবার ভাবি, আমি কি নিরাপদে বাসায় ফিরছি।’
এই নায়কের বাসায় বেশির ভাগ সময় কাটছে কম্পিউটারে নিজের এবং ব্যবসায়িক কাজ করে। অবসর সময় দেশ–বিদেশের সিনেমা দেখেন, বই পড়েন এবং সন্তানদের সঙ্গে সময় কাটান। দেশের কোন সিনেমা দেখছেন জানতে চাইলে শাকিল খান বলেন, ‘রাজ্জাক ভাইয়ের অনেক আগের একটি ছবি দেখেছি। ছবিটির নাম “নাচের পুতুল”। খুবই অসাধারণ ছবি! কী অভিনয়!’ কিংবদন্তি নায়ক রাজ রাজ্জাকের সঙ্গে শাকিল খান অনেকগুলো ছবিতে অভিনয় করেছেন। সেই সময়ের স্মৃতিগুলো এখনো এই অভিনেতার কাছে জীবন্ত হয়ে আছে। এই অভিনেতা রাজ্জাক সম্পর্কে বলেন, ‘রাজ্জাক ভাইকে ছাড়া এখনো এফডিসি শূন্য মনে হয়। ভাই ছিলেন অদ্ভুত এক অভিনয়ের জাদুকর। এমন অভিভাবকের সঙ্গ পেয়ে আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি। ভাই ছিলেন আমাদের ফিল্মের মাথা। এমন মানুষটা যখন চলে যান, তখন তাঁর পরিপূরক বা সে জায়গা কখনো পূরণ হয় না।’
শাকিল খান নায়ক রাজ রাজ্জাক সম্পর্কে আরও বলেন, ‘যখন একসঙ্গে অভিনয় করেছি, তখন তাঁর কাছ থেকে আমরা শিখেছি, পরামর্শ নিয়েছি। সেই সাজেশন দেওয়ার এখন তেমন কেউ নেই। তিনি ছিলেন চলচ্চিত্রের পিতৃতুল্য। তাঁকে হারিয়ে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র এখনো অভিভাবকহীন।’ শাকিল খান স্মৃতির পাতা থেকে আরও বলেন, ‘ফরীদি ভাই (হুমায়ূন ফরীদি), রাজীব ভাই, জসীম ভাই, কৌতুক অভিনেতা দিলদার ভাই, অনেক নির্মাতা, ফাইট ডিরেক্টর, ড্যান্স ডিরেক্টরদের কথা মনে পড়ে। তাঁদের সঙ্গে অনেক স্মৃতি। তাঁরা আজ নেই, কিন্তু মাঝেমধ্যে যখন মনে পড়ে, তখন কষ্ট লাগে। একবার “পাহারাদার' ছবির শুটিং করার জন্য কস্টিউম পরে আমি আর রাজীব ভাই ধানখেতের মধ্যে হেঁটে যাচ্ছিলাম। আমরা বুঝতেই পারিনি একটা জায়গায় খালের মতো ছিল। হঠাৎ এগোতে এগোতে সেই খালে পড়ে যাই। আমাদের পুরো কস্টিউম ভিজে যায়। সেই দিন ভেজা কস্টিউম শুকিয়ে আর শুটিং করতে পারিনি।’
শাকিল খান কদিন আগে নিজের অভিনীত ‘মেঘলা আকাশ’ ছবি দেখেছেন। ছবিতে আরও অভিনয় করেছেন মৌসুমী ও পূর্ণিমা। প্রায় দুই দশক আগের এই ছবিতে নিজের অভিনয় দেখে তিনি খুবই মনঃক্ষুণ্ন। তিনি বলেন, ‘ছবি দেখে আমার নিজের অনেক ভুলভ্রান্তি চোখে পড়েছে। যদি আগের জায়গায় যেতে পারতাম, তাহলে আবার নতুন করে কিছু জায়গায় অভিনয় করতাম। কিন্তু সেই জায়গায় তো যাওয়া সম্ভব নয়। পুরোনো ছবির অভিনয় নিয়ে সব সময় মনে একটা অফসোস থেকে যায়। এখন যেটা চলে গেছে, সেটার জন্য আফসোস বাড়িয়ে লাভ নেই। সেটাকেও এখন ভালোই বলতে হবে।’
অভিনয় করার সময়ে বিভিন্ন রকম সমালোচনা প্রায়ই শোনা যেত এই নায়কের নাম ঘিরে। সমালোচনা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘পজিটিভ সমালোচনাকে সব সময় সাধুবাদ জানাই। কিন্তু নেতিবাচক কোনো সমালোচনা আমার সঙ্গে যায় না। আমি পজিটিভ মানুষ। সব সময় পজিটিভ মাইন্ডে চলি। যারা নেতিবাচক সমালোচনা করে, তাদের আমি ভালো চোখে দেখি না।’
বর্তমান চলচ্চিত্র সম্পর্কে শাকিল খান বলেন, ‘একসময় বছরে অনেকগুলো ভালো ছবি হতো। সেই জায়গায় একটি দূরত্ব তৈরি হয়েছে। মানুষ হলমুখী হচ্ছে না। তবে মানুষকে বিনোদনের জন্য হলেও হলমুখী হওয়া দরকার। মানুষ যতই ইউটিউবে আর মোবাইলে ছবি দেখুক, বড় পর্দা এবং ছোট পর্দার বিনোদনের মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে। তবে এটুকু বলব, এখন আগের থেকে অনেক ভালো ছবি হচ্ছে। দর্শকদের হলে গিয়ে ছবি দেখা উচিত।’ তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের চলচ্চিত্র এখন এক–দুজননির্ভর। এখানে নায়ক–নায়িকাদের ঘাটতি আছে। এই সময়ে নতুন ছেলেমেয়েদের অভিনয়ে আসতে হবে। এই সময়ের ছেলেমেয়েরা অনেক আধুনিক, অনেক ট্যালেন্টেড, তারা এগিয়ে এলে চলচ্চিত্রের উন্নয়ন ঘটবে। নতুনদের নিয়ে কাজ করতে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিকে এগিয়ে আসতে হবে। যখন হিরো–হিরোইনের সংখ্যা বাড়বে, তখন এমনিতেই প্রতিযোগিতা শুরু হবে। তখন ভালো ছবি হবে।’