মায়ের খোলা চিঠি
দেড় মাস হলো ঘর থেকে বের হই না। কদিন থেকেই সন্ধ্যা পেরুলে ধূলিঝড় শুরু হয়। তার খানিক বাদেই মেঘ গর্জে বৃষ্টি। এক পশলা বৃষ্টির ঝাপটায় প্রায়ই জানালার পাশে রাখা আমার বই-খাতা সব ভিজে যায়।
আজও তা–ই। সন্ধ্যা নামার পরই ঝড়। দৌড়ে গিয়ে জানালার কপাট টেনে দরজার ছিটকিনিটা দিতেই টুংটাং শব্দ কানে এল। শব্দটা আমার চেনা, বহুদিনের চেনা। কয়েক পা এগিয়ে রান্নাঘরের কাছে গেলাম।
আম্মা চা করছেন আমার জন্য। এ সময়টা আমার ভীষণ প্রিয়। আসলে সময়, নাকি সময়ের মধ্যে চা হাতে দাঁড়িয়ে থাকা নীরব মানুষটি বেশি প্রিয়, থাক সে কথা এখন না-ই বলি।
আমার ছেলেবেলা কেটেছে যে বাড়িটায়, তার অদূরেই রেললাইন। মাঝরাতে ট্রেনের হুইসেলে প্রায়ই ঘুম ভেঙে যেত। চোখ খুলেই মাকে খুঁজতাম আর কাঁদতাম। মনে হতো, মা বুঝি কোথাও চলে গেলেন, হারিয়ে গেলেন। সেই একই অনুভূতি, একই ভয় বড় হয়েও একবার পেয়েছিলাম, যেদিন আম্মার স্ট্রোক হলো। মনে হচ্ছিল, মুহূর্তেই আমার সারা শরীর অসাড়, অনড় হয়ে গেল। পৃথিবীর সবকিছু অচেনা, ঝাপসা। সত্যি, মা ছাড়া পৃথিবী এমনই।
বাঙালি মধ্যবিত্ত রক্ষণশীল পরিবারে আমার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা। মধ্যবিত্ত এবং রক্ষণশীল শব্দ দুটির অদৃশ্য একটা দেয়াল আছে। এই দেয়াল ভাঙার সাহস এবং শক্তি খুব কম মানুষই রাখে। আম্মা সেই গুটিকয় মানুষের একজন, যিনি কিনা শত-সহস্র সীমাবদ্ধতার মধ্যেও স্বপ্ন দেখেছিলেন, তাঁর মেয়ে একজন শিল্পী হবে। শুধু স্বপ্ন দেখেই থেমে যাননি, স্বপ্নের সেই অদেখা–অজানা গন্তব্যহীন পথে আমাকে হাত ধরে নিয়ে গিয়ে চলতে শিখিয়েছেন। রোদের রং, সময়ের ঘ্রাণ, বাতাসের সুর—এদের সবার সঙ্গে প্রথম পরিচয়টা আম্মাই করিয়ে দিলেন। আম্মা পাশে না থাকলে নিজেকে চেনার চেষ্টার এই সাহসই পেতাম না।
আমি তখন খুব ছোট, একবার আম্মাকে ভয় দেখাব ভেবে বাড়ির সদর দরজার রাস্তা পেরিয়ে একটা বাঁশঝাড়ে লুকিয়েছিলাম বেশ খানিকক্ষণ। সেদিন আম্মাকে যেভাবে কাঁদতে দেখেছি, আজও তাঁর সেই অসহায় মুখটা ভুলিনি। আম্মাকে দেখে আমি নিজেই ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। এরপর আর কখনোই আম্মাকে ভয় দেখানোর সাহস হয়নি। আম্মার হাত ধরে আরেকবার উঠানঘেরা ছেলেবেলার সেই বাড়িতে খুব যেতে ইচ্ছে করে। উঠানের বাঁ দিকে বিশাল একটা ডুমুরগাছের ঝোপ। আর উঠানজুড়ে আম্মার বোনা সন্ধ্যামালতি আর শ্যামসোহাগীর ঘ্রাণ।
আমরা সাত ভাইবোন। সবাইকে মানুষের মতো মানুষ করতে গিয়ে তাঁর নিজেকে নিয়ে ভাবার সময়টুকু কখন হারিয়ে গেছে, আম্মা তা টেরই পাননি। তবে এ নিয়ে আম্মার মধ্যে কখনো কোনো আফসোস দেখিনি। সন্তানের জীবনের মধ্যেই নিজের জীবনের সব সুখ খুঁজে নেওয়ার অসীম শক্তি সৃষ্টিকর্তা বোধ করি মায়েদেরই দেন। ভীষণ ভালো গান করতেন আম্মা; কিন্তু সংসার, সন্তান এবং বাস্তবতায় সেই সুর হারিয়ে ফেলেছেন আম্মা। হয়তো সে জন্যই প্রতিমুহূর্তে আমার মধ্যে সেই হারিয়ে যাওয়া সুর খুঁজে বেড়ান। এমন রোদ-বৃষ্টি, আলো-ছায়া আর ঝড়ের ঝাপটা সামলে দিয়ে ছেঁড়া তারে সুর বেঁধে আমাদের জীবনের গল্প সাজিয়ে দিয়েছেন আম্মা।
তারপর এল আমার জীবনের আরেক নতুন গল্প। মা হলাম আমি। বড় খোকার মুখটা দেখেই মনে হলো, আমার সামনে খুলে গেছে জীবনের অজস্র অজানা দুয়ার। বেঁচে থাকার আর সব কারণ গৌণ হয়ে গেল। বড় খোকার যখন আঠারো মাস বয়স, ঠিক তখনই কোলে এল ছোট খোকা। খোকারা দুজনই ছোট, তখন ওদের নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত আমি। কেমন করে বাঁচিয়ে রাখব অভিনয়শিল্পী ছবিকে? তখন আবার টের পেলাম সেই হাতের স্পর্শ। আমার চিরচেনা সেই হাত, তবে এবার হাতজোড়া একটু রুগ্ণ, ধবল হাতে নীল শিরার অস্তিত্ব টের পাচ্ছি, বয়স হয়েছে যে! কিন্তু শক্তি ও মনোবল ঠিক সেই আগের মতো, কমেনি এক ফোঁটাও। মাঝেমধ্যে আমার খোকাদের দুরন্তপনায় যখন একটু রেগে যাই, তখন আম্মাকে দেখি কি অসীম ধৈর্যে সামলে নিচ্ছেন সবকিছু।
জীবন জীবনের নিয়মেই আমাদের থামতে শেখায়। এখন এমনই এক সময়। সম্ভবত এটাই আমার বড় হওয়ার পর সবচেয়ে বেশি সময় মায়ের খুব কাছে থাকা। আমার সৌভাগ্য নানুও এই সময়ে আমার কাছে আছেন। তাঁর বয়স প্রায় ১০০। নানু হাঁটাচলা করতে পারেন না। তবে তাঁর জ্ঞান, বুদ্ধি, স্মৃতি সব ঠিক আছে। হাতের লেখা কী যে সুন্দর। কত গল্প করেন আমাদের সঙ্গে। প্রতি মুহূর্তে আম্মা কী নিবিড় যত্নে নানুকে ওঠান, বসান, খাওয়ান, গোসল করান, ঘুম পাড়ান। আমি দেখি আর ভাবি, আজ যে মানুষটি আমার মা, এই জীবনেই আমিই হব সে মানুষটির মা। এ–ই হয়তো জীবনের উপহার। জীবন আসলে জায়গা বদলের এক অদ্ভুত খেলা।
আজ কদিন ধরে খুব ভোরে ঘুম ভেঙে যায়। আম্মার ঘরের দরজায় গিয়ে একটু দাঁড়াই, দেখি আলো-আঁধারিতে বিছানায় বসে নানু কোরআন পড়ছেন আর আম্মা নামাজ। আমি দরজা থেকে এক পা সরে আসতেই আম্মার আওয়াজ পাই, ‘কে ছবি?।’ আমার নিঃশব্দ নিশ্বাস আম্মাকে জানান দেয় দরজায় আমার উপস্থিতি।
অনেকদিন আগে একটা বইয়ে পড়েছিলাম, ‘মা হওয়া কি মুখের কথা’। পড়ে হেসেছিলাম। হেসে বইটা রেখে দিয়েছিলেম। তারপর নিজে যখন মা হলাম, তখন একটু একটু করে বুঝতে শুরু করলাম ওই কথার মর্ম। সত্যি, মা হওয়া মুখের কথা নয়। ভালো থাকুন পৃথিবীর সব মা। মা দিবসে সব মায়ের প্রতি কৃতজ্ঞতা, ভালোবাসা আর বিনম্র শ্রদ্ধা। শুধু বলব, পরিবার আর সন্তানদের সঙ্গে সঙ্গে নিজেরও একটু যত্ন নিন।
নিজের জন্যও খানিকটা সময় তুলে রাখুন। সময় নিয়ে নিজেকেও একটু ভালোবাসুন।
লেখক: ফারজানা ছবি, অভিনয়শিল্পী