সত্যজিৎ ঘরে বসে বানিয়েছিলেন যে ছবি
বিশেষ এই দিনটি এবার এমন এক সময়ে পালিত হচ্ছে, যখন প্রাণঘাতী বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসে এ পর্যন্ত সারা পৃথিবীতে মারা গেছেন ১ লাখ ৮০ হাজারেরও বেশি মানুষ। আমাদের দেশেও দীর্ঘ হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল।
আজ সত্যজিৎ রায়ের ২৮তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৯২ সালের এই দিনটিতে এই বিশ্ববরেণ্য চলচ্চিত্র নির্মাতা মৃত্যুবরণ করেছিলেন। তাঁর এবারের মৃত্যুবার্ষিকীতে আমাদের সামনে কয়েকটি প্রশ্ন--করোনার এই দিনগুলিতে সত্যজিতের প্রাসঙ্গিকতা কতখানি? সত্যজিতের সৃষ্টি থেকে আমরা কী নিতে পারি এখন? ক্ষুধা ও রোগের এই কালে আসলে শিল্পের মূল্যই বা কতটা?
বৈশ্বিক মহামারি করোনার এই দিনগুলোতে অনেকে ফিরে তাকাচ্ছেন আগের মহামারিগুলোর দিকে। বিগত কয়েকটি শতাব্দীতে বহুবার মহামারিতে বিশ্বজুড়ে অগণিত মানুষের মৃত্যু হয়েছে। বাংলাও সরাসরি এমন এক দুর্যোগ দেখেছিল গত শতাব্দীতে। সেবার মহামারি এসেছিল দুর্ভিক্ষের সঙ্গী হয়ে। ১৯৪৩ সালের সেই ভয়ংকর মন্বন্তরে প্রায় ৫০ লাখ মানুষ মারা যায়। দুর্ভিক্ষ ও মহামারির করুণ ছবিগুলো ক্যানভাসে এঁকেছিলেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন। আর সিনেমার পর্দায় ওই ছবি এঁকেছেন নির্মাতা সত্যজিৎ রায়। ছবির নাম 'অশনি সংকেত'। মহামারি নিয়ে সত্যজিৎ আরেকটি ছবি বানিয়েছিলেন, 'গণশত্রু'।
'অশনি সংকেত'-এর মূল কাহিনি বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন বাংলার এক গ্রামের গল্প। গঙ্গাচরণ চক্রবর্তী ও তাঁর স্ত্রী অনঙ্গ কিছুদিন হলো এই গাঁয়ে এসেছেন। বাস্তবিক অর্থেই সুজলা-সুফলা-শস্য-শ্যামলা গ্রাম। কোথাও অভাবের চিহ্নমাত্র নেই। গঙ্গাচরণ গাঁয়ের একমাত্র ব্রাহ্মণ, একই সঙ্গে একমাত্র পুরুতঠাকুর, বদ্যিবাবু, মাস্টারমশাই। ধনী-গরিব, উঁচু-নিচু জাত নির্বিশেষে তার কদর। ভালো আয়ের পাশাপাশি উপরিও বেশ।
দিনগুলো চলছিল বেশ। এরই মধ্যে হঠাৎ বাজারে চালের দাম বাড়তে থাকে। লোকের বলাবলিতে জানা যায়, মহাশক্তিধর দেশগুলোর যুদ্ধের কারণে এ সংকট। প্রথম দিকে গঙ্গাচরণ লোকের সমীহবশে কিছু চালের ব্যবস্থা করতে পারলেও কিছুদিন পরই অবস্থা বদলে যায়। চালের দাম হু হু করে বাড়তে থাকে, গ্রামের সামর্থ্যবানদের গোলার ধান উধাও হয়ে যেতে থাকে। বাজারে সবাই মিলে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। কিন্তু কোথাও চাল নেই, থাকলেও লোকের কাছে তা কেনার পয়সা নেই। ক্ষুধা আর মহামারিতে মরতে থাকে মানুষ। গঙ্গাচরণের চোখের সামনে একসময়ের শান্ত গ্রামে বাড়তে থাকে অরাজকতা। কিন্তু প্রকৃতিতে এই দুর্দিনের ছাপ নেই একদম। মানুষের স্বার্থপরতা ও লোভের ফল হয়ে আসে চরম দুর্যোগ।
ছবিতে অনঙ্গ চরিত্রে অনবদ্য অভিনয় করেন ববিতা। সঙ্গে ছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, সন্ধ্যা রায়। ১৯৭৩ সালে ছবিটি মুক্তি পায়।
পরে, জীবন সায়াহ্নে হেনরিক ইবসেনের 'এন ফোরকেফিয়েন্দে' ('আন এনিমি অব দ্য পিপল') নাটক অবলম্বনে সত্যজিৎ নির্মাণ করেন 'গণশত্রু'। শেষ জীবনে গুরুতর হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে সত্যজিৎ কয়েক বছর ছবি বানাতে পারেননি। পরে যখন ডাক্তার অনুমতি দিলেন, শর্ত ছিল শুট করতে হবে ইনডোরে। আউটডোর শুটিংয়ের ধকল তিনি নিতে পারতেন না। সত্যজিৎ দমে যাননি, এই শর্ত মেনেই হাসপাতালে ও ঘরে থেকে নিজের সৃজনশীল কাজ চালিয়ে যান। প্রায় ইনডোরে বানান তিনটি ছবি, যার প্রথমটি 'গণশত্রু'।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ছোট শহর চণ্ডীপুরকে ঘিরে 'গণশত্রু' ছবির গল্প। এখানকার স্বনামখ্যাত ডাক্তার অশোক গুপ্ত চিকিৎসা করার সময় বুঝতে পারেন, হঠাৎ করেই পানিবাহিত রোগের প্রকোপ বেড়ে গেছে। এজন্য তিনি চণ্ডীপুরের সবচেয়ে জনবহুল অঞ্চল ভুবনপল্লীর জল পরীক্ষা করতে পাঠান কলকাতার ল্যাবরেটরিতে। বেশির ভাগ রোগী ওই অঞ্চল থেকেই আসছিল। ফলাফলে দেখা যায়, সেখানকার পানীয় জল রোগের জীবাণুতে ভর্তি।
এদিকে ভুবনপল্লীর ঠিক মাঝখানে ত্রিপুরেশ্বর মন্দির, চণ্ডীপুরের সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থান। আর মন্দিরের জল চরণামৃত হিসেবে লোকে ভক্তিভরে পান করে। ডাক্তার তাঁর ভাই, মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান নিশীথ গুপ্তের কাছে প্রস্তাব করেন, যতদিন জলের লাইন সারানো না হচ্ছে, ততদিন মন্দির বন্ধ করতে। এখুনি ব্যবস্থা না নিলে মহামারি অবশ্যম্ভাবী।
কিন্তু চেয়ারম্যান ভাই এ কথা মানতে চান না। মন্দিরের কারণেই চণ্ডীপুরের এত আয়, এত সমৃদ্ধি। এদিকে মন্দির কমিটির বক্তব্য, চরণামৃত ঈশ্বরের প্রসাদ। তাতে কোনো দোষ থাকতে পারে না। এই অন্ধ সংস্কারের জের ধরে অশোক গুপ্তর বিরুদ্ধে একজোট হয় সবাই। তার বাড়িতে হামলা হয়। তাঁকে বলা হয় 'গণশত্রু'।
ছবিতে অভিনয় করেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, রুমা গুহঠাকুরতা, ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায়, মমতাশঙ্কর, দীপঙ্কর দে। 'গণশত্রু' মুক্তি পায় ১৯৮৯ সালে। ইবসেন নাটকটি লিখেছিলেন ১৮৮৭ সালে। উনবিংশ শতাব্দীর একটি নাটক, বিংশ শতাব্দীর একটি ছবি আজ একবিংশ শতাব্দীতেও অনেক প্রাসঙ্গিক। এখনো কিছু মানুষের লোভ, অন্ধ বিশ্বাস ও স্বার্থপর মানসিকতার কারণে ভুক্তভোগী হয় আরও অনেক সাধারণ মানুষ।
স্বেচ্ছা গৃহবন্দিত্বের সময়টায় এই মাস্টার ফিল্মমেকারের সবগুলো ছবি দেখে ফেলতে পারেন। তবে 'অশনি সংকেত' ও 'গণশত্রু' ছবি দুটি দেখার সময় বোধ হয় এখনই। মহামারির এই সময়, এমন সময়ের মানবিক সম্পর্ক ও মানুষের ভুলগুলোকে বুঝতে ছবিগুলো হয়তো সাহায্য করবে। হয়তো যুক্তিপূর্ণ কঠিন সত্যকে মেনে নিতে আমাদের সচেতন করবে। মহৎ শিল্পের একটি কাজই যে মানুষকে জাগানো।